Image default
আন্তর্জাতিক

ইউক্রেন সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা, আতঙ্ক

কূটনৈতিক আলোচনা, রাজনৈতিক ও সামরিক হুমকি- কোনো কিছুতেই দমছে না রাশিয়া। ইউক্রেন সীমান্তে প্রতিদিন হাজারো সৈন্য জড়ো করছে দেশটি। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে দুই দেশের সীমান্তবাসীরা দিনাতিপাত করছেন আতঙ্ক, হুমকিতে।

কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন, কেউ বাড়ি ছাড়বেন। আর যারা বাড়িতে থেকে যাবেন তার দিনগুলো কাটছে চরম অনিশ্চয়তায়। তারা জানেন না, আদতে কী ঘটতে চলেছে তাদের ভাগ্যে।

যুদ্ধের দামামা বাজছে চারদিকে। এই পরিস্থিতিতে বিবিসি তুলে এনেছে সীমান্তরক্ষী আর সীমান্তে থাকা অসহায় মানুষের কথা।

ইউক্রেন সীমান্ত বরাবর কিছুটা দূরের শহর স্লাভুটিচ। সেখানে ভ্যালেরি এবং গ্যালিনা সালিমভের সাথে কথা হলো। চল্লিশ বছরের দাম্পত্য জীবন তাদের । ভ্যালেরি ইউক্রেনিয়ান এবং গ্যালিনা জাতিতে রুশ।

কাছের শহর চেরনোবিলের পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৯৮৬ সালে বিস্ফোরণের আগে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সেখানে কাজ করতেন। সেই বিপর্যয়ে নিহত ১০০ জনের মধ্যে তাদের অনেক বন্ধু-বান্ধবও ছিলেন।বিস্ফোরণের দিনও গালিনার কাজ ছিল কিন্তু জন্মদিনের কারণে দুর্ঘটনার আগে বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন বলে প্রাণে বেঁচে যান।

চেরনোবিল থেকে সরিয়ে তাদের জায়গা দেওয়া হয়েছিল স্লাভুটিচে।

চেরনোবিল থেকে সরিয়ে আনা লোকজনকে পুনর্বাসনের জন্য তখনকার সোভিয়েত সরকার একটি ‘আদর্শ’ শহর হিসাবে এটি বানিয়েছিল। শহরের প্রতিটি মহল্লায় হয় চমৎকার সব অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং অথবা ছোটো ছোটো ছিমছাম কাঠের তৈরি বাড়ির সারি।

প্রতিটি মহল্লার নামকরণ করা হয় সোভিয়েত বিভিন্ন রিপাবলিকের নামে, যেমন : আর্মেনিয়া কোয়ার্টার, এস্তোনিয়া কোয়ার্টার ইত্যাদি। এখনও সেসব নামই রয়ে গেছে।

শহরের কেন্দ্রে প্রধান স্কয়ারটিতে একটি স্মারক স্তম্ভ রয়েছে – যাতে চেরনোবিলে নিহতদের মুখ খোদাই করা।

কাছেই রয়েছে একটি ম্যুরাল যেটি ১৮৪৫ সালে হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় গুয়ের্নিকায় বোমাবর্ষণের মত বিশ্বের ভয়ানক সব যুদ্ধে নিহত লোকজনের স্মরণে তৈরি করা হয়। লেখা হয়েছে ‘এখান থেকেই আবার শুরু নতুন জীবনের।’

কিন্তু ভ্যালেরি এবং গ্যালিনার কাছে বর্তমানের সংকট তাদের ব্যক্তিগত জীবনকেও সংকটে ফেলেছে। তাদের মেয়ে থাকে রাশিয়ায়। সাথে গ্যালিনার অনেক স্বজন। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি স্বজনদের মধ্যে এই সংকট নিয়ে বাক-বিতণ্ডা, মন কষাকষি হচ্ছে।

ভ্যালরি বলেন, আমি মনে করি এই সংকট একটি সর্বনাশ। এটি আমাদের নিজেদের জীবনও বদলে দিচ্ছে।

তিনি মনে করেন, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে অদূর ভবিষ্যতে সুসম্পর্ক ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।গ্যালিনাও স্বামীর সাথে সহমত হয়ে মাথা নাড়ালেন।

তারপর তিনি যা বললেন তাতে বৃহত্তর রাজনীতি যে সাধারণ মানুষের জন্য কতটা যন্ত্রণা তৈরি করছে তা ফুটে ওঠে ।

তিনি বলেন, ‘সবকিছু এত অবাস্তব মনে হচ্ছে। আমি বিশ্বাসই করতে পারি না যে আমার প্রতিবেশীরা এসে আমার বাড়িঘর ধ্বংস করছে। আমি বিশ্বাস করিনা। অসম্ভব।

গ্যালিনার আশা, একদিন হয়তো ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয় দেশই অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করবে। তখন হয়তো এই বিভেদ দূর হবে।

তবে ইউক্রেনের সীমান্ত এলাকাগুলোতে এখন এত গুজব ছড়িয়ে পড়ছে যে গ্যালিনার এই আশাবাদকে অলীক, অবাস্তব শোনাবে।

