আগের তুলনায় এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে এখন অনেকেই একাকিত্বে ভুগছেন। এমনকি বিশ্বব্যাপী মহামারী আঘাত হানার আগে, একটি সুস্পষ্ট বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে বিভিন্ন দেশে মানুষের একাকিত্ব একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং উপেক্ষিত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শিল্পোন্নত বিশ্বে অতীতের অধ্যয়নগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে নিঃসঙ্গতা বাড়ছে, কিন্তু ভৌগলিক অঞ্চলের সাথে কীভাবে এটি সম্পর্কিত তা তুলনা করে বলা কঠিন।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহামারী বিশেষজ্ঞ মেলোডি ডিং বলছেন, ‘একটি সাধারণ ধারণা থেকে বলা যায় যে প্রায় ১২ জনের মধ্যে ১ জন এমন এক স্তরে একাকীত্ব অনুভব করে যা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে তাঁকে পরিচালিত করতে পারে। তবে এই ধরনের তথ্যের উত্স অস্পষ্ট এবং গবেষকরা কখনই প্রতিষ্ঠিত করেননি যে বিশ্বব্যাপী একাকীত্ব কতটা ব্যাপক। তাই আমরা বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করতে আগ্রহী ছিলাম”। ডিং এবং তার সহকর্মীরা তাই ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১১৩টি দেশ বা অঞ্চল থেকে একাকীত্বের উপর ৫৭ টি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা একসাথে সম্পাদন করেছেন।
গবেষক দলটি জানাচ্ছেন, একাকীত্ব মন এবং শরীর সম্পর্কিত, তাই ফলাফলগুলি জনস্বাস্থ্যের উদীয়মান সমস্যাগুলি প্রকাশ করতে সাহায্য করতে পারে যেগুলিকে আরও ভালভাবে সমাধান করা উচিত।
বৈশ্বিক একাকীত্ব পরিলক্ষিত হয়েছে বেশিরভাগ দেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে। ৭৭টি দেশে অনুসন্ধান চালানোর পর দেখা গেছে, একাকিত্বের সমস্যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৯.২ শতাংশ থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ১৪.৪ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, ইউরোপীয় অঞ্চলে মেটা বিশ্লেষণের জন্য শুধুমাত্র পর্যাপ্ত ডেটা ছিল।
বিশ্বের এই কোণে, লেখকরা আবার ভৌগলিক পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। উত্তর ইউরোপীয় দেশগুলিতে নিঃসঙ্গতার হার সবচেয়ে কম ছিল, মাত্র ২.৯ শতাংশ। এই অঞ্চলে ২.৭ শতাংশ মধ্যবয়সী প্রাপ্তবয়স্করা একাকিত্ব অনুভব করার কথা জানিয়েছেন। বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্করা, ৬০ বছরের বেশি যাদের বয়েস তাদের ৫.৩ শতাংশ একাকীত্ব অনুভব করেছেন। অন্যদিকে, পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলি ইউরোপের অন্য যে কোনও জায়গার তুলনায় একাকীত্বের বেশি লক্ষণ দেখিয়েছে।
পূর্ব ইউরোপের তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের ৭.৫ শতাংশ একাকীত্বের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন, এই অঞ্চলে মধ্যবয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের ৯.৬ শতাংশ একাকীত্বের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন। ইউরোপের এই অংশে বয়স্করা আগে থেকেই একাকিত্বে ভুগছিলেন, সংখ্যাটাও উদ্বেগজনক ২১.৩ শতাংশ। তবে একটি বিষয় বলা কঠিন, এই ডেটা আমাদের বলতে পারে না কেন পূর্ব ইউরোপে সামগ্রিকভাবে নিঃসঙ্গতার অনুভব বাড়ছে। এক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমগুলিকে আরো জোরদার করার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে একাকীত্ব বোঝার জন্য বেশিরভাগ দেশের ডেটা প্রয়োজন- তবে, ইউরোপের বাইরের বেশিরভাগ অঞ্চলে ডেটার অভাব রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে যে বিপজ্জনক SARS-CoV-2 ভাইরাসকে দূরে রাখার জন্য সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ব্যবস্থাগুলি সম্ভবত একাকীত্ব, বিষণ্নতা, ক্ষতিকারক অ্যালকোহল, ড্রাগ ব্যবহার এবং আত্মঘাতী আচরণের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।
এই গবেষণা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট একাকিত্ব যেকোনো বয়েসের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্ব প্রকৃতপক্ষে সিগারেটের মতোই ক্ষতিকারক, যা মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারির তথ্যে দেখা গেছে যে আগের বছরের তুলনায় আজ অনেক বেশি তরুণ এবং মধ্যবয়সী মানুষ একা বাস করছে। কিন্তু ইউরোপীয় পর্যালোচনায় মনে হয় বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্করা, যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি, তারা সবচেয়ে তীব্র একাকিত্বের অনুভূতিতে ভোগে।
যখন আমাদের জীবন আক্ষরিক অর্থে অন্যদের সাথে সংযোগের উপর নির্ভরশীল তখন এটি দুৰ্ভাগ্যজনক যে এতদিন একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে বিশদে কোনো গবেষণা করা হয়নি। এখন, বৈশ্বিক মহামারী আমাদের এই সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে যেমনটি আগে কখনো হয়নি, এবং ডিং-এর মতো গবেষকরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন যাতে আমরা ভবিষ্যতের বিষয়ে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
আইরিশ এবং যুক্তরাজ্যের একটি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দল নতুন গবেষণার সাথে যুক্ত একটি সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, সামাজিক পরিকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলি যেমন দারিদ্র্য, শিক্ষা, বৈষম্য, বাসস্থান এগুলির দিকে নজর দিলে এবং সঠিক নীতির বাস্তবায়ন করলে একাকীত্বের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। ”অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং কাজের পরিবেশের পরিবর্তন একাকিত্বের মোকাবেলা করতে পারে।
সূত্র: www.sciencealert.com