১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে এই লেখাটিতে।
মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ ছিল প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা সাধারণ মানুষ। যাদের ছিল না যুদ্ধের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা। সংগ্রহ করা পুরোনো হাতিয়ার, সামান্য ট্রেনিং, পরিচিত ভূমি আর গণমানুষের উৎসাহ ও সহযোগিতাকে পুঁজি করেই তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে তারা আবার ফিরে গেছেন নিজ ভুবনে। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টিই তাদের কাছে সর্বোচ্চ পাওয়া।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ওরাওঁ জাতির আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদান
হোসেন ওঁরাও:
হোসেন ওঁরাও আদিবাসী ওরাওঁ সম্প্রদায়ের একজন মুক্তিযোদ্ধা। রাজশাহীর গোদাগাড়ির দরিদ্র কৃষি শ্রমিক হোসেন ওরাওঁ মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশে যুদ্ধ শুরু হলেও তিনি তখন বাড়িতে কৃষিকাজ করছিলেন। ১৯৬৪ সালের দারুশা রায়টের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, তখন তার পরিস্থিতিটা তাদের জন্য প্রায় একই রকম। আশপাশের বাঙালি মুসলমানরা নানা রকম ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। পাকিস্তানিরা হিন্দুদেরও আগে আদিবাসীদের মারবে। এছাড়া আদিবাসী ও হিন্দু গ্রামগুলোতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও ঘটছে। দারুশা রায়ট যখন হয় তখন তিনি লাঙল চালান। বয়স ১৫/১৬ বছর। তাদের ইচরিপুর গ্রামে পাশের গ্রাম জয়পুরের মুসলমানরা এসে সব লুটপাট করে নিয়ে গেল। ধান, পাট, গরু, ছাগল সব। তারা ভারতে চলে যায়। পরে আবার ফিরে আসে। কিন্তু অনেকেই তখন ভারতে থেকে গেল। রায়ট দারুশা থেকে শুরু হলো।
একে একে মুসলমানদের দ্বারা তাদের গ্রামগুলো আক্রান্ত হতে লাগল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে শুরু হলো। ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ভারত চলে গেল হোসেন ওরাওঁ। সামান্য কিছু ব্যবহার্য জিনিস সাথে নিয়ে পদ্মা পার হয়ে ভগবান গোলায় গিয়ে উঠে। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় হলো। এখানকার লেখাপড়া জানা লোকেরা সাহায্যের জন্য ছুটাছুটি করল। রেশন কার্ড পেল। অনিশ্চিত জীবন। এর মধ্যে একদিন সাগরাম মাঝি ও তার ছেলে ভোলা তাদের ক্যাম্পে এলেন। তারা বললেন, যুদ্ধে যেতে হবে। দেশ মুক্ত করতে হবে। মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে হবে। তারা বলল, চল যাই যুদ্ধ করতে। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে। তাদের সাথে গেল ট্রেনিং নিতে। ওখানে ১৫ দিন পিটি ট্রেনিং ,লো। ওখান থেকে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য নিয়ে গেল শিলিগুড়ির পানি-নিয়া। এসএলআর, এলএমজি, স্টেনগান ইত্যাদি অস্ত্রের ট্রেনিং দেয়া হলো।
আনুমানিক ২০ দিন ট্রেনিং চলল। ট্রেনিংয়ের পর মনে হলো, যুদ্ধ করার জন্য তীর-ধনুকের চাইতে আধুনিক অস্ত্রই ভালো। তার নামে একটি এস.এল.আর ইস্যু হলো। ওখান থেকে তারা আসেন বাংলাদেশের পোড়াগ্রাম। ওখানে প্রথম যুদ্ধে ২/৩ শত মুক্তিযোদ্ধা মিলে আক্রমণ করল পাক সেনাদের ক্যাম্প। আক্রমণ ব্যর্থ হলো। তারা পশ্চাদপসরণ করল। ফিরে গিয়ে দেখল, চারজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা নেই। কিন্তু এ ব্যাপারে দেখল কমান্ডারসহ অন্য কারো আগ্রহ নাই।
তাদের সাথে হোসেনদের ঝগড়া হয়। তারা ২০ জন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তুমুল ঝগড়া করে ঐদিনই তারা ভারতের লালগোলা চলে গেল। ওখান থেকে তাদের অন্য কোম্পানিতে যুক্ত করা হলো। এরপর লালগোলা থেকে ঘরচাপা বর্ডার পার হয়ে তারা তানোর-মোহনপুর এলাকা হিট করল। ঐ এলাকার লোকরা তাদের ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। তারা রাতে অপারেশনে যেত। ভোর রাতে গ্রামের কোনো বাড়িতে গিয়ে উঠতো। তারা তাদের ঘরের ভেতরে থাকার ও গোসল করার ব্যবস্থা করে দিত।
খাবার-দাবারের ব্যাপারেও যত্নবান ছিল। এ সময় তারা দৈনিক অপারেশনে যেত, বিশেষত রাজাকার-বিরোধী অপারেশন। স্বাধীনতার ২ দিন আগে তারা তানোর থানা আক্রমণ করল। কয়েক কোম্পানি মিলে ৪/৫ শত মুক্তিযোদ্ধা থানা দখল করল। দুজন পাক আর্মি জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ে। তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এ যুদ্ধে একজন আদিবাসী গুলিতে আহত হয়। পরবর্তীকালে সে ভারত চলে যায়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন তানোরে ছিল হোসেন ওরাওঁ। খবর জানার পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। এসএলআর-এর সব গুলি খরচ করে আকাশের দিকে তাক করে।
বুদু ওরাওঁ:
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক দুঃসাহসী বীর সেনানী বুদু লাকড়া। তিনি অনেকের কাছে বুদু সিং আবার অনেকের কাছে বুদু ওরাওঁ নামে পরিচিত। আদিবাসী ওরাওঁ সমাজের এই কৃতী সন্তানের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যা আমাদের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বুদু লাকড়ার জন্মস্থান রংপুরের মিঠাপুকুর থানার বলদিপুকুর গ্রামে। এটি বগুড়া-রংপুর সড়ক থেকে পশ্চিম দিকে। বলদিপুকুর মূলত ওরাওঁ এলাকা, তারা কুড়ক ভাষায় কথা বলেন, আদিধর্ম সাওসার। মিঠাপুকুর থানার বলদিপুকুর, তাজনগর, মোমিনপুর এগুলো ওরাওঁ জনপদ। বুদু লাকড়া বলদিপুকুর মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করার সময় গনি নামের এক বাঙালি যুবকের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়।
গনি পরবর্তীকালে উকিল হয়েছিলেন। বুদুর পড়াশোনা হাইস্কুল পর্যন্ত। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময়ে গনি উকিল মিঠাপুকুরে বাঙালি ওরাওঁ নির্বিশেষে প্রতিটি পাড়ায় ঘুরে ঘুরে নৌকা মার্কার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এসময় বুদু তার সাথী হন। সেই সুবাদে বুদুকে তিনি জানান যে রংপুরের কালেক্টরেট ময়দানে সভা করতে বঙ্গবন্ধু আসছেন এবং সেখানে সবাইকে যেতে হবে। সেই আহবানে সাড়া দিয়ে রংপুর কালেক্টরেট ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার জন্য হাজার হাজার বাঙালির সঙ্গে আদিবাসী সমাজের লোকজনরাও একাকার হয়ে গিয়েছিলেন।
বলদিপুকুর, তাজনগর, মোমিনপুর ও আশেপাশের এলাকা থেকে প্রায় ১০০০ ওরাও নিয়ে বুদু সেই মিটিংয়ের উপস্থিত হন। ১৯৭০- এর নির্বাচনে বুদু লাকড়া নৌকা মার্কার পক্ষে অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করেন। ফলে সবগুলো কেন্দ্রে ওরাওঁরা নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রংপুর শহর আর তার আশপাশের গ্রামগুলোকে লাঠিসোটা, তীর-ধনুক, বাউংকা, বল্লম হাতে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ। তার কারণ পাঞ্জাবি সৈন্যরা রংপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রতিষ্ঠা করেছে, ভেতরে বাঙালি সৈন্যরা বন্দি, তাদের বউ-বাচ্চারা নিরাপত্তাহীন। রংপুর শহরের আশেপাশে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজন অতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসেন। সবচেয়ে মারমুখী ভূমিকা ছিল মিঠাপুকুর বদলীপকুর এলাকার আদিবাসী ওরাওঁদের। বুদুর নেতৃত্বে হাজার হাজার ওরাওঁ নারীপুরুষ তাদের তীর, ধনুক, বল্লম নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হন।
কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর সেখানে অবস্থানরত ব্রাউনিং মেশিনগান সজ্জিত গোটা দশেক সামরিক যান থেকে পাঁচ মিনিট ধরে চালানো হয়। অবিরাম গুলিবর্ষণ। আদিকালের অস্ত্রপাতিসহ মানুষগুলো যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরারে মাটিতে গড়িয়ে পড়লেন। বাকিরা দিকবিদিক পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন। পরবর্তীকালে বুদু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে চাইলে সেখানেও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আপত্তি করে। বুদু আদিবাসী হাতে অস্ত্র পেলে মিশে যেতে পারে ভারতের ওরাওঁদের সাথে। কিন্তু বুদুর প্রবল দেশপ্রেম এবং প্রচেষ্টার ফলে তাকে জলপাইগুড়ি জেলার মেটলি থানার মুরতি পাহাড়ের ওপরে প্রশিক্ষণ শিবির মুজিব ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখানে বুদু পাঁচ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধা বুদু ওরাওঁ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নেন। তার মধ্যে ছিল পাকুড়পাড়া ব্রিজ ধ্বংস করা। এই ব্রিজ দিয়ে পাকবাহিনী সহজে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতো।
এই কারণে এই ব্রিজ ধ্বংস করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই জরুরি ছিল। এই অপারেশনে ৬ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। তারা হলেন আজিজার, মাহবুব, বাচ্ছ, জব্বার, সাজ্জাদ ও বুদু। এদের নেতৃত্বে ছিলেন জব্বার। পরবর্তীকালে দশজন মুক্তিযোদ্ধার একটি বিশেষ দল গঠন করা হয় বুদু ওরাওঁকে কমান্ডার করে। সীমান্ত এলাকায় নানা গেরিলা আভযানে এই দলটি অংশগ্রহণ করে। প্রতি দুদিন পরপর সীমান্ত পার হয়ে এসে তাদের রিপোর্ট করতে হতো মেজর দরজির কাছে। শালবন অপারেশনে তারা বেশ কয়েকজন পাকবাহিনীকে হত্যা করে তাদের চাইনিজ রাইফেল দখল করেছিলেন।
