শরণার্থী ক্যাম্পের শ্রেণিকক্ষে মিয়ানমারের শিশুরা। ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের আন্তর্জাতিক সীমান্ত বলতে একটা পাহাড়ি নদী, টিয়াউ। এখন ভরা বর্ষায় জলে টইটম্বুর, তবে বছরের অন্য সময় পায়ে হেঁটেই পেরোনো যায় এই ছোট্ট জলধারা।
দুই দেশের মধ্যে এখানে সীমান্ত স্বাভাবিক অবস্থায় একেবারেই শিথিল। দুপারের মানুষের মধ্যে এমনিতে যাতায়াতও বেশ অবাধ- মিয়ানমারের সফট ড্রিঙ্ক বা বিয়ার খুব সহজেই মেলে ভারতের দিকে বাজারে। এমনকী মিয়ানমারে তৈরি মোটরবাইকও সীমান্তের অন্য পারে খুব জনপ্রিয়। খবর বিবিসির।
কিন্তু গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সীমান্তে রীতিমতো কড়াকড়ি চলছে- বর্ডার চেকপোস্ট পেরিয়ে দুদেশের মধ্যে যাতায়াত কাগজে-কলমে অন্তত বন্ধই বলা চলে। তবে তার পরেও হাজারে হাজারে মিয়ানমারের নাগরিক ভারতে ঢুকেই চলেছেন।
আসলে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ফের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই দলে দলে আতঙ্কিত মানুষজন টিয়াউ নদী পেরিয়েই গোপনে মিজোরামে চলে আসছেন, আর সেই আসায় এখনও কোনও বিরাম নেই!
এই শরণার্থীরা মূলত মিয়ানমারের চিন স্টেটের (প্রদেশ) বাসিন্দা, সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতেই তারা ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন বলে বলছেন।
সবশেষ সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মিজোরামে এই শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় ৩১ হাজার, যদিও বিভিন্ন এনজিও বলছে আসলে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। মিয়ানমারে ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিতে সে দেশের পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছিলেন, এমন অন্তত ১৪জন এমপি-ও এই দলে আছেন।
ভারত সরকার তাদের শরণার্থীর মর্যাদা না-দিলেও মিজোরামের রাজ্য সরকার ও স্থানীয় মানুষজন তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে মিজোরামের প্রশাসন, বিভিন্ন এনজিও ও চার্চের সক্রিয় উদ্যোগে রাজ্য জুড়ে তাদের জন্য বহু আশ্রয় শিবির চালু করা হয়েছে।
কেন আর কীভাবে মিয়ানমারের এই নাগরিকরা ভারতে পালিয়ে এসেছেন, মিজোরামে কীভাবেই বা তাদের দিন কাটছে – সরেজমিনে তা দেখতে গিয়েছিলাম মিজোরামের প্রত্যন্ত ও দুর্গম চাম্পাই হিলস এলাকার বেশ কয়েকটি শিবিরে।
শরণার্থীদের কথা
মোয়েত অ্যালো শোয়ে সিন মিয়ানমারের একটি প্রাইমারি স্কুলে বাচ্চাদের ইংরেজি পড়াতেন। বাবাসহ তার পরিবারের বেশ কয়েকজনকে যখন সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়, বাধ্য হয়ে মাসপাঁচেক আগে তিনি ভারতে চলে আসেন।
জোখাওথর শরণার্থী ক্যাম্পের উঠোনে দাঁড়িয়ে তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, পরিবারের বাকিদের ফেলে এভাবে চলে আসাটা মোটেই সহজ ছিল না। ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের ভেতর দিয়ে পুরো দশদিন লেগেছে ভারতে আসতে। দুদিন পথ চলার পরই হয়তো কোথাও সংঘর্ষ বা গন্ডগোল, তখন আবার গা ঢাকা দেওয়া – আবার হয়তো টানা চব্বিশ ঘন্টা পথ চলা, এভাবেই কোনোমতে সীমান্ত পেরিয়েছি আমি।
কিংবা ধরা যাক এস্থারের কথা। চিন স্টেটের এক চাষী পরিবারের গৃহবধূ ছিলেন তিনি, মিয়ানমারের ‘সেপয়াঁ’, অর্থাৎ সিপাইরা যখন তাদের ক্ষেত আর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় তারও ভারতে চলে আসা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তিনটে বাচ্চা মেয়ে আর সবচেয়ে ছোট দুই বছরের কোলের ছেলেকে নিয়ে অন্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিলেই ভারতের দিকে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি।
তার স্বামী কিন্তু সেই দলে আসতে পারেননি, তিনি এখনও মিয়ানমারে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এস্থার মিজোরামে বসে মাঝে মাঝে তার খবর পান, কখনো দু-তিনদিন পর পর, কখনো বা দুই-তিন সপ্তাহ কেটে যায়!
