পিরিয়ড বা মাসিকের মত একটা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে লজ্জা আর সংকোচের শেষ নেই বাংলাদেশের সমাজে। গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে নারী স্বাস্থ্য, বিশেষ করে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পিরিয়ড বা মাসিকের সময়ে পরিচ্ছন্নতা বা নিরাপদ ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে নানা রকম অসুখবিসুখও হচ্ছে। ববিংশ শতাব্দীর এই সময়েও পিরিয়ড আমাদের দেশে একটি ট্যাবু। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে সবাই খুব অস্বস্তিতে পড়ে। সমাজের প্রতিটি স্তরেই এটি দেখা যায়। এমনকি বাংলাদেশের নারীরা নিজেদের ভেতর পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে স্বস্তি বোধ করেন।
এই ট্যাবু বাংলাদেশের নারীদের পিরিয়ডের সময়কে চ্যালেঞ্জের ভেতর ফেলে দিয়েছে। এ কারণে মানুষ এ সময়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার গুরুত্ব সম্পর্কে অতটা অবগত নয়, যতটা হওয়া দরকার। পিরিয়ডের সময়ের অপরিচ্ছন্নতার জন্য নানা ধরনের মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। যেমন ইউরিন ইনফেকশন, যোনিপথের ইনফেকশন, জরায়ুমুখের ক্যানসার ইত্যাদি।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ কিশোরী মেয়েদের ইউরিন ইনফেকশন হয় পিরিয়ডের সময় ঠিকমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকার জন্য। আর প্রায় ১১ বছর আগের করা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের ভেতর জরায়ুমুখের ক্যানসারের অবস্থান দুই নম্বরে। এ ঝুঁকিতে আছে আমাদের দেশের প্রায় পাঁচ কোটি নারী। আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা এজেন্সির তিন বছর আগে করা এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি নারী জরায়ুমুখের ক্যানসারে মারা যাচ্ছেন। এ দেশের জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে ৯৭ শতাংশের ক্ষেত্রে রোগের কারণ পিরিয়ডকালীন পরিচ্ছন্নতার অভাব।
বাংলাদেশের নারীরা পিরিয়ডের সময় দুই ধরনের স্যানিটেশন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং পুরোনো কাপড়। ২০১৪ সালের ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভেতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৬ ভাগ নারী পিরিয়ডের সময় পুরোনো কাপড়, ন্যাকড়া ব্যবহার করেন। পুরোনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহারে এগিয়ে গ্রামাঞ্চলের নারীরা। এর প্রধান কারণ, এটি সহজলভ্য এবং এর জন্য কোনো প্রকার খরচ হয় না।
এদিকে কয়েকটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে গ্রামাঞ্চলে থাকা একজন নারী মাসে গড়ে ১৫০ টাকা ব্যয় করেন মুঠোফোন সংযোগের পেছনে। (ঢাকা ট্রিবিউন, ১২ মার্চ ২০২১; ডেইলি স্টার, ২২ জুন ২০১৭) অথচ এর চেয়ে অনেক কম খরচে তাঁরা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁদের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।
এর পেছনে প্রধান কারণটি হলো, ব্যাপক সচেতনতার অভাব। গ্রামে বসবাসরত নারীরা পিরিয়ডের সময়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। শহরের স্কুলের মতো গ্রামের স্কুলগুলোতে এ ব্যাপারে তেমন আলোচনা করা হয় না। গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মীরা মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করলেও পিরিয়ড বা মাসিক নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কিছুই করেন না।
গ্রামের নারীরা পিরিয়ডের সময় বারবার ধুয়ে পুরোনো কাপড় ব্যবহার করেন। লোকলজ্জার ভয়ে তাঁরা কাপড়গুলো ঠিকমতো রোদে শুকাতে পারেন না। এ জন্য এতে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি ভয়ংকর আকারে বেড়ে যায়। অন্যদিকে দরিদ্র নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাঁরা স্যানিটারি ন্যাপকিন সম্পর্কে জানলেও কেনার সামর্থ্য রাখেন না।
মাসিক নিয়ে শহরের নারীদের ভেতর জড়তা দিন দিন কাটছে। কিন্তু গ্রামের চিত্র ঠিক উল্টো। এ সমস্যা কাটানোর জন্য এগিয়ে আসতে হবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। গ্রামে গ্রামে বাড়াতে হবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। এ ক্ষেত্রে মিডিয়াও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। গ্রামীণ নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে এবং এর বিপরীতে কী ঘটতে পারে, সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিতে হবে। তবে এখানে সরকারি উদ্যোগ, নীতিসহায়তা ও সমর্থন বেশি জরুরি। এ ছাড়া এ পরিস্থিতি রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয়। দরিদ্র নারীদের বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে তাঁরা মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারেন।