পুতিনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে পশ্চিমা চিন্তা
আন্তর্জাতিক

পুতিনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে পশ্চিমা চিন্তা

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ

ভ্লাদিমির পুতিন গত সপ্তাহে যখন গ্র্যান্ড ক্রেমলিন প্রাসাদে ইউক্রেনের ৪টি অঞ্চলকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে উৎসব করছিলেন তখন প্রাসাদের ভেতরে শুধু তার বন্ধুরাই তার সঙ্গে হাত মেলাননি, কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী এবং শত্রুও সেখানে বসে ছিল। তা উল্লেখ করে প্রতিবেদন ছেপেছে গতকালের ওয়াশিংটন পোস্ট। অনুষ্ঠানটি ছিল রাশিয়ার শক্তি এবং ঐক্যের ছবিকে চিত্রিত করার উৎসব। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার ব্যর্থতার ছায়া ছেয়ে গেছে পুতিনের মুখাবয়বে। শাসক শ্রেণির মধ্যে একটি বড়, নজিরবিহীন ফাটল সৃষ্টি করেছে। কারণ ক্রেমলিন একের পর এক সামরিক ব্যর্থতার দিকে পা দিচ্ছে।

গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন পোস্ট আরেকটি নিবন্ধে উল্লেখ করে- পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে বিশ্ব মাত্র দু’তিন কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছে। গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, পারমাণবিক যুদ্ধের দিকেই যাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইউক্রেনে পারমাণবিক হামলার কথা পুতিন নিছক ঠাট্টার জন্যেই বলছেন না।

পুতিনকে নিয়ে ভাবনা: বিশ্বের চিন্তাবিদেরা এবং পশ্চিমা গোয়েন্দারা আজকের এই পরিস্থিতির জন্যে পুতিনকে নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। পুতিনের ব্যক্তিগত জীবন ও বেড়ে ওঠা নিয়ে তার মনস্তত্ত্ব নিয়ে পশ্চিমারা রীতিমতো গবেষণায় লেগে গেছেন। বিবিসি বাংলা গতকাল পুতিনের ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে এক বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তা মূলত ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি ও পুতিনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়েই।

আঁকাবাঁকা পথে পুতিনের জীবন: অনেক আঁকাবাঁকা পথে হেঁটেছেন পুতিন। দীর্ঘ জীবনের ৭টি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক তাকে আজ এই পথে নিয়ে এসেছে।

১৯৬৪ থেকেই জুডো খেলা শুরু: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবরোধের ক্ষতচিহ্ন বয়ে চলা লেলিনগ্রাদে জন্ম নেন ভøাদিমির পুতিন। স্কুলজীবনে মারপিটে স্বভাবের পুতিন যে কারো সঙ্গেই মারপিটে জড়িয়ে পড়ত, কারণ তার ভেতরে কোনো ভয় ছিল না। একাই গুন্ডাদের গ্যাংয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। শহরের হালকা-পাতলা ছিপছিপে গড়নের সেই ছেলেটির ধারাল স্বভাব তাকে একা চলতেই শেখায়। ১২ বছর বয়সে রাশিয়ান মার্শাল আর্ট ‘সাম্বো’ শেখা শুরু করে। এরপর শেখে জুডো।

পুতিনের ভাবনা জানার চেষ্টায় পশ্চিমারা: দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল স্বভাবের পুতিন ১৮ বছরেই পেয়ে যান জুডো ব্ল্যাক বেল্ট এবং জাতীয় জুনিয়র প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান। তার পুরুষালী ব্যক্তিত্বের ভাবমূর্তি, তার জীবনের বিশ্বাস তাকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসে এবং আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এই উপলব্ধি তাকে বলে দেয়- কোনো লড়াই যখন অবধারিত তখন প্রতিপক্ষকে আগে আঘাত করতে হবে। এমন শক্ত আঘাত হানতে হবে যাতে সে যেন আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে না পারে।

চাকরির খোঁজে কেজিবিতে: মানুষ সাধারণভাবে লেনিনগ্রাদের কেজিবির সদর দপ্তর এড়িয়ে চলত। স্ট্যালিনের যুগে এত মানুষকে এর জিজ্ঞাসাবাদ সেল পার হয়ে গুলাগের শ্রম শিবিরে যেতে হয়েছে যে এ নিয়ে রীতিমতো রসিকতা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল এমন- ‘দ্য বিগ হাউস’ নামে পরিচিত ‘বলশয় ডোম’ নাকি লেলিনগ্রাদের সবচেয়ে উঁচু ভবন, কারণ তার বেজমেন্ট থেকেই সোজা সাইবেরিয়া পর্যন্ত দেখা যায়। ১৬ বছর বয়সে লালগালিচা পাতা সেই ভবনটির অভ্যর্থনা কক্ষে প্রবেশ করেই পুতিন ডেস্কের পেছনে বসা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সেখানে কীভাবে চাকরি পাওয়া যাবে। জবাবে কর্মকর্তা বলেন, সেনাবাহিনীতে কাজের অভিজ্ঞতা অথবা একটি ডিগ্রি থাকতে হবে। পুতিন পাল্টা জানতে চান, কোনো ডিগ্রি হলে সবচেয়ে ভালো হবে। এই প্রশ্নের জবাব ছিল আইন বিষয়ে ডিগ্রি। পুতিন আইনে স্নাতক করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে স্নাতক করার পর কেজিবিতে চাকরি নেন।

একজন গুপ্তচর হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে : রাস্তায় পোড় খাওয়া পুতিনের কাছে কেজিবি ছিল শহরের সবচেয়ে বড় গ্যাং। পার্টির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই এমন মানুষকেও তারা নিরাপত্তা দেয় এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়। একইসঙ্গে প্রভাবশালী হয়েও ওঠে। ছোটবেলায় গুপ্তচরদের নিয়ে সিনেমা দেখতেন তিনি। আর নিজেই বলতেন, একজন গুপ্তচর হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে।