চিন স্টেটে অন্তত দুটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী – চিন ডিফেন্স ফোর্স ও চিন ন্যাশনাল আর্মি সে দেশের সেনা ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালাচ্ছে বহু দিন ধরেই।
গত বছর থেকে দেশটির গণতন্ত্রকামীরাও আর্মির বিরুদ্ধে নিয়মিত বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সেই সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন ও নির্যাতন। তবে চাম্পাইয়ের কাছে জোটে শরণার্থী শিবিরে বছর তিরিশের যুবক কোহ্ কোহ্ বলছিলেন, যে চিন বিদ্রোহীরা মিয়ানমারের সেনার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই ছিল না- তারপরও একদিন আর্মি এসে তাদের পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।
মোবাইলে নিজের দোতলা মাটির বাড়ির ছবি দেখাচ্ছিলেন তিনি, যেটা এখন পুরোপুরি ছাই হয়ে গেছে। মাত্র দুই মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়েছিলেন কোহ্ কোহ্-র স্ত্রী মেরেম, এখন তাদের বাচ্চার বয়স সবে এক বছর।
‘এটা আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার’
মিজোরাম কিন্তু এই হাজার হাজার বহিরাগতকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, নিজেদের সাধ্যমতো তাদের আশ্রয় দিয়েছে – খাবারের ব্যবস্থা করেছে। গত ১০-২০ বছরে মিয়ানমার থেকেই ভারতেরই অন্যত্র বেশ কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও এসেছেন, বিভিন্ন ঝুপড়ি বা অস্থায়ী কলোনি তৈরি করে তারা বিভিন্ন শহরে বা তার আশেপাশে বসবাসও করছেন বহুদিন ধরে।
জম্মু, হায়দ্রাবাদ বা দিল্লিতে এই রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয়দের যে ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব চোখে পড়ে, মিজোরামে এই চিন স্টেটের শরণার্থীদের প্রতি কিন্তু সেই ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলেন, এদের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক, এটা আপনাকে বুঝতে হবে।
ঐতিহাসিক কারণে আমাদের মধ্যে হয়তো সীমান্তর বিভেদ তৈরি হয়েছে, কিন্তু মিজো আর চিনরা আসলে একই জাতিগোষ্ঠীর। মিজো জাতীয়তাবাদের নায়ক ও একদা গেরিলা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া জোরামথাঙ্গা আরও বলেন, আমার নিজের মা ও তার বোন ভারতের দিকেই জন্মেছেন ও মারা গেছেন। অন্য দিকে তাদের দুই ভাই, অর্থাৎ আমার দুই মামা – তাদের জন্ম ও মৃত্যু কিন্তু মিয়ানমারে।
তিনি বলেন, কাজেই আমরা একই পরিবার, শুধু সীমান্তের দুদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। আজ পরিবারের কিছু সদস্য ওদিকে বিপদে পড়েছেন, ফলে তাদের তো আমাদেরই সাহায্য করতে হবে, তাই না? এটা একান্তভাবেই আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার।
রাজ্যের শাসক দল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক এমপি ভ্যান লালজাওমাও বলছিলেন, মিজোরাম এদের আশ্রয় দিয়েছে, কারণ আমরা একই ক্ল্যানের, মিজো আর চিন-রা একই এথনিসিটির।
ব্রিটিশরা ভাগ করার আগে আমরা সবাই একই ভুখণ্ডে ছিলাম, আজ যেটা মিজোরাম, মিয়ানমারে যেটা চিন হিলস ও এখন যেটা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম- এগুলোর সব জায়গাতেই আমরা থাকতাম।
কিন্তু এরা তো সবাই আমাদেরই ভাইবোন… এখন বিপদে পড়েছে, ওখানে ওদের পক্ষে থাকা খুব সমস্যা- তো আমরা কেন আশ্রয় দেব না বলুন তো?, পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি। পাশেই বসে ছিলেন মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের মহিলা শাখার প্রেসিডেন্ট কে লালরেংপুই, যার নিজেরই জন্ম মিয়ানমারের দিকে একটি গ্রামে। তিনিও জানালেন, তার জন্মস্থানের গ্রাম আর নদীর পার থেকেও শত শত মানুষ গত কয়েক মাসে মিজোরামে এসেছেন। তাদের সংগঠন সেই সব মানুষের খাওয়া-পরার ও থাকার ব্যবস্থা করেছে।
মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদর দপ্তর ‘মিজো নাম রুনে’র যে কক্ষে বসে ভ্যান লালজাওমার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, সেই ঘরেই তিনি দুদিন আগে মিয়ানমারের জনাচারেক এমপির সঙ্গে বসে বৈঠক করেছেন বলে জানালেন।
মিয়ানমার থেকে এখনও কত লোক আসছেন, কোন রুটে আসছেন এবং কোন কোন শিবিরে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে, সে সব নিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বস্তুত মিয়ানমার থেকে আসা কাউকেই মিজোরাম ফেরাচ্ছে না।
মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গাও যেমনটা বলছিলেন, নিজেদের লোক বলেই শুধু নয়, মানবিক কারণেই মিজোরাম এদের পুশ ব্যাক করতে পারবে না। এমনকী, আমি তো বলব রোহিঙ্গাদেরও ভারতের ফেরানো উচিৎ নয়।
রিফিউজি ক্যাম্পের জীবন
ইন্দো-মিয়ানমার সীমান্তের বেশ কাছে চাম্পাই শহরের অদূরে জোটে গ্রামে এই শরণার্থীদের জন্য তৈরি হয়েছে একটি শিবির। গোটা রাজ্য জুড়ে এরকম শ’ দেড়েকেরও বেশি শিবির স্থাপন করা হয়েছে। জোটে শিবিরে রয়েছেন মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় শ’ পাঁচেক লোক। সেখানে পাহাড়ে ঘেরা সবুজ উপত্যকার কোলে তৈরি হচ্ছিল একটি টেকনিক্যাল স্কুল, সেই অসমাপ্ত ভবন আর হোস্টেল বিল্ডিংগুলোতেই এখন তাদের ঠাঁই হয়েছে।
এই শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে রোজ এখন রান্না হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের, এমনকী ক্লাস ফোর পর্যন্ত বাচ্চাদের লেখাপড়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকে যাচ্ছে সরকারি স্কুলেও। জোটে ক্যাম্পে ঢুকতেই সামনের অস্থায়ী স্কুল বিল্ডিং থেকে ভেসে আসছে মিয়ানমারের বাচ্চাদের জোরে জোরে আর সুর করে এ বি সি ডি পড়ার আওয়াজ। শরণার্থী শিক্ষিকারাই তাদের পড়াচ্ছেন, আছেন স্থানীয় মিজোরাও।
মিয়ানমার সীমান্তে জোখাওথর সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষক রবার্ট জোরেমলুয়েঙ্গা বলছিলেন, এখন আমাদের ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেকেরও বেশি মিয়ানমার থেকে আসা। তিনি বলেন, তারা এদেশের পড়াশুনোর সিস্টেমের সঙ্গে অভ্যস্ত নয়, হিন্দিটা একেবারেই জানে না – তবু তারা যাতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে তার জন্য আমরা শিক্ষকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
শরণার্থী কিশোর আর যুবকরা দিনের অনেকটা সময় মেতে থাকে সেপাক-টাকরো খেলাতেও – যে অভিনব খেলাটায় আছে কিছুটা ভলিবল, আর কিছুটা ফুটবলের মিশেল। মিয়ানমারে জনপ্রিয় এই খেলাটির সঙ্গে মিজোরামের তেমন পরিচয় ছিল না, ইদানীং শরণার্থীদের সুবাদে তাদেরও আগ্রহ বাড়ছে সেপাক-টাকরোতে।
এদিকে বিকেলের আলো ঢলতেই জোটে ক্যাম্পের কমিউনিটি কিচেনে বড় বড় ডেকচিতে ডাল আর ভাত রান্না বসানো হতে থাকে। এর পাশাপাশি আলাদা করে প্রতিটা পরিবারের নারীরা নিজেদের মতো আলাদা করেও রান্না বসান, জঙ্গলের কাঠকুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে কেউ হয়তো একটু আলু বা ডিম ভেজে নেন।
কেউ আবার বানান নানা শাকসব্জি দিয়ে একটা ভেজিটেবল স্যুপ, যাকে মিজোরামে বলে ‘বাই’। পাশাপাশি চলতে থাকা মাথার মালিশ করানো, বাঁশ দিয়ে ঝুড়ি বানানো কিংবা এক চিলতে ছোট্ট বাগানে লাগানো টমেটো গাছের পরিচর্যা। ভিনদেশেও রোজকার জীবনযাপন থেমে নেই।
চাম্পাই হিলসের সবুজ উপত্যকায় নতুন ঠিকানায় এভাবেই শুরু হয়েছে একদল শরণার্থীর নতুন জীবনসংগ্রাম – আর সেটা সম্ভব হয়েছে স্থানীয় মিজোদের সহযোগিতাতেই।
এভাবে কতদিন টানা যাবে?