আদিবাসী তাঁতী মুক্তিযোদ্ধা : ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁতী জাতির আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে এই লেখাটিতে।
শহীদ শুভ তাঁতী:
চা-শ্রমিক পরিবারের সন্তান শুভ তাঁতী নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। দরিদ্র পরিবারে তিনিই ছিলেন একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের জোয়ার সেসময় তার স্কুলেও আঁছড়ে পড়েছিল যার প্রভাবে তিনি সভা-সমাবেশে যোগ দেন। কিন্তু পেটের দায়ে পড়াশোনা ও মিছিলমিটিং বাদ দিয়ে শাহজিবাজারের ইলেকট্রিশিয়ানের দোকানে কাজ শুরু করেন কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি আর চুপ থাকতে পারেননি। যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। পাকিস্তানি বাহিনী এলাকায় পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত মিটিং-মিছিলের পুরোভাগে দেখা যেত শুভ তাঁতীকে।
এক সময় নিরাপত্তার প্রশ্নে ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তিনি ভারত চলে যান এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে একদিন হঠাৎ করে বুকে ব্যথা শুরু হওয়ায় তাকে কমব্যাট অপারেশন থেকে প্রত্যাহার করা হয়। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে তিনি ‘ইনফরমার’ ও ‘সংগঠক’ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। ঐ কাজের জন্য তাকে নোয়াপাড়া চা বাগানে আসতে হয়েছিল। নোয়াপাড়ায় তখন পাকসেনাদের স্থায়ী ঘাঁটি। শুভ তাঁতী অতিসন্তর্পণে চা বাগানের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নিজের ঘরে এলেও রাজাকারদের দৃষ্টি এড়াতে পারেননি। দু-তিন দিন কাজ করার পরই দু-জন রাজাকার এসে জানায় যে তাকে শাহজীবাজারে বিদ্যুৎ মেরামতের কাজে জরুরি ভিওিতে যেতে হবে।
যেতে অস্বীকার করায় তার চোখ বেঁধে নিয়ে যায় ম্যানেজারের বাংলোয়। শুরু হয় অমানবিক শারীরিক নির্যাতন, পাকসেনাদের বুটের আঘাতে তার দেহ রক্তাক্ত হয়ে থেঁতলে গেলেও নির্যাতনের মাত্রা তাতে কমে না। পরে শুভ তাঁতীকে নিয়ে যাওয়া হয় মাধবপুর ও জগদীশপুরের সংযোগ সড়কের তেমাথায়। পাকিস্তানি সেনারা তার সামনেই তেল গরম করে এবং খানিকক্ষণ পর পর তার গায়ে ছিটানো হয় সেই গরম তেল। তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করলে তারা উল্লাস ধ্বনি দিয়ে উঠে ‘শালা শুয়ারকা বাচ্চা’। এভাবে গরম তেলের ছিটাতে তাঁর গায়ে বিভৎস ফোসকা উঠে যায়। পরে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। তাঁর লাশের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
শহীদ কুলচন্দ্র তাঁতী :
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কমলগঞ্জের মৃতিঙ্গা চা বাগানের শ্রমিক-সন্তান কুলচন্দ্র তাঁতীর বয়স ছিল ১৭। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় খুব একটা পড়াশোনা করতে পারেননি তিনি। মৃতিঙ্গা চা-বাগানে পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব দেখে তার মনে প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা জাগে। পাক বাহিনী তাদের বাগানের দুজন নারী শ্রমিককে নিপীড়ন করে এবং পরবর্তীকালে দেওয়াড়া চা বাগানে পঞ্চাশ জনেরও বেশি চা-শ্রমিককে হত্যা করে। তাঁর পরপরই তিনি ভারতের কমলপুর ত্রিপুরা শরণার্থী ক্যাম্পে চলে যান। ঐ ক্যাম্পেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত হন এবং লোহারবন্দে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তবে বয়স কম হওয়ায় এবং বয়সের তুলনায় শারীরিক কাঠামো ছোট আকারের ছিল বলে কুলচন্দ্র তাঁতীকে ভারি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন যে, খুব কষ্টের ট্রেনিং ছিল বলে অনেক তরুণ সেখান থেকে পালিয়ে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধা কুলচন্দ্র তাঁতীকে জুড়ি-বড়লেখা অঞ্চলে পাঠানো হয়। চা-শ্রমিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় প্রথমত তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় ছদ্মবেশে সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন বাগানে প্রবেশ করে শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া এবং তাদের বাংকার ও ক্যাম্পের অবস্থান চিহ্নিত করা ও মাইন পুঁতে রাখা।
প্রায় রাতে অগ্রবর্তী দলকে নিয়ে যাওয়া ও অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহের কাজও তাকে করতে হতো। বয়সের তুলনায় ছোট দেখানোর কারণে রাজাকার ও পাকসেনারা তাকে সাধারণভাবে সন্দেহ করতো না। কুলাউড়া বড়লেখা অঞ্চলে তিনি ছদ্মবেশে বহুবার গিয়েছেন এবং সেখানে তিনি দেখেছেন যে জুড়ির শিলুয়া কুচাই ও সাগরনল বাগানগুলোতে বাংকার ছিল প্রচুর। এই বাংকারগুলোর খবর কুলচন্দ্র তাঁতী তার কমান্ডার মাসুক মিয়াকে জানাতেন। শিলুয়া বাগানের রাস্তায় তিনি, বিশ্বনাথ কুমী ও নারায়ণ কুমী মিলে মাইন পুঁতে রেখেছিলেন। একবার বাংকারের খবর নিতে গিয়ে একটি পুলের কাছে ডিউটিরত রাজাকারদের হাতে তিনি ধরা পড়েন, রাজাকাররা তাকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। তাকে যে বাংকারে রাখা হয় সেই বাঙ্কারে তিনি ৮ জন মহিলাকে দেখেছেন তার মধ্যে তিনজন ছিলেন বাঙালি ও পাঁচজন মণিপুরী। তাদের সবাইকে বিবস্ত্র অবস্থায় রাখা হয়েছিল এবং তাদের শারীরিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। তখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল বলে পাকিস্তানি সেনারা রাতে যাওয়া-আসা করতো বেশি। একদিন সন্ধ্যায় একজন পাকসেনা তাকে পার্শ্ববর্তী বাজার থেকে কিছু জিনিসপত্র কিনে আনতে পাঠালে তিনি বাজার-সংলগ্ন ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে যান এবং টিলা-জঙ্গল অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছান।
তিন দিন আটকা পড়ায় তার সহযোদ্ধারা ভেবেছিলেন যে তিনি মারা গেছেন। তাকে ফিরে পেয়ে সহযোদ্ধারা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। তিনি বলেন একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আরেকজনের সম্পর্ক এতটাই গভীর যে আপন ভাইয়েভাইয়েও সেটা হয় না। তাঁর সহযোদ্ধা মৃতিঙ্গা চা-বাগানের ইন্দ্রজিৎ বাউরী যুদ্ধে যেয়ে আর ফিরে আসেননি, সেকথা এখনো তার মনে বেদনা ছড়ায়। ক্যাম্পে ফিরে কুলচন্দ্র তাঁতী তার তিনদিনের অভিজ্ঞতা এবং বাংকারের নির্যাতিত মেয়েদের কথা সহোযাদ্ধাদের জানান। বেদনায় উদ্বেলিত মুক্তিযোদ্ধা নরেশ দাশ পরদিন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে একাই ছুটলেন, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে অনুসরণ করেন। শিলুয়া চা-বাগানের বাংকারের নিকটবর্তী স্থানে পৌছে নরেশ দাশ বাংকার-পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতে বুকের ওপর ভর করে এগিয়ে যান। সে সময় অসাবধানতাবশত তার অস্ত্রের নলের মধ্যে কাঁদা ঢুকে যায়।
ফলে তিনি যখন ডিউটিরত পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন তখন বন্দুকের ভেতর থেকে বিকৃত আওয়াজ বের হয় এবং গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এই সুযোগে পাকসেনারা পাল্টা গুলি ছোঁড়ে, নরেশ দাস তাতে আহত হন এবং পালাতে না পারায় পরবর্তীকালে এই দেশপ্রেমিককে তারা নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। তার হত্যার বদলা নিতে মুক্তিবাহিনী এর পরদিন ঐ বাংকারের ওপর শেলিং করে তা বিধ্বস্ত করে দেয়। শিলুয়া চা-বাগান এলাকায় পাকবাহিনী এতটাই ক্ষয়ক্ষতি করেছিল এবং এত মানুষ হত্যা করেছিল যে প্রতিক্রিয়ায় ঐ অঞ্চল জনবিরল হয়ে পড়েছিল। কুলচন্দ্র তাঁতী জুড়ি রেলস্টেশনের কাছে একদিন ৩ জন মহিলার লাশ দেখেছেন- দুজনের সিঁদুর পরা, অপরজন সিঁদুর ছাড়া। আরেকদিন তিনি দেখেন ২১টি লাশ পড়ে থাকতে, যাদের সবাই ছিলেন বাঙালি।
নভেম্বর মাসের শেষদিকে গাজীপুর চা-বাগানে কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলে। সেখানকার বাংলোটিতে পাকসেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলোটি আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধা এম এ মুমিত, এস এ মোহিত ও মোহন লালের নেতৃত্বে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী এই অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। অনেক পাকসেনা সেখানে খতম হয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য বীরাঙ্গনাদের পরম ত্যাগের কথা কুলচন্দ্র তাতী সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন। মুক্তিবাহিনীর সহযোদ্ধাদের কথাও তিনি বার বার মনে করেন।
শহীদ পবন কুমার তাঁতী :
বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম শিক্ষিত ব্যক্তি রাজঘাট চা বাগানের পবন কুমার তাঁতী। তিনি বিকম পাস করেছিলেন। চা-শ্রমিকদের সকলের কাছে এটা গর্বের হলেও কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা পছন্দ করেনি। কেন না বাগানে শিক্ষার বিস্তার তাদের কাছে হুমকিস্বরূপ মনে হয়েছিল। তাছাড়া ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যেটা চা-বাগান কর্তৃপক্ষের নজর এড়ায়নি। পবন কুমার তাঁতী কমিউনিস্ট নেতা মফিজ আলীর নেতৃত্বাধীন চা শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে চা-বাগান এলাকায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। একাত্তরের মার্চে পবন তাঁতী ঢাকায় ছিলেন এমএড কোর্স করতে। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হলে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং খুব কষ্ট করে বাগানে ফিরে যান।
সেখানে যেয়ে তিনি পরিবারের সদস্য ও শ্রমিকদের সাথে যুদ্ধে যাওয়া ও নিরাপদ আশ্রয়ের কথা আলোচনা করেন। তার এই মিটিং-এর কথা পাকসেনাদের কানে যায় এবং একদিন সকালে সেনারা এসে পবন তাঁতীসহ পরিবারের সকলকে লাইনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাদের ঘরে অস্ত্র খুঁজতে থাকে। অস্ত্র না পেয়ে বন্দুকের নল দিয়ে তারা পবন তাঁতীকে আঘাত করে। তবে ঐ দফায় প্রাণে না মেরে তার সার্টিফিকেট ও পুরনো চিঠিপত্রের বাক্স নিয়ে পাকসেনারা চলে যায়। পবন তাঁতী ইচ্ছা করলেই নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি দেশে থেকে শ্রমিকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করার জন্য কাজ করতে থাকেন। এরই এক পর্যায়ে তিনি কালিঘাট বস্তিতে আসেন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পবন তাঁতীর উপর নজর রাখতে এবং পাকিস্তানি সেনারা কালিঘাট বস্তিতে এসে তার পরিবারের সদস্যদের উপর অত্যাচার শুরু করলে পরিবারের অন্যদের বাঁচানোর স্বার্থে তার কাকা পবন তাঁতীকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেন।
তাকে শ্রীমঙ্গল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুমাস ধরে তার উপর চলে অমানবিক নির্যাতন। কখনো চলেছে চাবুক, কখনো গরম ঘেঁকা, কখনো গরম পানি গায়ে ঢেলে দেওয়া, কখনোবা পা উপরে আর মাথা নিচে দিয়ে ঝুঁলিয়ে রাখা হতো। এভাবে শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ হলে ৪ ডিসেম্বর রাতে শ্রীমঙ্গলে ওয়াপদা অফিসের বধ্যভূমিতে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ভুইমালী সম্প্রদায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদান
কার্তিক চন্দ্র ভুইমালী :
আদিবাসী ভুইমালী সম্প্রদায়ের একজন মুক্তিযোদ্ধা কার্তিকচন্দ্র ভুইমালী। রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার হরিদেবপুর গ্রামে কার্তিকের বাড়ি।যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে মোটরসাইকেল মেকানিক হিসেবে কোনোরকমে জীবিকার সংস্থান করেন। ১৯৭১ সালে সবে কৈশোর উর্ত্তীর্ণ হওয়া কার্তিকচন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন – ১৯৭১ সালে আমি তালাদ স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। এ সময় দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমরা আতংকে আছি। স্থানীয় কিছু পাকিস্তানপন্থী মুসলমান আমাদের ভারতে চলে যাবার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে থাকে।আশপাশের গ্রামের আদিবাসী এবং হিন্দুরা আমাদের সামনে দিয়ে ভারত চলে যাচ্ছে। এসব দৃশ্য আমাদের মনোবল ভেঙে দেয়। বৈশাখ মাসের কোনো এক শুক্রবার। আমরা দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। এ সময় গ্রামের আবদুল মান্নান এসে বলল, সবাই ভারত চলে গেল, তোমরাও চলে যাও। আমরা বললাম, খাওয়া শেষ করে তারপর যাব। সে ভাতের হাঁড়ি লাথি মেরে ফেলে দিল। তারপর ঐদিনই ভারতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বলতে গেলে শুধুমাত্র পরনের কাপড়ই সম্বল ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে নিয়ামতপুরের নিমদীঘি গিয়ে আশ্রয় নিলাম। স্থানীয় লোকজন কেউ ভয় দেখায়, কেউ সহযোগিতা করে। একদিন শুনলাম, আর্মি আসছে। ঐ দিনই বিল পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেলাম। ভারতে গিয়ে প্রথমে মালদার এক প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নিলাম। ওখান থেকে ভারত সরকার আমাদের গোবিন্দপাড়া শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যায়। ঐ শিবিরে আমরা প্রায় দশ হাজার লোক ছিলাম। এখানকার আব্দুর রাজ্জাক স্যারসহ আরো কিছু লেখাপড়া জানা ব্যক্তি আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। রাজ্জাক স্যার এবং আনারুল একদিন আমার ক্যাম্পে গেলেন। তারা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। আমার সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার কথা বললেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম। রাজ্জাক স্যার ঐ দিনই আমাকে মালদায় নিয়ে গেলেন। ওখানে রবীন্দ্র হলে এক রাত থাকলাম। পরদিন ভোর চারটার সময় গাড়িতে উঠলাম। আমরা শরণার্থী শিবিরের মোট সাতজন গেলাম। রাজ্জাক স্যার গেলেন না।
গেলাম শিলিগুড়ির পানিঘাটা পাহাড়ি এলাকায়। গায়ে তেমন কাপড় নেই। বলা হল সকাল পর্যন্ত কষ্ট করতে হবে। সকালে কাপড় দিল। তাঁবু দিল। প্রতি তাঁবুতে ছয় জন করে থাকতে হবে। বলা হল, আজ সন্ধ্যা থেকে ট্রেনিং শুরু হবে। এটা আনুমানিক জুন মাস ছিল। রাত-দিন ট্রেনিং চলত। এর মধ্যে একটি উচ্চতর ট্রেনিং-এর আহ্বান জানালে তাতে অংশগ্রহণ করি। ট্রেনিং কমান্ডার ক্যাপ্টেন ধীলন আমার যোগ্যতা দেখে মুগ্ধ হন।মোট ২৮ দিনের ট্রেনিং হল। রাইফেল, এসএলআর, এলএমজি, গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ ইত্যাদি অস্ত্রের ট্রেনিং হয়। পানিঘাটা থেকে আমরা ১৫ জনের বাহিনী এলাম বালুরঘাটে, ৫০ জন এদেশী, ১০০ জন ভারতীয় সেনা। কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন ধীলন ও ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী এবং বাঙালি সমীর কুমার দাস।
প্রথম যুদ্ধ করি দিনাজপুরের চিরির বন্দর। চিরির বন্দরে পাক আর্মির একটি ক্যাম্প ছিল। আমরা ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করি। ১৪ জন পাক আর্মিকে জীবিত আটক করি একজন আহতসহ। যাবার সময় তারা একটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে যায়, যাতে আমরা আর অগ্রসর হতে না পারি। এরপর আমরা পার্বতীপুরের একটি ক্যাম্প আক্রমণ করি। এটি ছিল একটি বিহারি অধ্যুষিত এলাকা। দুইবার আক্রমণ করেও আমরা ঐ ক্যাম্প দখল করতে ব্যর্থ হই। পরে পেছন থেকে ভারতীয় আর্মি এলে ঐ যুদ্ধের দায়িত্ব তাদের ওপর দিয়ে আমরা চলে যাই বগুড়ার দিকে। বগুড়ায় আমরা এক যুদ্ধে যোগ দেই। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় সেখানে। উভয় পক্ষ-ই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে মানুষের লাশ পড়ে ছিল। বগুড়া থাকা অবস্থায় পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই ঘোষণায় আমরা উল্লসিত হই।
এরপর আমরা গিয়ে থাকি বগুড়া শাহ আজিজুর রহমান কলেজে। ওখানে ১৫ দিন ছিলাম। এ সময় টহল দিতাম এবং মাঝে মাঝে রাজাকার আটক অভিযানে বের হতাম। ঐ এলাকা থেকে আমরা মোট ৭২ জন রাজাকার আটক করেছিলাম। বগুড়াতেই অস্ত্র জমা দেই। বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পর ভারতীয় আর্মি গাড়িতে করে আমাদের রাজশাহী দিয়ে যায়। ওখান থেকে বাড়িতে আসি। বাড়ি এসে দেখলাম বাড়ি বলে কিছু নাই । গ্রামে কোনো লোকও পাচ্ছি না। পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামের সামাদ তার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যায়। ওখানে তিন দিন থাকি। আবার বাড়িঘর তৈরি করে পরিবার দেশে নিয়ে আসি। স্কুলে আবার ভর্তি হলাম। ১৯৭৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আনুমানিক ১৬টি ছোট-বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা একতায় থাকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সমাজে শতকরা ৫ ভাগ লোক সম্মান ও মর্যাদা দেয়। ২৬-শে মার্চ ও ১৬-ই ডিসেম্বরের দিন সরকারি কর্মকর্তারা অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু পরে গেলে ঝামেলা মনে করে। এছাড়া, কখনও কখনও সামাজিক অনুষ্ঠানে ডাকা হয়।
শহীদ চম্পক বাড়াইক :
সিলেটের জৈন্তাপুর থানার খান চা-বাগানের শ্রমিক চম্পক বাড়াইকের পিতার নাম ছিল- চুনিলাল বাড়াইক। বয়সে তরুণ চম্পক ভারতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন।সহযোদ্ধাদের কাছে তিনি ‘রেকিম্যান’ এবং যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তামাবিল সীমান্ত দিয়ে তার প্রথম ইনডাকশন হয়, তবে ছদ্মবেশে তিনি প্রায়শ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাকবাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতেন।
