কোনো অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই স্বপ্রণোদিত হয়ে শুধুমাত্র পার্শ্ববর্তী দেশের যুদ্ধাক্রান্ত অবস্থা বিশ্ব বাসীর সামনে তুলে ধরতে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন ভারতীয় ফটোসাংবাদিক কিশোর পারেখ। কিশোর পারেখ (১৯৩০-১৯৮২) একজন ভারতীয় ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের নানা দেশের নামী-দামী পত্র-পত্রিকার সাংবাদিক ও ফটো সাংবাদিক অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এদের মধ্যে পারেখ ছিলেন ব্যতিক্রম যিনি কোন অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন। মাত্র ৮ দিনে তাঁর তোলা ৬৭টি ছবি মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে। এ ছবিগুলো অবলম্বন করে পরে তিনি বাংলাদেশ : এ ব্রুটাল বার্থ নামে একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করেন। ভারত সরকার তাঁর ছবি দেখে বইটির ২০ হাজার কপি অর্ডার দেন।
কিশোর পারেখের জন্ম ভারতের গুজরাটের ভাবনগর জেলায়। ছোটবেলা থেকেই সিনেমার পোকা ছিলেন। সিনেমার রূপালী জগৎ নয়, বরং তার পেছনে ক্যামেরার কারুকাজ মুগ্ধ করতো তাকে। তাই লেখাপড়ার বিষয় ঠিক করে নিলেন সেই সিনেমাই। উড়ে গেলেন হলিউডে। ফিল্ম মেকিং অ্যান্ড ডকুমেন্ট্রি ফটোগ্রাফি বিষয়ে পড়াশোনা করেন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াতে। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি কাজের মাধ্যমে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, জিতেছিলেন বেশ কিছু পুরষ্কার। একজন বেসামরিক লোক হয়ে ছবি তোলা তার জন্য বেশ বিপজ্জনক ছিল। তাই কোনো একভাবে জোগাড় করে নিলেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পোষাক। তারপর আটদিন সারেজমিনে ভ্রমণ করে তুলে আনলেন মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য সাতষট্টিটি ছবি। সেই ছবিগুলো প্রকাশ করেন ’বাংলাদেশ: আ ব্রুটাল বার্থ’বইয়ে, ১৯৭২ সালে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জনমত গঠনের জন্য ভারত সরকারের সহায়তায় ২০ হাজার কপি ছাপা হয় বইটি। বাংলাদেশ ফটোবুক আর্কাইভের সৌজন্যে বইটির ভিডিও সংস্করণ দেখা যাবে এখানে।
“কিশোর পারেখের জন্য বাংলাদেশের যুদ্ধাবস্থা কভার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নেই, নিজের পয়সা খরচ করে শুধুমাত্র নিজের আবেগ, প্রেরণা আর সাহসকে পুঁজি করে তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। দুই সপ্তাহে তিনি তুলে এনেছিলেন চমৎকার সব ছবি যেগুলো দিয়ে তৈরী করে করেছিলেন তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই বইটি, যেখানের হৃদয়গ্রাহী ছবিগুলোর সাথে তিনি জুড়ে দিয়েছিলেন খুবই শক্তিশালী কিছু শব্দ।” পারেখের স্বদেশী আরেক বিখ্যাত আলোকচিত্রী পাবলো বার্থেলমেও এভাবেই মূল্যায়ন করেন পারেখের কাজ। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পোষাকে একবার ধরা পড়েন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে। পরে অবশ্য তিনি বোঝাতে সক্ষম হন, আদতে তিনি একজন ভারতীয় এবং আলোকচিত্রী- শুধুমাত্র নিরাপত্তার জন্যই এই পোষাক। ভারতীয় সেনাবাহিনী কথা যখন আসলোই, এখন আমরা দেখে নেব বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত একটি ছবি।
এ ছবিটি কিশোর পরেখেরই তোলা। ছবিটির ক্যাপশনে কিশোর পারেখ তার বইতে লিখেছেন – Indian troops grimly round up villagers suspected to be Pakistani spies. Ther peer into lungis in search of weapons. অর্থাৎ, মিত্রবাহিনীর সেনারা পাকিস্তানী চর সন্দেহে তাদের শরীরে তল্লাশী চালাচ্ছে এবং দেখে নিচ্ছে তারা লুঙ্গির ভেতর কোনো অস্ত্র বহন করছে কিনা। আমাদের প্রচলিত ইতিহাসের বয়ানে এটি সাংঘর্ষিক। সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার গণহত্যা সংখ্যায় অধ্যাপক গোলাম জিলানী নজরে মোরশেদ ছবির সৈনিককে পাকিস্তানী বলে আখ্যা দেন। তারপর বহু বছর ধরে তেমনটিই প্রচারিত হয়েছে।
