তিব্বতের হিমালয় অংশে এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘ নদ ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখে চীনে ‘মেগা’ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে একদিকে যেমন পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে, তেমনি বাস্তুচ্যুত হবেন ওই অঞ্চলে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক মানুষ।
গত মার্চে চীনের পার্লামেন্টে ১৪ তম পঞ্চবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনা পেশ করে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি। ওই পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্রে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্পটিও অন্তর্ভূক্ত ছিল। পার্লামেন্টের আইনপ্রণেতাদের ভোটে সেই পরিকল্পনা পাসও হয়েছে।
২০১২ সালে চীনের মধ্যাঞ্চলে ইয়াংজি নদীর ওপর জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে থ্রি গর্জেস বাঁধ নির্মাণ করেছিল দেশটির সরকার, যা বিশ্বে ইতোমধ্যে মেগা ড্যামের স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু হয়েছিল এই বাঁধ নির্মাণের কাজ। চীনের সরকারী সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুযায়ী তিব্বতের মেডং জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর থ্রি গর্জেস বাঁধের আদলে বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
এ বিষয়ে গত বছর অক্টোবরে তিব্বতের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চীনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিষয়ক রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পাওয়ার চায়নার সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকারী সূত্র।
চীনের দীর্ঘতম নদী হিসেবে পরিচিত ইয়াংজিতে বাঁধ নির্মানের পর থেকে প্রতিবছর ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। পাওয়ার চায়না কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ইয়ান ঝিয়ং বলেছেন, ব্রহ্মপুত্র প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এশিয়ার সবচেয়ে উৎপাদনশীল জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে এটি।
এদিকে চীনের এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সিদ্ধান্তে ইতোমধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জ্বলানী ও পরিবেশবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিদ্যুৎ, পানি ও টেকসেই উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ক সংস্থা এবং দেশটির অন্যতম ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’ হিসেবে পরিচিত স্টিমসন সেন্টারের পরিচালক ব্রায়ান এইলার বলেছেন, ‘ওই এলাকায় সুপার ড্যামের আদলে কোনো বাঁধ নির্মাণ করার যে পরিকল্পনা চীন নিয়েছে, সেটি যথেষ্ট বাজে একটি পরিকল্পনা। বহু কারণে এই প্রকল্প থেকে সরে আসা উচিত দেশটির।’
এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘প্রথমত ওই এলাকাটি ভূ-কম্পপ্রবণ অঞ্চল। এছাড়া ওই এলাকার একটি স্বতন্ত্র জীবনধারা ও বাস্তুসংস্থান রয়েছে, যা সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপণ করা হলে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে পড়বে।
ইয়াংজিতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জলধার নির্মাণের জন্য ওই এলাকার ১৪ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল- এ তথ্যও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।
এদিকে ভারতের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, তিব্বতে চীন এই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হলে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হবে। ভারতের দৈনিক পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়ায় দেশটির রাজনীতি বিশ্লেষক ব্রহ্ম শেলানি বলেন, ‘পানির আরেক নাম জীবন। চীন যদি ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ নির্মাণ করে, সেক্ষেত্রে ভাটি অঞ্চলে বসবাসকারী ভারতীয়রা জল সংকটে পড়বেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হবে।’
‘এছাড়া যদি ভূমীকম্প হয়, সেক্ষেত্রে মেগা ড্যামের জলাধারের জল উপচে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি হওয়ারও সম্ভাবানা রয়েছে।’
চীন সরকারের পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে ব্রায়ান এইলার মনে করেন, এখনো এ বিষয়ে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর অবকাশ রয়েছে ভারতের।