এরকম এক মিশনে একদিন চম্পক বাড়াই পিয়াইনছড়ার তীরে শত্রুর অবস্থানের খুব কাছাকাছি এসে সশস্ত্র অবস্থায় ধরা পড়ে যান। পাকসেনারা তাকে নিয়ে একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখে। সেখানে তার উপর চলে অমানবিক নির্যাতন- কখনো শরীরে গরম পানি ঢালা হয়, কখনো ঢুকানো হয় সুঁই। কখনো আবার বেয়নেটের খোঁচা দিয়ে তার শরীর রক্তাক্ত করা হয়। যন্ত্রণাকে তীব্র করার জন্য বাঙালি রাজাকাররা তার সারা শরীরে একদফা লবণ মাখিয়ে দেয়, পরবর্তী দফায় তার শরীরে মাখানো হয় লেবুর রস। এভাবেই ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধা চম্পক বাড়াইকের সুঠাম দেহটি নিথর হয়ে আসে। দূর থেকে আদিবাসী চা-শ্রমিকরা একজন মুক্তিযোদ্ধার এই মর্মান্তিক পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছেন কিন্তু কাছে এগোতে পারেননি।
শহীদ শম্ভু সিং ভূমিজ :
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ডেনস্টন চা-বাগানের ফুসকুড়ি ফাঁড়ির আদিবাসী শ্রমিক পিরায় সিং ভূমিজের সন্তান শম্ভু সিং ভূমিজ পাঠশালা পর্যন্তও লেখাপড়া করেছিলেন। তারপর ঐ বাগানের সত্যরঞ্জন টিলাবাবুর বাসায় ফুট-ফরমাস খাটার কাজ করতেন। মৌলভীবাজারের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পাকসেনারা বালিশিরা। ভ্যালি ক্লাবে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। কুখ্যাত পাকিস্তানি সেনা-কর্মকর্তা শের খানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়। বালিশিরা ক্লাবটি উড়িয়ে দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল কিন্তু তাদের কয়েক দফা প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার পর এ দায়িত্ব পড়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধা বালিশিরা ভ্যালি বাগানের এক কর্মকর্তার ছেলে মানিক দেব ও শম্ভু সিং ভূমিজের ওপর।
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ফুলছড়া ও কালিঘাট প্রভৃতি আক্রমণ করলে চা-বাগান জনপদের অনেকেই ভারতে আশ্রয় নেন। সত্যরঞ্জন টিলাবাবু ভারতের পথে পা বাড়ান এবং যাওয়ার সময় শম্ভু সিংকে সাথে নিয়ে যান। শম্ভুর বয়স তখন বিশ-বাইশ। ভারত যেয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লিপিবদ্ধ করেন এবং যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে পরপর কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। শম্ভু সিং পাঁচটি গ্রেনেড নিয়ে রাতের অন্ধকারে ফুসকুড়ি বাগানে প্রবেশ করেন। কিন্তু রাজাকারের মাধ্যমে পাক বাহিনী খবর পায় বাগানে বাইরের লোক প্রবেশ করেছে। রাতে গোটা বাগানে তল্লাশি চলে- অপরিচিত শম্ভু সিংকে পাওয়া যায় সকালে। তাকে বাঁচানোর জন্য কয়েকজন শ্রমিক মহাদেব তাঁতীকে শম্ভু সিংহের নকল পিতা সাজিয়ে পাকিস্তানি সেনা-কর্মকর্তা শের খানের কাছে হাজির করে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই উদ্যোগ সফল হয়, তবে শের খান আদেশ দেয় শম্ভু সিংহকে প্রতিদিন সিন্দুরখান বাজার ক্যাম্পে যেয়ে হাজিরা দিতে হবে।
এটা তার জন্য শাপে বর হয়েছিল। কেন না এ সুযোগে তিনি পাকিস্তানি পতাকা হাতে নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে বালিশিরা ভ্যালির সর্বত্র যেতে পারতেন এবং পাকসেনাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে পাঠাতেন। আবার বিকেলে তিনি সিন্দুরখান বাজারে শের খানের নিকট উপস্থিত হতেন। বালিশিরা ভ্যালী ক্লাব আক্রমণের জন্য নির্ধারিত দিনে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সীমান্তবর্তী অবস্থান থেকে কামানের গোলা ছুঁড়তে থাকে এবং আরেকদল মুক্তিসেনা ক্রলিং করে ক্লাব আক্রমণ করে। এই গ্রুপের সাথে ছিল শম্ভু সিং ভূমিজ। তারা এতটা এগিয়ে যান যে সংঘর্ষ প্রায় হাতাহাতি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। এক সময় একদল সেনা তাকে ধরে ফেলে এবং তার কাছে গ্রেনেড পেয়ে যায়। সংঘর্ষ থামার পর শুরু হয় নির্যাতন। তার শরীরের এক একটা অংশ কেটে কেটে আলাদা করা হয়। এভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা শম্ভু সিং ভূমিজ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।
কাঁকন বিবি :
দেশবাসীর কাছে যিনি মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি নামে পরিচিত তিনিই খাসিয়া মুক্তিবেটি কাকেট। তার জন্ম মেঘালয়ে। কাঁকন বিবিরা ৫ ভাইবোন। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারান। এরপর চলে আসেন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মেঘালয় সীমান্তবর্তী হাওর জেলা সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলার জিরারগাঁও এলাকায়। শৈশবকাল থেকে এখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন। বাবা-মা মারা যাবার পর কাঁকন তার বড় বোনের কাছে বড় হন। তখন পাকিস্তান আমল। সীমান্তবর্তী এলাকায় কর্মরত পাঞ্জাবি সীমান্তরক্ষী আব্দুল মজিদ খানের সাথে পরিচয়, তারপর পরিণয় এবং বিয়ে। বিয়ের পর তার নাম হয়ে যায় নুরজাহান। তার এই দাম্পত্য জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায়, পাঁচ সন্তানের জননী হওয়ার পর স্বামী আবদুল মজিদ অন্যত্র বদলি হয়ে যান এবং এরপর আর তার সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি।
এই দরিদ্র দুস্থ জীবনে বড় বোনের কাছে আশ্রিতা কাঁকনকে পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়। দ্বিতীয় স্বামীর কাঁকনকে বিয়ের আগেই আরো দুটো বউ ছিল।যাই হোক দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে তার মেয়ে সখিনার জন্ম হয়। এই সংসারও তার টিকে না। কারণ দ্বিতীয় স্বামীও আর একজনকে বিয়ে করে আলাদা সংসার করতে চলে যান। তাই আবারও একা হয়ে যান কাঁকন বিবি। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই জীবনযুদ্ধে ৫ সন্তান নিয়ে লড়ছিলেন একাই। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ৪৪ বছর। সেই সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগ্রাম চলছে। দেশকে স্বাধীন করতে হবে, প্রয়োজন একজন সাহসী মানুষের। এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বললেন, যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জানার জন্য প্রয়োজন একজনকে। এলাকার সকলে কাঁকন বিবির নাম প্রস্তাব করলেন। এরপর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও গোটা সময়কালজুড়ে তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের একটি ক্যাম্পের হয়ে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুক্তিসেনাদের দেখাশোনা এবং খাবার ও অস্ত্র যোগান দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ নানা খবরাখবর মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পৌছানোর দায়িত্ব তিনি পালন করেন। অত্যন্ত সফলতার সাথে তিনি কাজগুলো করছিলেন। ৫ দফা সফল অভিযানের পর ৬ বারের সময় পাকবাহিনী তাকে আটক করে এবং তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। তার সারা শরীরে লোহার শিক গরম করে ছ্যাঁকা দেয়। তার কোমরের নিচে পশ্চাদভাগের দুপাশে গরম লোহার শিক ঢুকিয়ে দিয়ে পাক হানাদার বাহিনী বর্বর নির্যাতন চালায়। এ দাগ তার শরীরে এখনো আছে। তবুও সেদিন তার কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য বের করতে পারেনি হানাদার বাহিনীরা। সীমান্তরক্ষী আব্দুল মজিদের কথা বলেন। বলেন- ‘আমার স্বামী একজন পাঠান সৈনিক, আমি মুক্তিবাহিনীর লোক নই।’ হানাদার বাহিনী তখন আব্দুল মজিদের সাথে যোগাযোগ করে তার এ কথার সত্যতা যাচাই করে।পরে নিশ্চিত হয়ে পাকবাহিনী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। কাঁকন বিবি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। একজন সৈনিকের স্ত্রী জেনে পাক হানাদার বাহিনীরাও তাকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে চান।
তাকে একটি পরিচয়পত্র দিয়ে তাদের পক্ষে কাজ করতে বলে। খুশি হওয়ার ভান করে কাঁকন বিবি পাকিস্তানিদের এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান।কারণ তিনি বুঝেছিলেন, এ কার্ড দেখালে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তার কাজ করা সহজ হবে। সেসময় তিনি ৫ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর তত্ত্বাবধানে মহব্বতপুর, কান্দারগাঁও, বসরাই-টেংরাটিলা, বেনিংগাঁও, নুরপুর, সিলাইর পাড়, দোয়ারাবাজার, টেবলাই, তামাবিল প্রভৃতি এলাকায় তিনি যুদ্ধে অংশ নেন। এভাবে তিনি প্রায় ২০টিরও বেশি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাক হানাদার বাহিনীর আগমন ঠেকানোর জনা মুক্তিযোদ্ধারা জাউয়া সেতু উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন কাঁকন বিবি গভীর রাতে কলার ভেলায় জেলে-নারীর ছদ্মবেশে মাইন ও গোলা-বারুদ নিয়ে জাউয়া সেতুর কাছে পৌছান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংকেত পাঠান। তাঁর সংকেত অনুযায়ী সেদিন মুক্তিবাহিনী জাউয়া সেতু উড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। এতগুলো সফল অপারেশনের পর স্থানীয় মানুষ ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় তাকে ‘খাসিয়া মুক্তিবেটি’ নামেও ডাকেন।
জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে তিনি গোপনে অনেক সহায়তা দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ সময়ে এ মহিয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ কেউ রাখেনি। যুদ্ধের পর প্রায় ভিক্ষা করেই দিন কাটাতেন তিনি।
