পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার বুকে অভিজাত্যের প্রতীক ছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। ঢাকার বুকে চোখধাঁধানো এক পাশ্চাত্যের জৌলুস।একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে বিশ্বের কাছে প্রচার করতে এই হোটেলকেই ব্যবহার করতে চেয়েছিল পাকিস্তানের জান্তা সরকার। সারা পৃথিবীর সাংবাদিক, শিল্পী, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিদের ভিড় লেগে আছে হামেশাই। পূর্ববাংলায় আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনার কেন্দ্র বললেও ভুল বলা হবে না। বাংলার বিদ্রোহ ও সংগ্রামকে বিশ্বের সামনে আনতে প্রয়োজন এরকম একটা জায়গাতে আক্রমণ।
জুন মাসের ৯ তারিখ বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি আসলে পরপর তিনটি গ্রেনেড ছুড়ে জানান দিলো নিজেদের অস্তিত্ব। দ্বিতীয় দফায় বিস্তৃতভাবে আক্রমণ চালানো হয় ১১ আগস্ট বিকেলে। হোটেলের বাথরুমে ২৮ পাউন্ড প্লাস্টিকের বিস্ফোরণে নড়ে উঠে গোটা ভবন।
গল্পের নায়ক সামাদ ও বকর অনেক আগে থেকেই যে প্ল্যান করে ঢুকেছিলেন ভেতরে। সাথে ছিল মায়া, আলম, জিয়াউদ্দীনসহ আরো কয়েকজন। বিস্ফোরণে ভেঙে পড়লো ভেতর এবং লাউঞ্জে লাগানো দরজা। টুকরো টুকরো হয়ে গেলো লাউঞ্জ এবং আশেপাশের কাচ। আহত বেশ কয়েকজন। পরের দিনই আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা সচিত্র প্রকাশিত হলো গুরুত্বের সাথে। অর্থাৎ মিশন সফল। এমন অনেক রোমাঞ্চকর গল্পের জন্ম দিয়েছে গেরিলারা। ঢাকার একঝাঁক মেধাবী আর দুঃসাহসী ছেলে নিয়ে গঠিত এই গেরিলা দলের নাম ‘ক্র্যাক প্লাটুন’।
ক্র্যাক প্লাটুন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঢাকাশহরে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত দল, যাঁরা তৎকালীন সময় একটি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। এই গেরিলা দলটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে “হিট এন্ড রান” পদ্ধতিতে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার করেন।
ক্র্যাক প্লাটুনের নামকরণ
১৯৭১ সাল। পাকিস্তান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী বলে প্রচার করে যাচ্ছে রাত-দিন। বহির্বিশ্ব কোনোভাবেই যেন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম টের না পায়। ঢাকা ছিল বাড়তি নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টিত। মুক্তিযুদ্ধে ২নং সেক্টর এবং কে ফোর্সের প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিলেন। অন্তত পাক সরকারের এই মিথ্যাচার সমগ্র বিশ্বের জানা দরকার। দেশে বা বিদেশের বাঙালিরা এবং বাঙালির মিত্ররা যেন যুদ্ধটাকে সমগ্র বাঙালির লড়াই বলেই গণ্য করে। আর তাই প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ও মেধাবী তরুণদের নিয়ে তৈরি করলেন এক দুর্ধর্ষ গেরিলা দল। তাকে সহযোগিতা করেছেন এটিএম হায়দার। এটিএম হায়দারের নেতৃত্বেই ভারতের মেঘালয়ে ‘মেলাঘর’ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয় দলটি। গ্রেনেড ছোড়া থেকে শুরু করে ঝটিকা আক্রমণ, অতর্কিত ত্রাস সৃষ্টি করা এবং ‘হিট এন্ড রান’। আরবান গেরিলা যুদ্ধের সব কৌশলই ভালোভাবে রপ্ত করানো হয়।
সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নির্দেশনা ছিলো ঢাকার হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বিদেশী সাংবাদিক ও অতিথিরা থাকাকালীন সময়ে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি যে শান্ত নয় এবং এখানে যে যুদ্ধ চলছে তা বোঝানোর জন্য শহরের আশে-পাশে কিছু গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে হবে; কিন্তু দু:সাহসী এই তরুণেরা ঢাকায় এসে ৯ জুন তারিখে সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করেন এবং বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে যা ছিলো অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ ও অচিন্তনীয় কাজ। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অপারেশনের খবর খালেদ মোশাররফের কাছে পৌঁছালে গর্ব করে তিনি বলেছিলেন, “These are Crack People.”। সেই থেকেই প্লাটুনের নাম করা হয় ‘ক্র্যাক প্লাটুন’।
দুঃসাহসী মুখগুলো
ক্র্যাক প্লাটুনের প্রায় সবাই ছিল ঢাকার সম্ভ্রান্ত ঘরের মেধাবী তরুণ। অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন; অনেকে উচ্চশিক্ষা অসমাপ্ত ফেলে চলে এসেছেন মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য। সংখ্যার সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাথমিকভাবে ১৭ জন ঢাকা আসেন। সময়ের সাথে সাথে দাঁড়ায় শতাধিকে। সেই সব ত্যাগী ও প্রিয়মুখের অনেকগুলোই এখনো অচেনা।
আবুল বারক আলভী, শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল (বীর বিক্রম), আজম খান, আমিনুল ইসলাম নসু, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন (বীর প্রতীক), ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, কাজী কামাল উদ্দিন (বীর বিক্রম), কামরুল হক স্বপন (বীর বিক্রম), গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক), চুল্লু, জহির উদ্দিন জালাল, জহিরুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, নীলু, পুলু, ফতেহ চৌধুরী, শহীদ বদিউজ্জামান, বদিউল আলম বদি (বীর বিক্রম), মতিন – ১, মতিন – ২, শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, মাহবুব, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীর বিক্রম), মাযহার, রাইসুল ইসলাম আসাদ, লিনু বিল্লাহ, শহীদ শফি ইমাম রুমী, শহীদুলাহ খান বাদল, শাহাদত চৌধুরী, সাদেক হোসেন খোকা, সামাদ, হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক), হিউবার্ট, রোজারিও হ্যারিস।
ক্র্যাক প্লাটুন গঠনের ইতিহাস
এই দলটি গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম এবং এটিএম হায়দার, বীর উত্তম। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ২ নং সেক্টরের অধীন একটি স্বতন্ত্র গেরিলা দল যারা মূলত গণবাহিনীর অংশ বলে পরিচিত।
এই বাহিনীর সদস্যরা ভারতের মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই প্রশিক্ষনে গ্রেনেড ছোড়া, আত্ম-গোপন করা প্রভৃতি শেখানো হতো। আরবান গেরিলা যুদ্ধের জন্য বিশেষায়িত ভাবে তৈরি করা হয়েছিল দলটি।
অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল
১৯৭১ সালের ৯ ই জুন সন্ধ্যায় ১৭ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মিলে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল আক্রমণের ছক আঁকে। তাদের কাছে ছিল ১২ টি গ্রেনেড, ১৬০ রুপি আর প্রত্যেকের কাছে একই করে বেয়নেট। তাদের দলনেতা ছিলেন হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক। অপারেশনের জন্য তাদের গাড়ি চালাচ্ছিলেন এফডিসির ক্যামেরাম্যান বাদল। পিস্তল নিয়ে তার পাশের সিটে কামরুল হক স্বপন বসে ছিলেন। আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং পেছনের সিটে বসা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক। তাদের তিনজনের হাতেই ছিল গ্রেনেড। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে এসে জিয়া, মায়া এবং হাবিবুল অনেকগুলো গ্রেনেড ফাটিয়ে পালিয়ে গেলেন।