বিক্ষুব্ধ জনতার ঘেরাও: ১৯৮৫ সালে পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে লিয়াজোঁ অফিসে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে নভেম্বরে পূর্ব জার্মানির পতন ঘটে এবং ৫ ডিসেম্বর ড্রেসডেনে কেজিবি ভবন ঘেরাও করে বিক্ষুব্ধ জনতা। সেদিন পুতিন মরিয়া হয়ে রাশিয়ান রেড আর্মির সেনানিবাসে ফোন করে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। তারা অসহায়ভাবে উত্তর দিয়েছিল, মস্কো থেকে আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারছি না। কেন্দ্রে ক্ষমতার হঠাৎ পরিবর্তনে পুতিন সেদিন শিখেছিলেন, বিরোধিতার মুখে দ্রুত জবাব না দিয়ে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্ভাচভ যে ভুল করেছিলেন, কখনোই তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। এ ব্যাপারে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন।

তেলের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি: সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর পুতিন কেজিবি ত্যাগ করেন। কিন্তু দ্রুতই সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের সংস্কারপন্থি মেয়রের সহায়তাকারী হিসেবে কাজ জুটিয়ে ফেলেন। পুতিনের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল জনগণকে সাহায্য করার জন্য তেল এবং ধাতব পদার্থের বিনিময়ে খাদ্যের ব্যবস্থা করা। বাস্তবে কেউ কখনো কোনো খাবার দেখেনি।

রাজনৈতিক প্রভাব একটি পণ্য : উত্তাল নব্বইয়ের দশকে পুতিন শিখে গিয়েছিলেন যে রাজনৈতিক প্রভাব এমন একটি পণ্য যা টাকায় রূপান্তর করা যায় এবং গ্যাংস্টারেরা দরকারের সময় মিত্র হতে পারে। তার চারপাশের সবাই যখন নিজেদের অবস্থান ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছেন, তিনি কেন সেটা করবেন না?

পশ্চিমের প্রতি হতাশ ও ক্ষুব্ধ: ২০০০ সালে পুতিন যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন, তখন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে প্রভাব বলয় সৃষ্টিসহ পশ্চিমের সঙ্গে নিজের মতো করে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু দ্রুতই তিনি হতাশ হয়ে পড়েন, তারপর ক্ষুব্ধ। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে পশ্চিমারা ইচ্ছাকৃতভাবে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন ও অবমাননা করার চেষ্টা করছে।

শক্তিই ক্ষমতার উৎস: পশ্চিমারা তখন ক্ষুব্ধ হয়েছিল, তবে এক বছরের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ‘পুনঃস্থাপন’ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এমনকি মস্কোকে ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। পুতিনের কাছে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে শক্তিই ক্ষমতার উৎস এবং দুর্বল ও অস্থির পশ্চিমারা ফোঁস ফোঁস করবে ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৃঢ় সংকল্পের মুখে পিছিয়ে যাবে।

মস্কোতে বিক্ষোভ: ২০১১ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভ ফুঁসে ওঠে। তখন পুতিন ঘোষণা দেন যে তিনি ২০১২ সালের নির্বাচনে পুনরায় দাঁড়াবেন। এই বিক্ষোভ ‘বোলোতনায়া প্রতিবাদ’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল, কারণ বিক্ষোভকারীরা মস্কোর এই নামের একটি স্কয়ারে জমায়েত হতেন। পুতিনের বিরুদ্ধে সেটি ছিল এখনও পর্যন্ত জনসাধারণের সবচেয়ে ব্যাপক-ভিত্তিক বিরোধিতা। পুতিনের বিশ্বাস ছিল যে, এই সমাবেশগুলো ওয়াশিংটনের প্ররোচনায় শুরু, উৎসাহিত ও পরিচালিত হয়েছিল।

কোভিডের কারণে বিচ্ছিন্নতা: কোভিডের সময় তার সঙ্গে যারাই দেখা করতে যাচ্ছিলেন তাদের প্রথমে পুরো ১৪ দিনের জন্য কঠোর পাহারায় বিচ্ছিন্ন করে রাখা হত। জীবাণুনাশক ‘আল্ট্রাভায়োলেট লাইট’ ও স্প্রে পার হয়ে তার কাছে যেতে হতো। এই সময় জুড়ে পুতিনের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করতে সক্ষম এমন মিত্র ও উপদেষ্টাদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে গিয়েছিল। সে সময় পুতিন সম্ভবত ‘শিখেছেন’ যে তার সমস্ত অনুমান ও বিশ্বাস সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত ছিল। তখনই সম্ভবত ইউক্রেন আক্রমণের বীজ বপণ করা হয়েছিল।

বিকল্প কী: ইউক্রেন তাদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করছে। এমন পরিস্থিতিতে পুতিনের সামনে এখন বিকল্প কী? অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স কলেজের সেন্টার ফর ডিফেন্স স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক ম্যাথিউ সাসেক্স সম্ভাব্য কয়েকটি পথের কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো পুতিন নিতে পারেন। ১. ইউক্রেনে ব্যাপকভাবে সহিংসতা বাড়ানো। ২. মুখ রক্ষার্থে শান্তির কথা বলে বিজয় ঘোষণা।

Source link

Related posts

জেরুজালেমে বোমা বিস্ফোরণে ২ মার্কিন নাগরিক আহত

News Desk

যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইউক্রেনে রুশ সৈন্যের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

News Desk

মমতাকে নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য, গ্রেপ্তার রোদ্দূর রায়

News Desk

Leave a Comment