পরে ১৯৯৭ সালে সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসী এ বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা জানতে পারেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে কাঁকন থেকে নুরজাহান পরবর্তীকালে দেশব্যাপী কাঁকন বিবি নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ তাকে গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে। পরবর্তীকালে প্রতিমাসে আর্থিক ভাতার ব্যবস্থা করলেও ২০০২ থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তার আশ্রয় ৬ সন্তানের মধ্যে বেঁচে থাকা মেয়ে সখিনার ঘরে। মেয়ের সংসারেই অভাব আর দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে প্রায় সময়েই অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় তার দিন কাটে। তার সাথে কেউ দেখা করতে গেলে সবাইকে খাসিয়া পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করেন। নিজেও পান খেয়ে ঠোট লাল করা মুখে মিষ্টি কথায়, বাংলা ও খাসিয়া ভাষায়, মুক্তিযুদ্ধের নানা কাহিনীর কথা শোনান। আর বলেন, এ দেশের মানুষের সুখের লাগি আমি যুদ্ধ করছি। কত মা-বোনরে রাজাকাররা আমার সামনে পাকসেনাদের জন্য ধরে নিয়ে গেছে। কত নারীকে যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীরা ধর্ষণ করেছে। অনেককে মেরে ফেলেছে। একথা মনে হলে আমার চোখ জলে ভরে যায়।
এই বীর নারী-মুক্তিযোদ্ধা ২০০৬ সালে দেশের গৌরব বহন করে মুক্তিযুদ্ধ উৎসব কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছিলেন। সেখানে দেশমাতৃকার জন্য তিনি কীভাবে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন সে অভিজ্ঞতার কথা গর্বের সাথে সবাইকে জানিয়ে এসেছেন। আদিবাসী খাসিয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা নারী কাঁকন বিবি নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এখন তার বয়স ৮০-র কোঠায় পৌছেছে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কাঁকন বিবি আজো অত্যন্ত আশাবাদী। দেশকে তিনি সন্তানের মতো লালন করেন। তিনি মনে করেন জীবনের বিনিময়ে যে, স্বাধীনতাকে আমরা পেয়েছি সেটা কখনও লুণ্ঠিত হবে না। তাঁর ভাষায়, দেশের লাগি যুদ্ধ করছি, তোমরা কোনো বিবাদ না কইর্যা দেশটা সাজাও, আমি তোমারে সাহস দিমু দোয়া করমু।
তিনি একজন আদিবাসী বীর সৈনিক। বৃদ্ধ কাঁকন বিবি আজ ভালো নেই। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার এই পরিণতি দেশের ও দেশের মানুষের জন্য কখনই শুভ হতে পারে না। যে কাকন শুভ ও সুন্দরের জন্য লড়েছেন সেই কাঁকন এখন অশুভ’র জালে আষ্টেপৃষ্ঠে সেই ক্ষত নিয়ে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।
শহীদ গুরনা ভর :
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ধলাই চা-বাগানের শ্রমিক গুরনা ভরের পিতার নাম পরদেশী ভর। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন সংবাদদাতা ও গাইড-এর ভূমিকা পালন করেছিলেন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনায়, ধলাই চা-বাগানের যুদ্ধ বহুল আলোচিত। এই যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর পুরো একটা কোম্পানি ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান করতো ধলাই ক্যাম্পে। এই ঘাঁটি আক্রমণে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে ভূমিকা রেখেছিল। অন্যান্যের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ধলাই বাগানের পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প ধ্বংসের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা বারবার আক্রমণ করেও ব্যর্থ হন। টিলার গা-ঘেঁষে তৈরি করা বাংকারের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেত না। কেননা কোনো চা-শ্রমিক কাছে ঘেঁষলে তাদের পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করতো। এই কারণে বাংকারের সঠিক অবস্থান ভাল করে জানার উপায় ছিল না।
চা-শ্রমিক গুরনা ভর জীবনবাজি রেখে ধলাই বাগানে প্রবেশ করেন। ২৯ অক্টোবর ভোরে যুদ্ধ শুরু হয়। ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের চালি কোম্পানি, ডেলটা কোম্পানি ও ব্রাভো কোম্পানি। তিন দিন ধরে যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে বাংকারের অবস্থান নির্দেশের জন্য গুরনা ভর হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বাংকারের ওপরে উঠে সঙ্কেত দিতে থাকেন। কিন্তু দূর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তার সঙ্কেত বুঝতে না পারায় তিনি চিৎকার করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ঠিক তখনি গুলিতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। বহু মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের ফলে ধলাই যুদ্ধে পাক বাহিনীর পরাজয় ঘটে। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার থেকে ৭০ জন বিবস্ত্র নারীকে উদ্ধার করেন, তাদের শারীরিক অবস্থা ছিল বর্ণনাতীত। দেশপ্রেমিক গুন ভর সহ শহীদ অন্যান্য মুক্তিযোদ্বাদের আত্মাহুতির ফলে বীরাঙ্গনাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।মুক্তিযোদ্ধা কেদারলাল হাজরা জানান যে, এ মেয়েদের ওখান থেকে ভারতের কালপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। নিকটবর্তী বাজারের ব্যবসায়ীরা কাপড়-চোপড় দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
রাযোয়া মাহাতো :
আদিবাসী মহাতো সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাযোয়া মাহাতো। বাড়ি জয়পুরহাট জেলার বীরনগর গ্রামে। ১৯৭১ সালে যুবক রাযোয়া মাহাতো বর্তমানে কৃষি শ্রমিক। দারিদ্রের সাথে লড়াই করে কোনোরকমে জীবনপাত করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাতারাতি পরিবারের সবাই মিলে ভারত চলে যান। সাথে কিছু নিয়ে যেতে পারেনি। সব সময় ভয় আর আতংক নিয়ে ভারতে পৌছাল। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেল। কয়েকদিন পর মাইকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার আহ্বান জানানো হল। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাবেন এটা ভাবেননি। তার বাবা একদিন আদেশের মতো করে বললেন- তুমি মুক্তিযুদ্ধে যাও। দেশের জন্য লড়াই কর। দেশকে মুক্ত কর। বাবার আদেশে মুক্তিযুদ্ধে গেল। ট্রেনিং হল গঙ্গারামপুর এবং শিলিগুড়িতে। ট্রেনিং শেষ করে বীরগঞ্জ পাঠানো হল। যুদ্ধ তখন শেষের দিকে। ওখানে কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। ১৬ ডিসেম্বর বীরগঞ্জ ছিলাম। দিনাজপুর শহরে অস্ত্র জমা দিয়ে বাড়ি চলে এল। বাড়ি এসে নতুন করে ঘর করল। নিজের কাজে লেগে গেল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম দিল। এখন ভাতা পান। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সমাজের লোকেরা কিছু সম্মান-মর্যাদা দেয়। ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর পাঁচবিবিতে চিঠি দিয়ে ডাকে।
সালগী খাড়িয়া :
সিন্দুরখান বাগানের চা শ্রমিক বন্ধু খাড়িয়ার বিধবা মেয়ে সালগী খাড়িয়া। ১৯৭১ সালে তার উপর নজর পড়ে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ অঞ্চলের কুখ্যাত পাকসেনা শের খানের। সে সালগী খাড়িয়াকে তুলে নিয়ে যায় এবং জোর করে বিয়ে করে। কিন্তু এই বৈবাহিক সম্পর্কও পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যানিপীড়নের প্রতি সালগীর ঘূণাকে একটুও কমাতে পারেনি। তিনি বরং বহু কৌশলে যোগাযোগ রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। ‘স্বামী’ শের খানের অবস্থা, অবস্থান ও গতিবিধি তিনি নিয়মিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন। বাগানের মুক্তিযোদ্ধা উদয় ভূইয়া ছদ্মবেশে তার সাথে যোগাযোগ করে এসব তথ্য সংগ্রহ করে নিতেন। রাজঘাট চা বাগানের উত্তম কুমার তাঁতীর জীবন সালগী খাড়িয়া বাঁচিয়ে ছিলেন খুব কৌশলে। সে কথা উত্তম কুমার তাঁতী এখনো মনে রেখেছেন। পাক সেনাদের হাতে কেউ ধরা পড়লে শের খান সালগীর কাছে জানতে চাইতেন তিনি চেনেন কিনা।
সালগী বহু অপরিচিত লোককে চেনেন এবং ‘আত্মীয়’ বলে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সালগীর দেয়া তথ্যানুযায়ীই মুক্তিযোদ্ধারা শের খানকে ‘এ্যাকশন’ করে। ধলাই চা বাগানের একটি বটগাছের উপরে তৈরি মাচায় বসে শের খান মাঝেমধ্যে সীমান্ত অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করতো। সালগীর কাছে থেকে সে তথ্য পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে হত্যা করে। অবমুক্ত সালগী এরপর নিজ পরিবারে ফিরে যান।
অজয় বাউড়ী :
১৯৭১ সালে যুদ্ধে অজয় বাউড়ী ছিলেন ১৯ বছরের যুবক। তার পিতার নাম বিজয় বাউড়ী এবং মায়ের নাম কমলা বাউড়ী। তার বড় ভাই মহাদেব বাউড়ী ছিলেন লালচান্দ চা বাগানের শহীদ ১১ জনের একজন, যাদের নামের তালিকা করে হত্যা করা হয়েছিল। ঐ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অজয় বাউড়ী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ত্রিপুরার লোহারবনে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তিনিও রাইফেল, এলএমজি ও মেশিনগান চালাতেন। তিনি টুঙ্গাবাড়ি, আখাউড়া, ফুলতলা, কালেট ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছেন। হরিমুন্ড দাস ছিলেন অজয় বাউড়ীর দলের কমান্ডার, ত্রিপুরা রাজোর হেমনগর এলাকার কদমতলীতে ছিল তাদের হেডকোয়ার্টার। তার সাথে আরো ছিলেন সুরুজ কুমার দত্ত, ক্যাপ্টেন মতিন, আর দু’জন সেনাসদস্য হারুন এবং সাখাওয়াত।
অজয় বাউড়ীর দল বিভিন্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনী চা বাগানে এসে জনসাধারণের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালাতো ও অসভ্য আচরণ করতো। বিশেষ করে মেয়েদের ওপর নিপীড়ন ছিল অপরিসীম। তার চোখের সামনেই তিন-চারজন আদিবাসী মেয়ে ধর্ষিত হয়েছেন। নিরীহ চা শ্রমিকের সমস্ত জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যেত।
তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী বিনা অপরাধে চা-জনগোষ্ঠীর ওপর চালাতো অত্যাচার। রাজাকার বাহিনীর সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল। কুখ্যাত রাজাকারদের মধ্যে ছিল ওসমান গণি ও আবদুল মোল্লা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা ওসমান গণিকে হত্যা করেছিল। আর রাজাকার আবদুল মোল্লা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।
শহীদ রেবতী মাহালী :
খাদিম চা বাগানের শ্রমিক তিন নম্বর বস্তির অধিবাসী যোগীন মাহালীর কন্যা রেবতী মাহালী মাত্র ১৪ বছর বয়সে পাকসেনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। বাগানগুলিতে যখন গণহত্যা চলছিল ঠিক তখন, একদিন পাকসেনারা গুলি করতে করতে খাদিম চা বাগানের শ্রমিক কলোনিতে আসে। সেখানকার পুরুষ শ্রমিকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে আর কলোনির মহিলাদের একটি ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। রেবতীর বাবা সারিবদ্ধ সেই পুরুষদের লাইনে এবং মা আগুনে পুড়ে শহীদ হন। এই দৃশ্য দেখে রেবতী দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা তাকে ধরে প্রকাশ্য স্থানে পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন করে। তার আর্তচিৎকার টিলায় টিলায় প্রতিধ্বনিত হলেও শ্রমিকরা সাহস করে নি সহায়তার জন্য সামনে আসতে। গভীররাতে দু-একজন এগিয়ে এসে তার শরীর এক টুকরা কাপড়ে ঢেকে দেন। ঐ অবস্থায় কয়েকদিন ধুকে ধুকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
শ্রীপ্রসাদ গোয়ালা :
হরিলাল গোয়ালার পুত্র চা-শ্রমিক শ্রীপ্রসাদ গোয়ালা ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। এই বাগানের শ্রমিক ও স্টাফরা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাদের সহায়তায় ১৪-১৫ মে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের কয়েকটি গাড়ি উড়িয়ে দেন এবং ১৯ মে একটি সামরিক বহর ধ্বংস করেন। শ্রীপ্রসাদ গোয়ালা সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হবার পরপরই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ত্রিপুরায় চলে যান এবং ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। তিনি ট্রেনিং পান সিমলা কলোনি ও লোহারবন। চান্দপুর-তেলিয়াপাড়া-সুরমাসাতছড়ি প্রভৃতি বাগানে পাকসেনাদের স্থায়ী ক্যাম্প ছিল, সেখান থেকে প্রায়ই তারা টহলে বেরোত। মুক্তিযোদ্ধারা দফায় দফায় মাইন পেতে রেখে পাকবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি করেছিলেন। কাছেই সীমান্ত থাকার কারণে পাকসেনারা সবসময় চাপের মধ্যে থাকতো।
শ্রীপ্রসাদ ছিলেন খুব সাহসী । একবার তিনি পাকবাহিনীর খাদ্য পরিবহনের একটি গাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে ড্রাইভারসহ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় ক্যাম্পে চলে যান। এছাড়া লালচান্দ চা-বাগানের পাকিস্তানি ম্যানেজার মিয়ালাল পাঠানকে হত্যার ব্যাপারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তবে সেই অপারেশন শেষে ফিরে যাবার পথে দেউড়ী চা-বাগানে তিনি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তার উপর বেয়োনেট চার্জসহ অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। তবে তিন দিন পর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং কোনোক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাতছড়ি ক্যাম্পে পৌছে অজ্ঞান হয়ে যান।
দীর্ঘ অসুস্থতা কাটিয়ে তিনি পুনরায় ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় পান। কিন্তু তিনি ফিরে যান যুদ্ধক্ষেত্রে এবং ২ রজকী-রেহানা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গাজীপুর বাগানের ভয়াবহ যুদ্ধেও তিনি অংশ নেন। সেই যুদ্ধে উভয়পক্ষে বহু সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী শেষাবধি এখানে পরাজিত হয়েছিল।
যুদ্ধ শেষে শ্ৰীপ্রসাদ গোয়ালা, নিলু চাষা ও রাজারাম রাজপুত পলায়নপর চারজন পাকসেনাকে জীবিত অবস্থায় পাকড়াও করে চুঙ্গাবাড়ি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যান।
তেরেসা মাহাতো :
বাংলাদেশের এক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাম মাহাতো। উত্তরবঙ্গের সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট ও রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে এদের বসবাস। এই জনগোষ্ঠীরই এক বীর মহিয়সী নারীর নাম তেরেসা মাহাতো। ১৯৫১ সালে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাটের রাজবাড়ির শীতল গ্রামে তাঁর জন্ম। কৃষক পিতা যহন গনো এবং মাতা জলেশ্বরীর প্রথম সন্তান তেরেসার পড়াশোনা শুরু হয় দিনাজপুরর সেন্ট ফিলিপস স্কুলে। ১৯৭০ সালে এই স্কুল থেকেই তিনি এসএসসি পাস করেন। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল স্রোতে চরাচর বিস্তৃত, তখন তিনি দিনাজপুর পিটিআইতে ট্রেনিংরত। বচনায় তখন পিটিআই’র ছাত্রীদের নার্সিংয়ে প্রশিক্ষণের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয় মিশন হাসপাতালে। ২৫ মার্চ রাতে দেশব্যাপী হায়েনাদের নির্বিচারে নিধনযজ্ঞ চললে তেরেসাও তাতে আক্রান্ত হন।
তার হাত, পা ও মাথায় গুলি লাগে পাকসেনাদের। এই অবস্থায় কিছুদিন অতিবাহিত করার পর তেরেসা সুস্থ হবার আগেই রত হয়ে যান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবায়। এভাবেই তেরেসা প্রাণের আবেগে জড়িয়ে যান মুক্তির মহান যুদ্ধে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ১৯৭২ সালে মরিয়মপুর মিশন স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তেরেসা মাহাতোর । দীর্ঘদিন এখানেই চাকরি করে ২০০২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জননী। তার স্বামীর নাম সুভাষ মাহাতো। বাবনী রাজগৌড় বাবনী রাজগৌড়ের স্বামী গৌড়া রাজগৌড় ছিলেন কমলগঞ্জের পাত্রখোলা চা বাগানের শারীরিক শিক্ষা প্রশিক্ষক। বাবনী রাজগৌড় এই বাগানেরই শ্রমিক হিসেবে নিয়েজিত ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে স্বামীর ডাক পড়লে বাবনীও তাতে সংযুক্ত হন। চা বাগানের ঘরে ঘরে সংগ্রহ করতেন যুদ্ধে সহায়ক তথ্যাবলি। কিন্তু অচিরেই যুদ্ধের সাথে মনেপ্রাণে জড়িয়ে যাওয়া এই দম্পতি শিকার হন ষড়যন্ত্রের। স্থানীয় রাজাকারদের ইন্ধনে একদিন তাঁদের ঘরের দরজায় আঘাত হানে পাক হায়েনার দল। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে টেনে-হিচরে নিয়ে যায় স্বামীসহ বাবনী রাজগৌড়কে। এক অপরিসীম অসহায়ত্ব নিয়ে রয়ে যায় তার দুটি শিশুকন্যা। এই ঘটনার ১ মাস পর জানা যায়, বাবনীকে তাঁর স্বামীর সাথে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীমঙ্গল আর্মি কোয়ার্টারে। ক্যাম্পের সামনে বটগাছের সাথে বেধে ব্রাশ ফায়ার কাছে হয় তাদের। কিন্তু তাদের মৃতদেহ আর পাওয়া যায়নি। এই শহীদ দম্পতির রেখে যাওয়া ২টি কন্যা সন্তানের একজন স্বাধীনতা- উত্তর সময়ে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যান।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা জাতির আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের বীরত্বপূর্ণ অবদান
কোম্পানি কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা :
১৯৭১ সালে রামগড় ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম মহকুমা সদর এবং এই এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ট্রেনিং গ্রহণের ব্যাপারে যারা উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ি এবং ২ মে রামগড় মহকুমা সদর এলাকা দখল করে। দখলের পর তারা রামগড়, গুইমারা, মানিকছড়িসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে আদিবাসী বহু রমণীকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণের পর উলঙ্গ অবস্থায় বন্দি করে রাখে। এই অবস্থায় তারা রমণীদের ক্যাম্প সংলগ্ন ফেনী নদীতে গোসল করতে নিয়ে যেত। এ দৃশ্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম থেকে বেশ কয়েকদিনব্যাপী প্রত্যক্ষ করা গেছে।