এই অপারেশনের লক্ষ্য ছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের বোঝানো যে, পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক নয়।
অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট
প্লাটুনের সদস্য সামাদের নিউ ইস্কাটনের বাসায় ৭ই আগস্ট রাত ৮টায় এই অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। পুরো অপারেশনের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল মাত্র এক মিনিট। এই দলের সদস্য ছিলেন ৭ জন- জুয়েল, আলম, পুলু, স্বপন, সামাদ আর বদি এবং দলনেতা ছিলেন শহীদ বদিউজ্জামান। তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক সামাদ চালাবেন গাড়ি, আলমের হাতে থাকবে চায়নিজ চায়নিজ এলএমজি আর অন্য সবার হাতে স্টেনগান এবং সামাদের কাছে ছিল রিভলবার, জুয়েল আর পুলুর কাছে ছিল ফসফরাস গ্রেনেড আর গ্রেনেড-৩৬। এক মিনিটের এই অপারেশনে পাঁচজন মিলিটারি পুলিশ ও ছয়জন রাজাকার নিহত হয়। পুরো ঢাকাজুড়ে এই ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করে।
এছাড়াও ক্র্যাক প্লাটুন ঢাকা শহরে আরো যেসব গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে তার মধ্যে ছিল
. অপারেশন গ্যানিজ পেট্রল পাম্প
. অপারেশন দাউদ পেট্রল পাম্প
. অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন
. অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন
. অপারেশন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন
. অপারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন
. অপারেশন উলন পাওয়ার স্টেশন
. অপারেশন তোপখানা রোড ইউএস ইনফরমেশন সেন্টার
. অ্যাটাক অন দ্য মুভ
. ডেস্টিনেশন আননোন
শহীদ রুমী ইমাম
কথা ছিল আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে যাবেন। তার পরিবর্তে চলে গেলেন ‘মেলাঘর’ ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা প্রশিক্ষণ নেবার জন্য। মা জাহানারা ইমামকে রাজি করাবার সময় বলেছিলেন, “আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও; হয়তো আমি যাবো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে”।
শেষ অব্দি জুনের ১৪ তারিখ রুমী প্রশিক্ষণের জন্য মেলাঘরে গেলেন। ঢাকা আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলা। তার পরিচালনায় বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কিছু আক্রমণের মধ্যে ধানমন্ডি রোডের আক্রমণ অন্যতম। ১৯৭১ সালের ২৯শে আগস্ট নিজের বাড়িতে কাটান। সেই রাতেই বেশ কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধাসহ ধরা পড়ে যান পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। চরম অত্যাচারের পরেও রুমীর থেকে কোনো তথ্য বা কারো নাম বের করা যায়নি। দুই দিন নির্যাতনের পর পরিবারের অন্যদের ছেড়ে দেয়া হলেও ছাড়া হয়নি রুমীকে। বাবা শরীফ ইমাম জানতে চাইলে কর্নেল জানায়, পরের দিন রুমী ফিরবে। সেই পরের দিনটি আর আসেনি।
শহীদ আজাদ
গোপন সূত্রে পাকিস্তানিরা জানতে পারে ঢাকার এক বাড়িতে গেরিলাদের অবস্থান। ৩০শে আগস্ট হামলা চালালে ধরা পড়ে যায় ক্র্যাক প্লাটুনের একদল তেজস্বী যোদ্ধা। তাদের মধ্যে মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ একজন। ইস্কাটনে কয়েক বিঘা জমিতে তাদের রাজকীয় বাড়ি। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে আজাদ। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে বাড়ি ত্যাগ করে মা-ছেলে। যুদ্ধ চলাকালে আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে সবে মাস্টার্স শেষ করেছে। মায়ের অনুমতি নিয়েই নাম লেখালো ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এ। আস্তে আস্তে তার বাড়ি হয়ে উঠলো অস্ত্র আর গোলাবারুদে পূর্ণ গেরিলাদের ক্যাম্প।
আজাদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলে মা সাফিয়া বেগম রমনা থানায় দেখা করতে যান। ছেলের অবস্থা দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছেন, “শক্ত হয়ে থেকো বাবা। কোনো কিছু স্বীকার করবে না।” মিলিটারিদের নির্যাতনে ক্লান্ত আজাদ মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিল। মা ভাত নিয়ে এসে আর পাননি ছেলেকে। আর কোনোদিনই ফিরে আসেনি বাবা-মায়ের সেই আদরের ছেলেটি।
১৯৮৫ সাল অব্দি বেঁচে ছিলেন আজাদের মা। ঠিক ১৪ বছর পর আরেক ৩০ আগস্ট মৃত্যু ঘটে। এই দীর্ঘ সময়ে কখনো ভাত খাননি এই মহীয়সী নারী; কেবল থেকেছেন একবেলা রুটি খেয়ে। কারণ একমাত্র ছেলে আজাদ ভাত চেয়েও খেতে পারেনি। চৌদ্দটা বছর কোনো বিছানাতেও ঠেকাননি পিঠ; মেঝেতে শুয়েছেন। কারণ তার ছেলে নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে বিছানা পায়নি।
শহীদ আবু বকর
১৯৫৩ সালে সৈয়দপুরে জন্ম নেয়া আবু বকর ছিল বাবা মায়ের পঞ্চম সন্তান। ১৯৭১ সালে কায়েদ-ই আজম (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ) কলেজ থেকে ইন্টার পাশ করে ভর্তি হলো বিএসসিতে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার্স কোর্সে অপেক্ষাতেও ছিলেন। ২৫শে মার্চে পাক বাহিনীর বর্বরতার ঘটনা বদলে দেয় জীবনের গতিপথ।
মাত্র আঠারো বছর বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এ যোগ দিতে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দ্বিতীয় দফার অপারেশনে বকরই ছিলো প্রধান নায়ক। থেকেছে আরো সফল কিছু হামলায়। আগস্টের ৩০ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যাওয়া মুখগুলোর মধ্যে বকরও একজন।
শহীদ বদি
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র বদিউল আলম। ঢাকার ৫৭, মনিপুরী পাড়ার বাসিন্দা আব্দুল বারী ও রওশন আরা বেগমের বড় সন্তান। মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার মার্কস নিয়ে প্রথম শ্রেণী আর উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগে মেধা তালিকায় চতুর্থ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও করাচি থেকে মাস্টার্স শেষ করার পর নিজেকে সময় দেয়া হয়নি। জড়িয়ে যান মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব আনার দায়িত্বে। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসাবে ৮ আগস্ট ফার্মগেট চেকপোস্ট অপারেশন, ১১ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে বিস্ফোরণ, ১৪ আগস্ট ঢাকা শহরের আকাশে গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো, ১৯ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন, ধানমন্ডির ১৮ এবং ২০ নম্বর রোডের অপারেশন প্রভৃতি তার বীরত্ব ও সাহসিকতার অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ।
বদি ও হেলালের তারাইল থানা অপারেশনের মতো কিছু ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র আসে। নানার বাড়ির উদ্দেশ্যে পাকুন্দিয়া গেলে বদির মা হেলালকে বলেন, “তোরা অসংঘবদ্ধ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে যা করছিস; এতে একদিন ঠিকানাবিহীন তোদের মৃতদেহ পড়ে থাকার আশঙ্কা আছে। তার চেয়ে তোরা যা; প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে মোকাবেলা কর। এভাবে যদি আমার ছেলে মারাও যায়; আমি গর্ববোধ করবো মা হিসাবে।” ২৯ আগস্ট ধানমন্ডিতে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিন সাহেবের বাসায় ছিলেন বদি। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে হঠাৎ বাড়ি ঘেরাও করলো পাক বাহিনী। পালাতে চেষ্টা করেও ধরা পড়লেন। তারপর আর তাকে পাওয়া যায়নি।