আমাদের সে ভুল ভাঙান যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক, নয়নিকা মুখার্জী। ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং প্রমাণ করেন, ছবির সেনা সদস্য আদতে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর। কিশোর পারেখের ছেলে স্বপন পারেখও নিশ্চিত করেছেন বিষয়টি। ২০০০ সালে দৃক গ্যালারীতে আয়োজন করা হয় এক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘১৯৭১: দি ওয়ার উই ফরগট’ শিরোনামে। সেখানে দেশি-বিদেশি অনেক ফটোগ্রাফারের সাথে স্থান পায় কিশোর পারেখের কিছু ছবি। সে-ই হয়তো কিশোর পারেখকে দেওয়া আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান। অথচ প্রতিবছরই নানান সময়ে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক আলাপে আমাদের প্রিন্ট, টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেট মিডিয়া অহরহ ব্যবহার করে চলেছে তার ছবি। কিন্তু মহান এই আলোকচিত্রীকে কৃতজ্ঞতার প্রদর্শনের ন্যূনতম সৌজন্যতার প্রকাশ করে না কেউ। আমরা হয়তো তাকে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা জানাতে পারতাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জীবদ্দশায় কিংবা মরণোত্তর কোনো সম্মাননা পাননি এই ক্যামেরাযোদ্ধা।
বাংলাদেশঃ এ ব্রুটাল বার্থ এর কথাঃ
২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে কিশোরের মৃত্যুর ৩৩ বছর পর দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর দি আর্টস (IGNCA) এ নজর ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে কিশোর পারেখ এর ছবি বাংলাদেশঃ এ ব্রুটাল বার্থ ভারতে প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়। সে সময় কিশোর পুত্র স্বপন পারেখ এর সাথে কথা হয় সাংবাদিকদের সাথে। পেশায় স্বপন নিজেও ফটো সাংবাদিক। তাদের পরিবারের কাছে বাংলাদেশঃ এ ব্রুটাল বার্থ এর দুই কপি ছিলো। সেখান থেকে একটি প্রদর্শিত হয় এক্সিবিশনে। স্বপন এর স্মৃতিচারণের বিশেষ অংশ তুলে দিচ্ছি এখানে।
আমার মনে আছে আমরা তখন হংকং এ ছিলাম। আমার বয়স তখন ছিলো ৫ বছর। সপ্তাহান্তে আমরা সাধারণত সমুদ্র সৈকতে যেতাম। বাবা সেখানে মাঝে মাঝে ছবি আঁকতেন। এমন একদিন বাবাকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো। তিনি বললেন, “MY COUNTRY IS BURNING AND HERE I AM DOING THIS.” সে সময় আমরা চার ভাইবোন আর মা। তাছাড়া তিনি তিনটি ম্যাগাজিন এর এডিটর ছিলেন। সব ছেড়ে তিনি বোম্বে চলে যান। সেখান থেকে কোলকাতা। কোলকাতায় জোর জবরদস্তি করে এক বন্ধুকে বাধ্য করেন তাকে সীমান্তে গাড়ি করে রেখে আসতে। ওপার থেকে তখন বেসামরিক কারো পক্ষে এপারে আসা কঠিন ছিলো। হঠাৎ তিনি দেখেন অফিসিয়াল প্রেস ফটোগ্রাফার দের নিয়ে একটি আর্মি হেলিকপ্টার ঢাকা যাচ্ছে। যেহেতু বাবার কোন ক্লিয়ারেন্স বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিলো না তাই দায়িত্বরত মেজর বাবাকে হেলিকপ্টারে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
তখন বাবা মেজর কে বলেন, “SHOOT ME HERE RIGHT NOW OR TAKE ME.” বাবা যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে গিয়ে উপস্থিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যাতায়াতের জন্য বাবাকে একটি জিপ দেয়। ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্থানি দের আত্মসমর্পণ পর্যন্ত বাবা ৫ দিন ছবি তোলেন। এরপর আরো কয়েকদিন সেখানে ছিলেন। আর বাকি ছবিগুলো তখনই তোলা হয়। এরপর বাবা সরাসরি হংকং চলে আসেন, ফিল্ম প্রসেস করেন, বই হিসাবে বের করার জন্য চুক্তি করেন। মা বলেছিলেন বাবা এমনকি হংকং এ এসে প্রথমে বাসায় আসেন নি, সরাসরি স্টুডিও তে চলে যান। এই সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই বাবার ওজন বেশ কমে যায়। বাবা কিছুই খেতে পারতেন না।
তিনি বলতেন, “ALL I CAN SMELL IS ROTTEN FLESH…” ডামি ফটো বুক নিয়ে বাবা ভারতে গিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে করেন। ওরা ইংরেজি ও ফরাসি তে ২০,০০০ কপি বইয়ের অর্ডার দেয়। সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে সব কাজ হয়ে গেলো। জানুয়ারির মধ্যেই বই বেরিয়ে গেলো। বাংলাদেশঃ এ ব্রুটাল বার্থ বইটি উৎসর্গ করা হয় FOR THOSE WHO SUFFERED বইটির ছবি, ক্যাপশন সব কিশোর এর নিজের। বইটির প্রারম্ভিকা লিখে দেন S. MULGAOKAR. হংকং এর ইমেজ ফটোগ্রাফিক সার্ভিস থেকে |
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া , রোয়ারমিডিয়া, বিডি-প্রতিদিন, কিশোর-বাংলা