ওপার থেকে জনতা চিৎকার করে প্রতিবাদ জানালে তাদেরকে নদীতে নামানো বন্ধ হয়। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা রামগড় পতনের পর ২৫ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে ভারতের হরিণা ক্যাম্পে যান। সেখানে যাওয়ার পর ৪০ জনের একটি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত করে তাকে ভারতে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অম্পিনগরে প্রেরণ করা হয়। সেখানে ২ মাস গেরিলা আক্রমণের কলাকৌশলসহ রাইফেল, এসএলআর, এসএমজি, এলএমজি, হ্যান্ড গ্রেনেড, হাই এক্সপ্লোসিভ এবং কমান্ডো ট্রেনিং গ্রহণ করেন।
রাতের অন্ধকারে তাঁদের টার্গেট প্র্যাকটিস দেয়া হয়। প্রশিক্ষণশেষে জুলাই মাসে রামগড় মহকুমার সব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একত্র করে বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত করে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়। উক্ত কোম্পানির অধিনায়ক করে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরাকে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার অভ্যন্তরে, গেরিলা অপারেশন এবং পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়। ১ নং সেক্টরের অধীনে হরিণা থেকে ৩০ কি. মি. দূরবর্তী সীমান্ত এলাকা ভারতের বৈষ্ণবপুরে একাত্তরের আগস্ট মাসের প্রথমদিকে সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়।
সেখানে অবস্থানরত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার জন্য হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরাকে কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। প্রায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা ছিল তাঁর অপারেশন ক্ষেত্র। ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিপুরা রাজ্যের বৈষ্ণবপুর ও বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা রামগড় মহকুমা হয়ে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলে নিরাপদে প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা পালন করেন। যার ফলে, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে যেমন হরিণা, উদয়পুর, আগরতলা, অম্পিনগর, শলিছড়ি, দেমাগ্রী ইত্যাদি ট্রেনিং সেন্টার থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে নিজ নিজ এলাকায় অপারেশন পরিচালনার জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম মহকুমার বৈষ্ণবপুর সাব-সেক্টর হয়ে রামগড় সীমান্ত অতিক্রম করে চট্টগ্রাম, বক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ অন্যান্য অঞ্চলে গোপনভাবে ও নিরাপদে পারাপারে সক্ষম হন।
এই কাজে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা কোম্পানির গেরিলা বাহিনী ও রামগড় মহকুমার আদিবাসী হেডম্যান কার্বারীসহ আদিবাসী যুবকগণ সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে নাকাপা, কুমারীপাড়া, পাগলাপাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যোগ্যছলা ও গাড়িটানা এলাকার গহীন অরণ্যে গোপন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এই গেরিলা ক্যাম্পগুলোতে ঐ এলাকার আদিবাসী হেডম্যান কারবারীসহ সকল স্তরের জনগণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করেছিলেন। এখান থেকে পাকবাহিনীর গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করে পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ এবং গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করা হতো।
কোম্পানি কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা প্রথম গেরিলা অপারেশন করেন ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের ৫ তারিখ রামগড় নাকাপা এলাকায়, তিনি বাংলাদেশ এফএফ ফোর্স গ্রুপ নম্বর ৯১-এর ১৬ জন সদস্য নিয়ে রামগড়ে পাকবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের বিভিন্ন অবস্থান রেকি করেন এবং উক্ত এলাকায় গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা করেন।
এখানে তিনি পাকবাহিনীর একজন সহযোগীকে আটক করেন। সেই পাক সহযোগিকে হরিণা ক্যাম্পে সোপর্দ করা হয় বিচারের জন্য। এই অপারেশনে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার সহযোগী যোদ্ধারা হচ্ছেন রঞ্জিত দেববর্মণ, সমরকৃষ্ণ চক্রবর্তী, ধীমান কান্তি বড়ুয়া, ভুবন ত্রিপুরা, নীলা মোহন ত্রিপুরা প্রমুখ। ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট পুরো এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাসহ হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা রামগড়ে পাকবাহিনীর সদর দপ্তরে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এখানে প্রায় ১ ঘণ্টা পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর গুলিবর্ষণ করে পাকবাহিনীকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করেন। এই অপারেশনে এলএমজি, এসএলআর, এসএমজি এবং রাইফেল ব্যবহার করা হয়। এই অপারেশনে আরো ছিলো; মুক্তিযোদ্ধা রণ বিক্রম ত্রিপুরা, রণজিৎ দেব বর্মণ, সমর চক্রবর্তী, ধীমান বড়য়া, ভুবন ত্রিপুরা, নীলা মোহন ত্রিপুরা প্রমুখ।
বৈষ্ণবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের পাশ থেকে দুজন গুপ্তচরকে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ গ্রেফ্তার করা হয় এবং তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করে এই দুজনকে হরিণা ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়। ১০ সেপ্টেম্বর মানিকছড়ি থানার অন্তর্গত ডাইনছডির চেম্প্রপাড়া এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ১২ জনের এক দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা সেখানে আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে ১টি এলএমজি, ১০টি এসএলআর, বেশকিছু হ্যান্ড গ্রেনেড ও গুলি এবং তার এসএমজি ব্যবহার করেন। মানিকছড়ি রাজবাড়ি পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি এবং হেডকোয়ার্টার ছিল। পাকবাহিনীর অবস্থানকে রেকী করার জন্য ২ জন যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন এবং দূর থেকে দেখলেন মারমা গ্রামে পাকবাহিনীরা পজিশন নিচ্ছে।
হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা আরো দেখলেন যে, পাকবাহিনীরা তাদের খুব কাছাকাছি ৫০ গজের মধ্যে এসে পড়েছে । তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা দেরি করে অটোমেটিক এসএমজি, এলএমজি একসাথে ওপেন করেন এবং অনবরত গুলি বর্ষণ করতে লাগলেন। পাকবাহিনী ৫০-৬০ জনের একটি বৃহৎ বাহিনী এবং তাদের কমান্ডার ক্যাপটেন ছিল ঘোড়ায় চড়া। তাদের সাথে অস্ত্রশস্ত্র ছিল মর্টার, এলএমজি, অটোমেটিক চায়নিজ রাইফেল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ব্রাশ ফায়ারের সাথে সাথে ক্যাপ্টেন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিচে পড়ে যায় এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা মরিয়া হয়ে ওপার থেকে গুলি বর্ষণ ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। একটি গোলা হেমা রঞ্জন ত্রিপুরার এক হাতের ব্যবধানে এসে পড়ে। তবে জায়গাটা সঁতসেঁতে ছিল বলে তা বিস্ফোরিত হয়নি। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে যান। সেদিন প্রায় আধাঘণ্টা পাহাড়ের পাদদেশে এবং পাহাড়ের ওপর থেকে পাকবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ১২ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে খতম করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে হিট অ্যান্ড রান গেরিলা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এবং এমুনিশান প্রায় শেষ হওয়ার পূর্বেই সেই স্থান ত্যাগ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হয়নি। অতঃপর পাকবাহিনীরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে মারমা গ্রামে আগুন ধরিয়ে গ্রামটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে। সেখানে প্রায় ১০০ মারমা পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা আশ্রয়হীন আদিবাসীদের সেইদিন রাতেই ভারতের আশ্রয় শিবিরে নিয়ে আসেন এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। অতঃপর ১ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর ভারতের হরিণা ক্যাম্পে লিখিতভাবে অপারেশনের বিবরণ দাখিল করেন। নাকাপা ব্রিজের টিলার উপর রোড ডিভিশনের একটা ছোট্ট বাংলোতে পাকবাহিনী ক্যাম্প খুলেছিল। কিছুটা দূরে গুইমারাতে পাকবাহিনীর একটা হেডকোয়ার্টার ছিল। নাকাপা পাক আর্মি ক্যাম্পটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিপজ্জনক ছিল বিধায় হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা এই ক্যাম্পটি আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ২০ জনের একটি দল গেরিলা প্রশিক্ষণের জনারামগড়ে নাকাপা এলাকা অতিক্রম করে ভারতের বৈষ্ণবপুর সাব-সেক্টরের দিকে এগিয়ে আসার সময় পাকবাহিনী তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে তাদের ৫ জন আহত হন। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা তাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের বিএসএফ-এর কাছে নিয়ে যান এবং এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই ১০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রুপ নিয়ে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা নাকাপা পাক আর্মি ক্যাম্প আক্রমণ করেন।