শহীদ আলতাফ মাহমুদ
৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসাতেই থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিত প্রাণ গেরিলাদের দুর্গ ছিল বাড়িটি। ‘জাগো হুয়া সাভেরা’- এর পর থেকেই চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসাবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে ছিল। জহির রায়হানের নির্মিত চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’তেও কাজ করেছেন তিনি। তার সংগীত পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ক খ গ ঘ, অবুঝ মন, এই নিয়ে পৃথিবী, আঁকাবাঁকা, কার বউ, আগুন নিয়ে খেলা, নয়নতারা, দুই ভাই, সংসার, আপন দুলাল, প্রতিশোধ প্রভৃতি। যুদ্ধের সময় দরজা-জানালা বন্ধ করে শুরু করে নতুন আন্দোলন। আবদুল লতিফ গান লিখেছেন আর আলতাফ মাহমুদ করেছেন সুর। ভীতিকর পরিস্থিতির জন্য গলা খুলে গাইতে পারতেন না; কোনো কোনো গান রেকর্ড করতে হতো দুই বা ততোধিক বার।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অপারেশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। প্রচুর গোলাবারুদ বয়ে বেড়ানো সমস্যা বলে নিজ দায়িত্বে মাটিতে পুঁতে রাখেন আলতাফ। আগস্টের ৩০ তারিখ ট্রাংক-ভর্তি অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তারপর তার কথা কেউ বলতে পারেনি।
মৃত্যু থেকে পুনর্জন্ম
পাক বাহিনী পাগল হয়ে গিয়েছিল ঢাকার বিপ্লবীদের আটক করার জন্য। তামাম শহর কেবল চষেই বেড়ানি; ধরিয়ে দেবার জন্য ঘোষণা করা হয়েছে দুই হাজার টাকা পুরস্কারের। ১১ই আগস্ট হামলার পর পাক বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর কয়েকজনকে ধরে ফেলে। ২৯ আগস্ট অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় প্রায় ১৫ জন গেরিলা যোদ্ধাকে। টর্চার সেলে নিয়ে চালানো হয় অবর্ণনীয় অত্যাচার। দাঁতে দাঁত কামড়ে থেকে তারা সহ্য করেছে অত্যাচার; তবু তথ্য ফাঁস করেনি। নয়জনের আর কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি কোনোদিন।
কিন্তু থেমে যায়নি ক্র্যাক প্লাটুন। সেপ্টেম্বরের দিকেই আবার দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিযাত্রা শুরু হয়। জ্যেষ্ঠদের পদচিহ্ন ধরে এগিয়ে চললো কনিষ্ঠের মিছিল। মাতৃভূমির জন্য বাড়তে থাকলো নিখোঁজের তালিকা। আবারো সেই দুঃসাহসিক অভিযানে কেঁপে উঠলো বাসাবো, মানিক নগর, বাড্ডা, উত্তরখানসহ ঢাকার মাটি। বিজয়ের আগের দিন অব্দি তাদের তৎপরতা অব্যাহত ছিল।
আজাদ, রুমী, জুয়েল কিংবা বদির মায়েরা কখনো তাদের সন্তানদের ফিরে পায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে তাকাতে পারেনি মুক্ত আকাশে উড়তে থাকা পতাকার দিকে। চাইলেই হয়তো পশ্চিমা পৃথিবীতে গিয়ে নির্বিঘ্ন জীবন বেছে নিতে পারতেন তারা। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন মাতৃভূমির ভাষা। নিজের মায়ের কোল থেকে ফসকে তাই মুক্ত করে গেলো কোটি মায়ের কোলের সন্তান। যতদিন বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে; ততদিন বাংলাদের তাদের কাছে ঋণী।
সূত্র: যায়যায়দিন, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সমকাল, রোয়ার মিডিয়া, ভোরের কাগজ