পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা দিয়েছেন, ভাষাশহীদ বরকতের জন্মভিটা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সালারের বাবলা গ্রামে গড়া হবে স্মৃতিসৌধ। সেই স্মৃতিসৌধে বসবে বরকতের ভাস্কর্য। আর এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দায়িত্ব পালন করবে রাজ্যের সরকার।
গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এ ঘোষণা দেন মমতা। দিনটি কলকাতাসহ গোটা ভারতবর্ষে সাড়ম্বর পালিত হয়েছে। স্মরণ করা হয়েছে ১৯৫২ সালে বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের।
দিনটিকে সামনে রেখে কলকাতার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করেছে নানা অনুষ্ঠানের।
এদিনই দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে মহান ভাষাশহীদ স্মরণে আয়োজিত একুশের অনুষ্ঠানে যোগ দেন এই রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। তিনি বলেন, শহীদ বরকতের ভিটায় রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে ওই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বরকতের জন্মভিটা ঘিরে নির্মিত হবে স্মৃতিসৌধ। ভাষাশহীদ আবুল বরকত জন্মেছিলেন সালারের বাবলা গ্রমে।
এদিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘ভাষা মোদের ভালোবাসা, সবাইকে নিয়ে বাঁচার আশা।’ মমতা লেখেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা। মাতৃভাষার জন্য যাঁরা আত্মবলিদান করেছিলেন, তাঁদের প্রতি আমি কুর্নিশ জানাই। দেশের সব ভাষাকেই আমরা ভালোবাসি। প্রতিটি ভাষাকেই উদ্যাপন করা দরকার। মাতৃভাষা আমাদের সবার প্রিয়।’ আবার দেশপ্রিয় পার্কে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মমতা বলেন, ‘আজ আমাদের ছোটদের বাংলা ভাষার প্রতি আরও যত্নবান হতে হবে। কমে যাওয়া বাংলার চর্চা বাড়াতে হবে। বাংলা ভাষা সবার মুখে মুখে পৌঁছে দিতে হবে। বাংলা ভাষার প্রতি আরও উৎসাহ জাগাতে হবে।’
এই মহান দিনটি পালিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত শহর বনগাঁর পেট্রাপোল সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে। এখানে দুই দেশের ভাষাপ্রেমিকেরা আলাদাভাবে জড়ো হয়ে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তারপর দুই দেশের ভাষাপ্রেমিকরা যোগ দেন এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। ভারতের পক্ষ থেকে যোগ দিয়েছিলেন বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস এবং পেট্রাপোল সীমান্তের ছয়ঘরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান প্রসেনজিৎ দাসসহ সীমান্তের শত শত মানুষ। অন্যদিকে বেনাপোল সীমান্তে যোগ দেন বাংলাদেশের যশোরের সাংসদসহ অন্যান্য ব্যক্তিরা।
২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় কলকাতার একাডেমি অব ফাইন আর্টস চত্বরের ছাতিমতলায় ভাষা ও চেতনা সমিতি সারা রাত ধরে আয়োজন করে ভাষা উৎসব। এতে যোগ দেন দেশ–বিদেশের শতাধিক শিল্পী। অনুষ্ঠানে নাটক পরিবেশিত হয়। আয়োজন করা হয় নাচ–গান ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের। ভাষা চেতনা সমিতি আয়োজিত এই অনুষ্ঠান এবার ২৪ বছরে পা দিয়েছে।
একুশের ভোরে কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশন গ্রন্থাগার থেকে বের হয় প্রভাতফেরি
একুশের ভোরে কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশন গ্রন্থাগার থেকে বের হয় প্রভাতফেরিছবি: ভাস্কর মুখার্জি
একুশের ভোরে কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশন গ্রন্থাগার থেকে বের হয় প্রভাতফেরি। এতে পা মেলান কলকাতার বিশিষ্টজনেরাও। এরপরই উপহাইকমিশনে নির্মিত শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে দিনের সূচনা হয়। এদিন বাংলাদেশের পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। বিকেলে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এতে যোগ দেন কলকাতার শিল্পীসহ বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধিরা।
কলকাতার ভাষাশহীদ স্মারক সমিতি কলকাতার কার্জন পার্কে অবস্থিত ভাষা উদ্যানের শহীদ স্মারকে সকালে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে দিনটির সূচনা করে। কলকাতার বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম চত্বরে নির্মিত ভাষাশহীদ উদ্যানের শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে সূচনা করা হয় দিনটির।
বিকেলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে দেশপ্রিয় পার্কে আয়োজন করা হয় ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান। কলকাতার রবীন্দ্রভারতী এবং শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনটি সাড়ম্বর পালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আলপনা আঁকেন সড়কে। আয়োজন করা হয় আলোচনা সভা, প্রভাতফেরি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থীরা সকালে প্রভাতফেরি বের করেন। এখানকার শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানান বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীসহ শিক্ষকেরা। এরপর বাংলাদেশ ভবনে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
শান্তিনিকেতনে বিদেশি ছাত্রছাত্রীরাও প্রভাতফেরিতে অংশ নিয়ে খালি পায়ে শহীদবেদিতে পুষ্পমাল্য প্রদান করেন। বাংলাদেশ ভবনের সামনে আলপনা আঁকেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। বিকেলে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
কলকাতার বেলেঘাটা মোড়, মধ্যমগ্রাম চৌমাথায় ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ধাঁচে গড়া শহীদ মিনারেও এদিন শ্রদ্ধা জানান ভাষাপ্রেমিকেরা। এ ছাড়া কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহর এবং গ্রামের স্কুল–কলেজেও দিনটি পালিত হয় যথাযোগ্য মর্যাদায়। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বসিরহাটসহ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন সংগঠন দিনটি পালন করেছে যথাযোগ্য মর্যাদায়।
ভাষাসৈনিক বরকতের গ্রাম মুর্শিদাবাদের বাবলা গ্রামেও দিনটি পালিত হয় সাড়ম্বর। সকালে অনুষ্ঠিত হয় প্রভাতফেরি। বিকেলে আয়োজন করা হয় আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। জানা গেছে, এই গ্রামে যত দিন বরকতের মা বেঁচে ছিলেন, তত দিন তিনি ভাষা দিবসে গ্রামবাসীদের পায়েস রেঁধে খাওয়াতেন। এলাকাবাসী তাঁদের গর্বের ভাষাসৈনিকের স্মরণে এবারও দিনটি পালন করেছেন যথাযোগ্য মর্যাদায়।
এ ছাড়া ত্রিপুরা, বিহার, ঝাড়খন্ড, ওডিশা, ছত্তিশগড়সহ বিভিন্ন রাজ্যের বাংলাভাষী অঞ্চলে দিনটি পালিত হয় আড়ম্বরসহকারে।