খ্রিষ্টান অধ্যুষিত মিজোরামে চার্চের সংগঠন খুবই শক্তিশালী, তারা এই শরণার্থীদের মুখে খাবার তুলে দিতে খুব সাহায্য করছে। স্যালভেশন আর্মি বা মেডস্যঁ স্য ফ্রন্টিয়ারের মতো বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও শিবিরগুলোতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
আইজলের চানমারি চার্চে প্রার্থনা গানের মহড়া দিতে ব্যস্ত কিশোর-কিশোরীরাও একসুরে বলছিল এই শরণার্থীরা মিজোরামে সব সময় স্বাগত, তাদের জন্য মিজোদের সব সময় সহানুভূতি থাকবে।
চার্চ কয়্যারের লিড সিঙ্গার ডেভিড তো সোজাসুজিই বলেন, জেনে রাখুন মিজোরা কখনো তাদের খাওয়াতে দ্বিধা করবে না – দেড় বছর হয়ে গেছে, দরকার হলে যতদিন দরকার হবে ততদিনই তাদের মুখে আমরা খাবার তুলে দেব। পাশ থেকে এমিলি ও তার বন্ধু এলিজাবেথও যোগ করেন, এরাও তো প্রত্যেকেই মানুষ, আর ঈশ্বরের চোখে সব মানুষই তো সমান। মিজোরামের বৃহত্তম এনজিও ইয়ং মিজো অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমএ এই শিবিরগুলো চালাতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে, হাজার হাজার মানুষের জন্য এতগুলো শিবির চালাতে যে বিপুল লোকবল দরকার তার বেশিটাই জোগাচ্ছে এই সংগঠনের কর্মীরা।
কিন্তু কতদিন এটা টানা যাবে, সেটা তাদেরও বেশ দুশ্চিন্তায় রেখেছে।
চাম্পাই জেলায় ওই এনজিও-র প্রধান সংগঠক লালছুয়ানোমা বলছিলেন, আমাদের কাছে শরণার্থীদের সাহায্য করার মতো নিজস্ব কোনও অর্থ নেই, আমরা পুরোপুরি মানুষের দানের ওপর নির্ভর করে চলছি। আর মিজোরাম অর্থ দিয়ে, বস্ত্র দিয়ে, খাবার দিয়ে যেভাবে সাহায্য করছেন তা ভাবাই যায় না – তারা দিচ্ছেন বলেই এতদিন এই শিবিরগুলো চলতে পারছে। কিন্তু আমরা সত্যিই জানি না সামনে কী হবে, বেশ অনিশ্চয়তার সুর শোনা যায় তার গলায়।
শরণার্থীর স্বীকৃতি কেন নয়
আর একটা বড় সমস্যা হল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মিয়ানমারের এই নাগরিকদের শরণার্থী বলেই স্বীকৃতি দিচ্ছে না- ফলে পুরো দায়িত্বটা এসে পড়েছে মিজোরামের কাঁধে।
মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলেন, আমি তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে একাধিকবার বলেছি এই মানুষগুলোকে আমাদের মানবিক সাহায্যটুকু করা দরকার। যখনই দিল্লির কোনও ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে তাদেরও একই কথা বলছি।
তিনি অবশ্য এটাও মানেন, আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের এই নাগরিকদের শরণার্থীর মর্যাদা দিতে ভারত সরকারের কিছু সমস্যা বা বাধ্যবাধকতা আছে।
কিন্তু তাই বলে আমরা তাদের মাথার ওপর একটু ছাদ কিংবা মুখে একটু খাবার কেন তুলে দিতে পারব না? এটুকু মানবিক আচরণ তো যে কোনো সভ্যতার কাছেই প্রত্যাশিত। আমরা জাতিসংঘের শরণার্থী সনদে সই করি বা না করি, এটুকু তো করতেই পারি – তাই না?, দিল্লির ভূমিকাকে ঈষৎ কটাক্ষ করেই মন্তব্য করেন জোরামথাঙ্গা।
তবু ঘটনা হল, এই তিরিশ-বত্রিশ হাজার শরণার্থীর জন্য ভারত সরকার আজ পর্যন্ত একটি পয়সাও খরচ করেনি। শরণার্থী শিবিরগুলোর আশেপাশে জাতিসংঘের কর্মকর্তাদেরও ঘেঁষতে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
ফলে এই সব ক্যাম্পের বাসিন্দারা ভারত সরকার বা জাতিসংঘের কাছ থেকে বা শরণার্থী হিসেবে আজ পর্যন্ত কোনো পরিচয়পত্র পাননি।