ওদিকে সীমান্ত রেখার ওপাশে বরফে আবৃত জঙ্গলের দিকে কড়া নজর রাখছেন ইউক্রেনের সীমান্ত রক্ষীরা। সীমান্তের ওপারে রুশ সৈন্যদের তৎপরতা আঁচ করার চেষ্টা করছেন তারা। এই রক্ষীরা সীমান্তের সেনকিভকা ক্রসিংয়ের পাহারায় রয়েছেন যেখানে ক্রেমলিন একসময় মহাসমারোহে সোভিয়েত বিশ্বের ঐক্য উদযাপন করেছিল। জায়গাটিতে ইউক্রেন, রাশিয়া এবং বেলারুস- এই তিনটি দেশের সীমান্ত এসে মিলেছে।

তিন সীমান্তের ঐ পয়েন্টে ১৯৭৫ সাল সোভিয়েত আমলের নামে একটি সাদা রংয়ের স্মারক স্তম্ভ তৈরি করা হয়। নাম দেওয়া হয় থ্রি সিস্টারস বা তিন বোন। ইউক্রেন এবং বেলারুস তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ।

স্তম্ভটির কাছে বেশ কয়েকটি ট্রাক দাঁড়িয়েছিল। এগুলো এখন দক্ষিণে রাজধানী কিয়েভের দিকে রওয়ানা হবে।

সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল ইউক্রেন সেনা বাহিনীর মেজর সেরগেই খোমেনকোর সাথে। বয়স ২৯। সীমান্ত এলাকার একটি সামরিক পরিবারে তার জন্ম। পূর্ব পুরুষদের অনেকেই সৈন্য ছিলেন।

তিনি বলেন, তার বাবার যৌবনে অর্থাৎ সোভিয়েত জমানায় রাশিয়ার সাথে এমন একটি সংকট তৈরির কথা কোনো ইউক্রেনিয়ান কল্পনাও করেনি। কিন্তু তিনি নিজে যে দেশের সেনাবাহিনীর সদস্য সেই দেশটি ক্রমাগত রাশিয়ার প্রভাব বলয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

পেশাদার একজন সৈনিকের ভাষায় মেজর খোমেনকো বলার চেষ্টা করলেন রাশিয়ার সেনা সমাবেশের কারণে সীমান্ত রক্ষায় তার দায়িত্ব, ভূমিকা বা প্রত্যয়ে কোনো বদল হয়নি।

তিনি বলতে চাইলেন, সীমান্তে এক লাখ রুশ সৈন্য হাজির হয়েছে বলে তিনি এবং তার সহকর্মীরা ভয়ে কুঁকড়ে যেতে রাজি নন।

সীমান্ত বেড়ার কাছে অনেক বাঙ্কার খোঁড়া হয়েছে। বরফের রংয়ের সাথে মিলিয়ে সাদা পোশাকে এই সীমান্ত ক্রসিং এবং আশপাশের এলাকা পাহারা দিচ্ছে রক্ষীরা।

সীমান্তের ওপারে জঙ্গলে রাশিয়া কত শক্তি নিয়ে হাজির হয়েছে এপাশ থেকে ধারণা করা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু ওপাশ থেকে রাশিয়া এই এলাকার ওপর কোনো আক্রমণ শুরু করলে ইউক্রেন যে এখানে বড় কোনো প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করবে, বা পারবে – তা মনে হয়না।

ইতিহাসবিদ টিমোথি স্নাইডার এই অঞ্চলটিকে পূর্ব ইউরোপের ‘ব্লাডল্যান্ডস’ বা ‘রক্তাক্ত ভূমি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। হিটলার ও স্টালিনের সময় এই এলাকায় এক কোটি ৪০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছে।

যদিও যে প্রজন্ম বিংশ শতাব্দীর সেই ভয়াবহ অধ্যায় দেখেছিলেন বা তার পরিণতি ভোগ করেছিলেন তাদের খুব কমই এখন বেঁচে আছেন, কিন্তু এই এলাকায় যে একসময় যেখানে-সেখানে গণকবরে ঠাসা ছিল। সে কথা এই এলাকার ইতিহাসের অংশ। সবার মুখে মুখে এখনও সেই ট্রাজেডির কথা ঘোরে।

এখানকার মানুষ আশা করেছিলেন ১৯৮৯ সালে শীতল যুদ্ধ শেষের পর শান্তির একটি যুগের সূচনা হবে, পূর্ব এবং পশ্চিম একসাথে মিলে তাদের জীবন থেকে ভয়াবহ যুদ্ধ আর সংঘাতের ঝুঁকি দূর করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

 

তথ্য সূত্র :  samakal

Related posts

বন্দুকধারীর গুলিতে রক্তাক্ত কোপেনহেগেন, নিহত ৩

News Desk

আফগান শরণার্থীদের সহায়তায় ৫০ কোটি ডলার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

News Desk

দীর্ঘ ২ মাস পর ভারতে সর্বনিম্ন দৈনিক সংক্রমণ শনাক্ত

News Desk

Leave a Comment