সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের টক্কর, অনিশ্চয়তার পথে পাকিস্তান
আন্তর্জাতিক

সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের টক্কর, অনিশ্চয়তার পথে পাকিস্তান

ইমরান খানের পক্ষে সমর্থকদের স্লোগান। ছবিঃ বিবিসি বাংলা

সন্ত্রাসের এক মামলার আসামি হিসাবে পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আজ বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদের একটি বিশেষ আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা এবং তখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয় কি-না, তা নিয়ে সেদেশে এখন টানটান উত্তেজনা।

গত শনিবার এক জনসভায় তার এক ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগীকে আটক করে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে পুলিশ প্রধান এবং একজন নারী বিচারকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন ইমরান খান। খবর: বিবিসি বাংলা

এর পরপরই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযোগ দায়ের করে।

সেই সাথে, বিচারককে হুমকি দেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে – যার জবাব দিতে ইমরান খানকে আগামী ৩১শে অগাস্ট হাইকোর্টে হাজিরা দিতে হবে।

দু’টো অভিযোগই এমন গুরুতর যে ইমরান খান গ্রেপ্তার হতে পারেন। তার নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং তার দল পাকিস্তান তেহরীক-ই-ইনসাফের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ে যেতে পারে।

লাহোরের সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক উমেইর জামাল বলেন, যেসব মামলা হয়েছে তাতে যেকোন সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তাকে আজীবনের জন্য সরকারি কোনও পদে নিষিদ্ধ করা হতে পারে। এমনকি তার দলকে নিষিদ্ধ করা হতে পারে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই মুহূর্তে গ্রেপ্তার বা চরম সেসব পথে পাকিস্তানের বর্তমান কোয়ালিশন সরকার এবং সেনাবাহিনী যাবে কিনা? কারণ, রাস্তায় ইমরানের পক্ষে যে জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে, তাতে গ্রেপ্তার করা হলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ইসলামাবাদে সাংবাদিক পামজা ফিলহানি বলেন, ইমরান খানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের মামলা দেয়া নিয়ে কোয়ালিশন সরকারের মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। সরকারের মধ্যে অনেকে ভয় পাচ্ছেন যে এই মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হলে গণবিক্ষোভ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা সামাল দেওয়া কঠিন হবে, এবং রাজনৈতিকভাবে ইমরান আরও শক্তি অর্জন করবেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে রাস্তায় সমর্থনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

এদিকে কট্টর ধর্মীয় নেতারা নির্বাচনে সাফল্য না পেলেও রাস্তায় লোক জড়ো করে পাকিস্তান সরকারকে সব সময় চাপে রাখেন। ইমরান খান এখন জনমনে আবেগ তৈরির ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছেন বলেও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

এ বছর ১৪ই অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসে দলীয় সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছেন ইমরান খান। ছবিঃ বিবিসি বাংলা

সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ ইমরানের

লন্ডনে সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পাকিস্তান রাজনীতির বিশ্লেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন, এখন পরিস্থিতি যতটা না বিপজ্জনক তার চেয়ে অনেক বেশি ‘বিশৃঙ্খল এবং অনিশ্চিত’।

তিনি বলেন, এই পরিস্থিতির মূলে রয়েছে ইমরান খান এবং সেনা নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব। সুনির্দিষ্টভাবে আমি বলবো ইমরান ও সেনা প্রধানের (জেনারেল কামার রশিদ বাজওয়া) মধ্যে দ্বন্দ্ব।

ইমরান খান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন সেনাবাহিনীই তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে এবং সে কথা গত তিন-চার মাস ধরে জনসমক্ষে খোলাখুলি তিনি বলে বেড়াচ্ছেন। সেই সাথে আমেরিকার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনি বলছেন যে, তাদের কথা মতই সেনা নেতৃত্বের একাংশ একাজ করেছে।

তার যে সহযোগীকে নির্যাতনের অভিযোগ ইমরান তুলেছেন সেই শাহবাজ গিল এ মাসেই এক লাইভ টিভিতে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, তারা যেন তাদের সিনিয়রদের ‘অবৈধ’ নির্দেশ অমান্য করেন।

ইমরান খানের এসব বক্তব্য-বিবৃতি সেনা নেতৃত্ব আর সহ্য করতে রাজি নন বলেই স্পষ্ট হয়ে পড়ছে।

আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সব সময় নিজেরা সরাসরি ক্ষমতায় না থাকলেও তারা সব সময় বলতে গেলে বেশ সহজেই রাজনীতিকদের বাগে রাখতে পেরেছে। অলিখিত সেই প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করছেন ইমরান খান, এবং সেনাবাহিনী কোনওভাবেই তা মানতে পারছে না।

এপ্রিলে ক্ষমতা হারানোর পরও পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিকের মতো ইমরান খানকে সাথে সাথেই বড় কোন বিপদে পড়তে হয়নি।

রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে গেছেন তিনি। জনসভার পর জনসভা করেছেন যেখানে প্রচুর মানুষ হয়েছে। টিভি এবং অন্যান্য মিডিয়াতে নিয়মিত কথা বলতে পেরেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে নিয়মিত বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বলে চলেছেন যে তার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক উমেইর জামাল বলেন, সেনাবাহিনী রাজনীতিতে তাকে জায়গা দিচ্ছিল। কিন্তু যখন তিনি সরাসরি তাদের চ্যালেঞ্জ শুরু করলেন, সেনা নেতৃত্ব মনে করছে ইমরান রেড-লাইন ভাঙছেন। গত বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে তাকে রাশ টানতে বলা হচ্ছিল, কিন্তু ইমরান তা গায়ে মাখেননি। সেনাবাহিনী আর ধৈর্য্য ধরতে রাজি নয় বলে মনে হচ্ছে।

পাকিস্তানে সব সময়ই সেনাবাহিনী তাদের অবাধ্য রাজনীতিকদের শিক্ষা দিতে পুলিশ ও আদালতকে ব্যবহার করেছে। ইমরান খানের বিরুদ্ধেও সেই পুরনো অস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়েছে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট।

গত কয়েক সপ্তাহে তার বেশ ক’জন সহযোগীকে আটক অথবা হেনস্থা করা হয়েছে। ইমরানের সমর্থক বলে পরিচিতি কয়েকজন সাংবাদিকও হেনস্থার শিকার হয়েছেন। টিভিতে তার ভাষণের লাইভ প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী দেশদ্রোহ এবং অবৈধ অস্ত্রের মামলায় পড়েছেন। আর এখন ইমরান খান নিজেও সন্ত্রাস এবং আদালত অবমাননার অভিযোগের চক্করে পড়েছেন।আমার মনে হয় সেনাবাহিনী এখনও চরম কোনও পথ না নিয়ে ভয় দেখিয়ে তাকে নিরস্ত করতে চাইছে।

ইমরান খানের দল পিটিআই-এর একজন নারী কর্মী। ছবিঃ বিবিসি বাংলা

কী ঘটতে পারে

পাকিস্তানে এখন এই আলোচনা জোরেশোরে চলছে যে, ইমরান খান এবং সেনাবাহিনীর মধ্যকার এই বিরোধ আগামী দিনগুলোতে কোন দিকে গড়াতে পারে।

ড. সিদ্দিকা মনে করেন, এটা নির্ভর করছে ইমরান খান আপোষের ইঙ্গিত দিচ্ছেন কি দিচ্ছেন না, তার ওপর।

সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, তিনটি সম্ভাব্য চিত্রের কথা আমি বলতে পারি : এক, ইমরান খানকে আটক করে জেলে পোরা হতে পারে, যেমনটি মিশরে জেনারেল সিসি করেছিলেন মুহাম্মদ মোরসিকে নিয়ে। দুই, ইমরান খান ভয় পেয়ে রণে ভঙ্গ দিতে পারেন। তিন, সামলাতে না পারলে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নিতে পারে, তবে সেটি হবে চরম কোন পরিস্থিতিতে।

তার মতে, যদি সত্যিই ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়, তখনই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আঁচ করা যাবে। আর তখন বোঝা যাবে সেনাবাহিনীর কতটা ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে।

এমকে

Source link

Related posts

আফগানিস্তানে উদ্ধারকারী দল পাঠাতে চায় তুরস্ক

News Desk

তালেবান ঠেকাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছেন আফগান নারীরা

News Desk

টুইটারের স্থগিত অ্যাকাউন্টের জন্য ‘ক্ষমা’ ঘোষণা ইলন মাস্কের

News Desk

Leave a Comment