মিজোরাম সরকার শুধু তাদের একটি সাময়িক পরিচয়পত্র দিয়েছে, যাতে অবশ্য কোনও সরকারি সুযোগ-সুবিধার গ্যারান্টি নেই। তাতে শুধু নাম আর ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের অমুক নাগরিক অস্থায়ীভাবে মিজোরামে বসবাস করছেন।
আইজল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জে. ডাউঙ্গেল বলেন, এই মানুষগুলোকে শরণার্থীর স্বীকৃতি দিতে দিল্লির আসলে ‘প্রবল কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসুবিধা’ আছে। তার কথায়, ভারত এতদিনে উপলব্ধি করেছে যে মিয়ানমারকে বয়কট করে কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে তাদের কোনও লাভ হবে না।
উল্টে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট বা কালাদান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো যে সব প্রকল্পে ভারতের শত শত কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে, সেগুলো আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এদিকে চীন যেহেতু মিয়ানমারের রাখাইন পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। ফলে মিয়ানমারে গণতন্ত্রই থাক বা সামরিক শাসন, নিরাপত্তার স্বার্থেই ভারতের কিছুতেই মিয়ানমারকে চটানো চলবে না, মন্তব্য করেন জে ডাউঙ্গেল।
‘বার্মার ঘাস বেশি সবুজ’
মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আসা অনেকেই যেমন রাখাইনে ফেরার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, চিন স্টেটের এই বাসিন্দারা কিন্তু এখনই হাল ছাড়তে রাজি নন – বরং তারা দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখেন রোজই।
মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা যেমন মনে করেন, উর্বর ও সম্পদশালী মিয়ানমার ছেড়ে এই শরণার্থীরা পাকাপাকিভাবে মিজোরামে থেকে যেতে চাইবেন, এমনটা ভাবার কোনও কারণই নেই। তার কথায়, ওখানকার ঘাস অনেক বেশি সবুজ। বার্মায় ক্ষেত উপছে ধান হয়, মাটি খুঁড়লে কখনো স্বর্ণ, কখনো বা মূল্যবান মণিরত্ন পর্যন্ত পাওয়া যায়। ওখানে তাদের অনেক জামি-বাড়ি-সম্পত্তিও পড়ে আছে।
চিন স্টেটের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে আমি দেখেছি একটু পর পর ঢিবির মতো কী সব খোঁড়া। জিজ্ঞেস করে জানলাম, গ্রামবাসীরা না কি ওই ঢিবি খুঁড়ে পেট্রোলিয়াম তোলেন। তো সেই সোনার দেশ ছেড়ে কেন তারা আসতে বাধ্য হচ্ছেন সেটাই একবার ভাবুন, বলছিলেন তিনি।
জোরামথাঙ্গার দৃঢ় বিশ্বাস, মিয়ানমারের পরিস্থিতি একটু স্থিতিশীল হলে বা সেনা অভিযানে একটু ঢিলে পড়লেই এই শরণার্থীরা অনেকেই দেশের পথে পা বাড়াবেন। তবে কবে সেটা ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে তাঁরও কোনও আন্দাজ নেই।
জোখাওথর ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে শরণার্থী শোয়ে সিন তো বলেই ফেলেন, এখন ফিরে যেতে ভয় করছে ঠিকই- কিন্তু মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরলেই আমি ঠিক আবার দেশে চলে যাব, মিলিয়ে নেবেন!
এখনই তার ‘হোমসিক লাগছে’… বাড়ির জন্য মন কেমন করছে … নিজের লোকজন, নিজের ভাষা, প্রিয় খাবার-দাবার সবকিছুই ভীষণ মিস করছেন! মিজো ভাইবোনদের অভ্যর্থনায় আপ্লুত হলেও মিয়ানমারকে তিনি ভুলতে পারছেন কই?
ডি- এইচএ