১১ এপ্রিল শিলিগুড়ি বেতারকেন্দ্র থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সমগ্র দেশকে আটটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে আটজন সেক্টর কমান্ডার নিয়োগের ঘোষণা দেন।
অবশেষে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে বৃষ্টিস্নাত কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে সারা দেশকে সামরিকভাবে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর এটিই ছিল সেক্টর কমান্ডারদের প্রথম কনফারেন্স। সভায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এ রবকে বাংলাদেশ ফোর্সেস-এর চীফ অব স্টাফ ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর সর্বাধিনায়ক হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে মনোনীত করা হয়।
১নং সেক্টর ছিল বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্বে। ভৌগলিক দিক থেকে এই সেক্টর এলাকা বেশ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল। এখানে একইসাথে পাহাড়, উপত্যকা, হ্রদ, নদী ও সমুদ্রসকাশের সমতলভূমি ছিল। এসব কারণে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে বেশি হত। পাহাড় পরিবেষ্টিত থাকায় এ অঞ্চল গেরিলা যুদ্ধের জন্য বেশ উপযোগী ছিল। চলুন, ইতিহাসের পথ ধরে পিছনে ফিরে দেখে আসি রণাঙ্গনের ১ নং সেক্টরকে।
প্রধান প্রধান নদ-নদী: সাঙ্গু, হালদা, ফেনী, মুহুরী, কর্ণফুলী, মাতামুহুরী, নাফ, মহেশখালী, বাকখালী, রাখিয়াং, কাসালং, মাইনি, চেংগী উল্লেখযোগ্য।
পাহাড়শ্রেণী: আরাকান গিরিমালা, সীতাকুণ্ড পাহাড়, গোল পাহাড় ও বাটালী পাহাড় উল্লেখযোগ্য। পাহাড়বেষ্টিত থাকার কারণে এই অঞ্চল গেরিলাযুদ্ধের জন্য বেশ উপযোগী গুপ্তাশ্রয় (Hide-out) হিসেবে বিবেচিত ছিল।
যোগাযোগ ব্যবস্থা: চট্টগ্রাম ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আর প্রধান সামুদ্রিক বন্দর। পাকিস্তানী হানাদারদের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ করাচি থেকে এই বন্দরেই খালাস করা হতো। এছাড়া চট্টগ্রামে একটি আধুনিক ও উপযোগী বিমানবন্দর সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আমল থেকে চালু ছিল। কক্সবাজার ও চিরিংগায় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলে নির্মিত বিমানঘাঁটি। এছাড়া এই সেক্টরটির সাথে সড়কপথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে। এই মহাসড়কের শুভপুর ব্রিজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চট্টগ্রাম থেকে রেলপথ কুমিল্লা-আখাউড়া হয়ে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত। অনেক স্থানেই রেলপথ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মাত্র কয়েক মিটার দূর দিয়ে চলেছে। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে। অন্যদিকে সমুদ্রবন্দর ও চট্টগ্রাম নৌঘাঁটি থাকার ফলে এখানে বড় ধরনের নৌযুদ্ধ সম্ভব ছিল। অপারেশন জ্যাকপট এর একটি প্রোজ্জ্বল উদাহরণ।
এছাড়া চট্টগ্রামে ছিল বেতারকেন্দ্র আর কালুরঘাটে ট্রান্সমিটার কেন্দ্র। এই কালুরঘাট থেকেই মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এছাড়া এই সেক্টরে একটি অত্যাধুনিক ভূ-উপকেন্দ্র, টেলিযোগাযোগ কেন্দ্র ও আবহাওয়া দফতর স্থাপিত ছিল।
সেক্টর এলাকা: বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা (রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি), কক্সবাজার মহকুমা এবং নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার অংশবিশেষ (মুহুরী নদীর পূর্বপাড় পর্যন্ত) নিয়ে এই সেক্টরটি গঠিত হয়েছিল। এই সেক্টর এলাকার আয়তন প্রায় ১৮,৬০৩.৪৭ বর্গ কিলোমিটার। অঞ্চলটি ভৌগোলিকভাবে ২০°৩৫ˊ থেকে ২২°৫৯ˊ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°২৭ˊ থেকে ৯২°২২ˊ পূর্ব দ্রাঘিমা রেখার মধ্যে অবস্থিত। ১
সদর দপ্তর: হরিণা
১ নম্বর সেক্টরের পাঁচটি সাব-সেক্টর ও কমান্ডার-
• ঋষিমুখ – ক্যাপ্টেন শামসুল ইসলাম।
• শ্রীনগর– প্রথমত ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও পরে ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান।
• মনুঘাট – ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান।
• তবলছড়ি – সুবেদার আলী হোসেন।
• ডিমাগিরী – আর্মি সার্জেন্ট ( নাম জানা যায়নি)।
১ নম্বর সেক্টর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা। যেখানে ই.পি.আর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রায় দুই হাজার সৈন্য ছাড়াও ছিলেন প্রায় আট হাজারের মতো গণমুক্তি বাহিনী। এ বাহিনীর গেরিলাদের আবার একশো ৩৭টি দলে ভাগ করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়।
সেক্টর কমান্ডার: মেজর জিয়াউর রহমান (এপ্রিল থেকে ১০ জুন ’৭১) এবং মেজর রফিকুল ইসলাম- ইপিআর (১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১)।
সেক্টর এ্যাডজুটেন্ট: ফ্লাইং অফিসার সাখাওয়াত হোসেন এবং ক্যাপ্টেন এনামুল হক।
কোয়ার্টার মাস্টার: নায়েক সুবেদার সোবহান এবং ইঞ্জিনিয়ার একেএম ইসহাক।
সেক্টর মেডিক্যাল অফিসার: ডা. রেজাউল হক।
সেক্টর ট্রুপস্: নিয়মিত বাহিনী- ২,১০০ সৈন্য। এদের মধ্যে ১,৫০০ ইপিআর সদস্য, ৩০০ জন সেনাবাহিনীর, ২০০ পুলিশ এবং ১০০ নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য।
গণবাহিনী: ২০,০০০ জন। এর মধ্যে ৮,০০০ গেরিলা ছিল ১৩৭টি দলে সুসংগঠিত অ্যাকশন গ্রুপ। গেরিলাদের ৩৫% এবং সেক্টর ট্রুপসের সবাইকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়।