ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অবিশ্বাসের জায়গাটি হল ইতিহাস স্থান, কাল, পাত্রভেদে আলাদা আলাদা হয় অথচ ইতিহাস হওয়ার কথা ছিল সূর্যের মত ধ্রুব সত্য। একই ইতিহাস পড়ে, দুটো প্রজন্ম দুরকম ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে। এটাই করুন বাস্তবতা।
পাকিস্তানে মোটা দাগে সবাই জানে ভারতের চক্রান্তে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে যায়। যদিও পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজ তাদের একাত্তরের ঘৃণিত কাজের জন্য সরকারকে ক্ষমা চাইতে প্রায়শই বলেছে। তবু বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশ এর মানুষকে বেঈমান জাতি হিসেবেই জেনে বড় হচ্ছে। এর কারণ বিস্তর। নিজেদের হাতে মন গড়া ইতিহাস কখনো সত্য ধারণা দেয় না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেকটাই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত।
বর্তমান প্রজন্মকে পাকিস্তান কি শিক্ষা দিচ্ছে ১৯৭১ সম্পর্কে?
পাঠ্যপুস্তক সাধারণ নাগরিক সবাই পড়ে। এ থেকেই তাদের কোমলপ্রাণ এ এক ভুল ইতিহাসের বীজ বপন করে দিচ্ছে। তার নমুনা
পঞ্চম শ্রেণি:
— ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর ভারত পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের সহযোগিতায় সেখানকার অধিবাসীদের পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে। পরে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে। ভারতের ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তান পৃথক হয়ে যায়।
নবম-দশম শ্রেণি:
— পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহু সংখ্যক হিন্দু শিক্ষক কর্মরত ছিলেন। হিন্দু শিক্ষকেরা বাঙালিদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে।
— পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় এক কোটি হিন্দু বাস করত। ভারত তাদের স্বার্থ বাস্তবায়নে এই হিন্দুদেরকে ব্যবহার করে। ভারত পূর্ব পাকিস্তান পৃথক করতে চেয়েছিল। অনেক হিন্দুই ভারতের চর হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তান আমেরিকাকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেওয়ায় রাশিয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল। ফলে রাশিয়া ভারতের সামরিক আগ্রাসনে সমর্থন দেয়। অন্যদিকে আমেরিকাও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা চেয়েছিল।
— আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের পতন হয়।
উচ্চ মাধ্যমিক:
— মার্শাল ল কর্তৃপক্ষ পুর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অভিযানে জামায়াতে ইসলামী সশস্ত্র সেচ্ছাসেবক দিয়ে অংশগ্রহণ করে। সামরিক অভিযানের মুখে আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী ভারতে পালিয়ে যায় এবং শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। ভারত তাদেরকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণ করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ডিসেম্বর ৩, ১৯৭১ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। স্থানীয় জনগণের সমর্থনের অভাব, সামরিক বাহিনী ও সরঞ্জামাদি সরবরাহের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে পাকিস্তানের সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্নসমর্পণে বাধ্য হয়।
— ১৯৭১ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সাহসিকতার এক নতুন রেকর্ড স্থাপন করে।
আরেকটা ঘটনা বলি, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের কথা, উনি পাকিস্তানের জঙ্গি বিমান টি-৩৩ ছিনতাই করে যেখানে পাইলট হিসেবে রশীদ মিনহাজ ছিলেন। প্রশিক্ষক হিসেবে মতিউর এই বিমানে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। তারপর দুজনের ধ্বস্তাধস্তিতে পাকিস্তানের থাট্টা এলাকায় যা ভারত থেকে ৩৫ মাইল দূরে, বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। দুজনেই মারা যায়। একজনের লাশ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কবরস্থানে দাফন করে এবং লিখা থাকে এখানে শুয়ে আছে এক বেঈমান (অনুবাদ).
আর রশীদমিনহাজ কে সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান দেয়া হয়।
এখন বুঝতেই পারছেন কি জেনে বড় হচ্ছে। ২০০৬ সালে ২৩ শে জুন এই মহান বীর মতিউর তার স্বদেশে ফিরে আসেন। মিরপুরে সমাহিত করা হয়।
তথ্য সূত্র: প্রথমআলো, কোয়ারা।