তিনি পাগলাপাড়া গোপন ক্যাম্প হয়ে অগ্রসর হন। সেখান থেকে ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম জেলা থেকে আসা ৮-১০ জনকে সাথে নিয়ে নেন। সেদিন সূর্য ডুবার পূর্বেই নাকাপা আর্মি ক্যাম্পের কাছে এসে ক্যাম্প লক্ষ্য করে কয়েকটি ব্রাশফায়ার করেন। পরের দিনই পাকবাহিনীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে স্থানটি ত্যাগ করে।
অক্টোবর মাসের ৭ তারিখ যোগ্যছলা এলাকাতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা একটি সম্মুখযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই এলাকায় গুপ্ত আশ্রয় কেন্দ্রগুলিতে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ৭ তারিখ সকাল ৮টার সময় হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা ইনফরমারের মাধ্যমে জানতে পারেন প্রায় ৫০-৬০ জনের একটি বিরাট পাকবাহিনীর দল যোগ্যছলা এলাকার দিকে এগিয়ে আসছে। এই সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে হেমা রঞ্জন ত্রিপুরা তার সঙ্গীদের নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে পজিশন নিতে নির্দেশ দেন এবং কে কোথায় পজিশন নিবে তা দেখিয়ে দেন। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা লাইট মেশিনগান, এসএমজি, এসএলআর, রাইফেল এবং হ্যান্ড গ্রেনেড ব্যবহার করেন। টিলা থেকে তিনি দেখছিলেন শত্রুপক্ষ লম্বা লাইন ধরে এগিয়ে আসছে, সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাশ ফায়ার করেন, প্রায় ২০ মিনিট গোলাগুলি বিনিময়ের পর ৯ জন পাকসেনা খতম হয়। বাকিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হয়নি। একাত্তরের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে রামগড় মহামুনি এলাকায় এক সফল গেরিলা অপারেশনে ১ জন কর্নেলসহ ১৭ জন পাকসেনাকে হত্যা করা হয়।
এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ব্যবহার করেন। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বাধীন কোম্পানির রামগড় এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রঞ্জিত ত্রিপুরা ও রাজেন্দ্র ত্রিপুরা এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে যোগ্যছলা থেকে ৩ কিমি দূরবর্তী গুপ্তকেন্দ্র গাড়িটানা নামক স্থানে ৪০ জনের ওপর একটি মুক্তিযোদ্ধার দল দিয়ে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা পাকবাহিনীর উপর সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ প্রতিহত করেন। সেদিন ভোর ৪টার দিকে পাকবাহিনীর গুলির শব্দ যেখান থেকে আসছিল ঠিক সেই দিকে তাক করে মুক্তিযোদ্ধারা একটানা এলএমজি চালান। কিছুক্ষণ পর ওপারের গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হলে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুবাহিনীর দিকে অগ্রসর হন। সেখানে যেয়ে দেখেন পাকবাহিনী সরে পড়েছে। তবে এই যুদ্ধের পর ৪ জন মুক্তিযোদ্ধার হদিস পরবর্তীকালে পাওয়া যায়নি।
১৯৭১ সালের ৬ এবং ৭ ডিসেম্বর রামগড়ে পাকবাহিনীর অবস্থানে যৌথবাহিনীর পক্ষে বিমান আক্রমণ চালানো হয়। পাকবাহিনী রামগড় হেডকোয়াটার ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং ৮ ডিসেম্বর বিকাল ৪টার দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রামগড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানো হয়। পুরো ৭ মাস ৬ দিন রামগড় হানাদার বাহিনীর অধিকারে ছিল। পাকবাহিনী রামগড় হেডকোয়াটার ছেড়ে যাবার পূর্বে পুরো বর্ডার এরিয়া এবং বিভিন্ন জায়গায় এন্টি পার্সোনাল মাইন পুঁতে রেখে যায়।
রণ বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা :
আদিবাসী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রণ বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। পিতার নামঃ বরেন ত্রিপুরা। জন্ম ১৯৫১ সালে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়ে। শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন রাঙামাটি জেলায়। রাঙামাটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন এবং রাঙামাটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক অধ্যয়নকালে যোগ দেন ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে। শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘর ছাড়েন কিশোর রণ বিক্রম। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আর ঘরে ফেরেন নি তিনি। ৭ মার্চের ভাষণের পর রণ বিক্রম পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টারে যোগ দেন।
২৫ মার্চের সেই ঘৃণিত হত্যাষজ্ঞের কালো রাতে তিনি পুলিশ বাহিনীর সাথে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টিতে অংশ নেন। এরপর রাঙামাটিতে পাকিস্তানিরা প্রবেশ করলে তিনি তাঁর দলের সাথে পথে পথে যুদ্ধ করতে করতে চলে যান খাগড়াছড়িতে। এখান থেকে এক গ্রুপ মাটিরাঙা হয়ে রামগড় এবং অন্য গ্রুপ মহালছড়ি হয়ে রামগড় যায়। সে সময় মহালছড়ি ও বুড়িঘাটে পাক বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় । বুড়িঘাটের সেই যুদ্ধেই শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন। অন্যদিকে, মহালছড়িতে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী মিজো বাহিনীর আক্রমণে শহীদ হন ক্যাপ্টেন আবদুল কাদির। এরপর পাকিস্তানিদের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় রামগড়ে। রামগড়ের যুদ্ধ শেষে রণ বিক্রম প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে রামগড় হয়ে ভারতের সাব্রুম-এ যান। সেখান থেকে ১৯-২০ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে মে মাসের প্রথমদিকে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। দেশে ফিরে অংশ নেন পাতাছড়ি, সোনাইপুর, যুগাছোলা, গাড়িটানাসহ বেশ কয়েকটি অপারেশনে। অপারেশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল যুগাছোলা অপারেশন।
পাক বাহিনীর আক্রমণে তিনি সেদিন ১ জন সহযোদ্ধা হারিয়েছিলেন। তবে সেই অপারেশনে পাকসেনাদের ২০-২৫ জন নিহত হয়েছিল। এরপর গোলা-বারুদ আনার জন্যে পুনরায় ভারতে গেলে দেখা হয় আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, এস এম ইউসুফের সঙ্গে। তারা রণ বিক্রমকে শরণার্থী শিবির থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের জন্যে রিক্রুটিং অফিসারের দায়িত্ব দেন। এ দায়িত্ব নিয়ে তিনি শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেন কয়েকশত ছাত্র ও যুবক। এদেরকে তিনি প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্যে নিয়ে যান অলিনগর কাম্পে। কিছুদিন পর নতুন আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে আসেন গাড়িটানা ক্যাম্পে। তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে আবার ভারতে যান। সেখানকার দেরাদুনে দেড়মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। তখন ডিসেম্বর মাসের প্রথম পর্যায়।
ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পাকিস্তানিরা তখন কোণঠাসা। রণ বিক্রম তাঁর দল নিয়ে রামগড় থেকে হিয়াকু পর্যন্ত পাকবাহিনীর পেছনে অবস্থান নেন। একের পর এক অঞ্চল শত্রুমুক্ত করতে থাকে তার দল। বিজয়ের সন্ধিক্ষণে ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর তারা মুক্ত করেন মানিকছড়ি ও গাড়িটানা, অঞ্চল। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ঘোষণার পরও তারা বিকেল পর্যন্ত পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে মুক্ত করেছিলেন মানিকছড়ি। যুদ্ধ শেষে ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখে রাঙামাটিতে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন তিনি। রণ বিক্রমের পিতা বরেন ত্রিপুরা ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তাঁর বোনের স্বামীও এ সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই অস্থির দিনগুলোতে। এছাড়াও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর সময় রণ বিক্রম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু খুন হলে তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারাবরণ করেন।
শিকার হন জেলখানায় অমানুষিক নির্যাতনের। জিয়ার সামরিক শাসনের সময়ে টর্চারিং সেলে চট্টগ্রামে ২১ দিন এবং ঢাকায় ২ মাস বন্দি অবস্থায় তার উপর করা হয় অকথ্য অত্যাচার। এরপর বিশেষ ক্ষমতা আইনে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ঢাকায় সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকেন। সে সময়ে হাইকোর্টে রিট করে ২ বছর ৮ মাস আটক থাকার পর মুক্তিলাভ করেন।
তথ্য সূত্র: রোয়ার মিডিয়া, জুম জার্নাল