চীনের উহান শহর। বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবকেন্দ্র বা ‘এপিসেন্টার’। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, চলতি মাসে সেই উহানে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে কেউ শনাক্ত হয়নি। শহরটির জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দক্ষতার জন্য চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের রাজধানী শহরটিকে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো করোনা মোকাবিলায় ‘মডেল’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ডা. লি ওয়েনলিয়াং বন্ধুদের উদ্দেশে একটি সতর্কতামূলক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। মহামারি করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে এই চিকিৎসকই সর্বপ্রথম সতর্ক করেন বলে বিবেচনা করা হয়। দেশটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইচ্যাটের সেই বার্তাগুলো জীবনযাত্রার গতি পরিবর্তনের সংকেত দিচ্ছিল। পাশাপাশি বৈশ্বিক মহামারির আগমনী ঘণ্টা বাজিয়েছিল।
উইচ্যাটের গ্রুপে পাঠানো বার্তায় ড. লি লিখেছিলেন যে, ‘হুয়ানানের ফল ও সি-ফুডের পাইকারি বাজারে সার্স সংক্রমণের সাতটি ঘটনা ঘটেছে’। চীনা লোকজনের কাছে সামাজিক যোগাযোগের বেশ জনপ্রিয় প্লাটফর্ম উইচ্যাট। ডাটা সেন্সরশিপের জন্য বারবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে এই প্লাটফর্মের নাম।
ওই বার্তায় লি ওয়েনলিয়াং করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বেশ কয়েকটি মারাত্মক উপসর্গের কথাও উল্লেখ করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল শ্বাসতন্ত্রজনিত মারাত্মক সমস্যা; যা নিউমোনিয়ার একটি রূপ। ২০০২ সালে চীনে এবং ২০০৩ সালে হংকংয়ে এ ধরনের নিউমোনিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। বার্তায় এই চিকিৎসক বলেন, ‘দয়া করে সবাই নিজেদের যত্ন নেবেন’।
এই বার্তার কারণে পরে তিনি সমস্যায় পড়েন। এই চিকিৎসকে বিবেচনা করা হয় করোনার প্রথম সতর্ককারী হিসেবে, যিনি তার বন্ধুদের নিরাপদে রাখতে চেয়েছিলেন। তার কথা শুনে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে হয়তো বিশ্ব এই মহামারি থেকে পরিত্রাণ পেত।
চিকিৎসকের বার্তাটি প্রথমদিকে গ্রুপের মাত্র ১৫০ জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরে তারা উইচ্যাট এবং উইবোতে বার্তাটি শেয়ার করেন। এতে বার্তাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই বার্তাই সংকেত দিচ্ছিল যে, উহানের মানুষ পরের কয়েকমাস কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন এবং কিভাবে পৃথিবী চিরতরে পাল্টে যাচ্ছে।
বার্তাটি যখন অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, তখন ড. লিকে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ তলব করে। তার ওপর অভিযোগ তোলা হয় তিনি ‘গুজব ছড়িয়েছেন’। বাধ্য হয়েই তাদের কাছে লি বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হন। আর সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়
হলো এই, যে ভাইরাসটি নিয়ে তিনি বন্ধুদের সতর্ক করেছিলেন, এর কয়েকদিন পর সেই ভাইরাসেই সংক্রমিত হন ড. লি।
নিজের উইবো অ্যাকাউন্টে এই চিকিৎসক ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন। প্রথমে ১০ জানুয়ারি কাশি দেখা দেয়। পরের দিন তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। এর দুইদিন পর তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। এর পরে তার বাবা-মাকেও অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি চীন জরুরিভাবে ভাইরাসটির প্রকোপ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানান দেয়।
বারবার তার করোনা পরীক্ষা করা হয় হলেও প্রতিবারই রিপোর্টে ফল আসে নেগেটিভ। পরে ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি, ড. লি নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দেন যে, শেষ পর্যন্ত তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি গ্লোবাল টাইমস, পিপল’স ডেইলি এবং অন্যান্য চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করে যে, করোনায় সংক্রমিত হয়ে এই চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুর পর এক বছর কেটে যাচ্ছে। তার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেদনা এবং ক্ষোভ। সেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ; যার জন্য একজন সৎ চিকিৎসককে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল।