বর্তমানে ডায়াবেটিস বা সুগার শব্দটি আমাদের সবার কাছে খুবই পরিচিত। মানবদেহে সচরাচর আমরা যে সকল রোগের নাম শুনে থাকি তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। কারণ এই ডায়াবেটিস মানবদেহে একবার জায়গা করে নিলে সেটি মানুষকে ধীরে ধীরে কষ্ট দিতে থাকে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশে বা প্রায় প্রতিটি পরিবারেই ডায়াবেটিসে ভুক্তভোগী মানুষের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। ডায়াবেটিসের কারণে পক্ষাঘাত, চক্ষুসমস্যা, হৃদরোগ, পচনশীল চর্মরোগ, পুরুষের যৌন অক্ষমতা এমনকি মহিলাদের ক্ষেত্রে মৃত শিশুর জন্ম দেওয়া, বেশি ওজনের শিশু জন্ম দেওয়া, অকাল সন্তান প্রসব এরকম বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। যারা ডায়াবেটিস রোগে যারা আক্রান্ত তারা ডায়াবেটিস কমানোর উপায় জানতে চান।
ডায়াবেটিস কমানোর উপায় জানার আগে চলুন ডায়াবেটিস কি সেটা আগে জেনে নেই –
ডায়াবেটিস কি ?
ডায়াবেটিস যার অর্থ হচ্ছে বহুমূত্র। ডায়াবেটিস হচ্ছে আমাদের শরীরের এমন এক মেটাবলিক রোগ, যা হলে শরীরে গ্লুকোজ বা সুগারের মাত্রা খুব বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এটি কিডনি ডেমেজ,হার্ট এর্টাক,স্ট্রোক ইত্যাদি বহু রোগের জন্য এটি দায়ী। ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যাকে ডায়াবেটিস মেলিটাস বলে। ডায়াবেটিস এর কারণে মূলত আমাদের রক্তে গ্লুকোজ বা সুগারের পরিমাণ অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে যায়।
ডায়বেটিস হওয়ায় আপনার শরীর ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা কার্যকর ভাবে ব্যবহার করতে পারে না। স্ট্রোক, হার্ট ডিসিজ, কিডনি ইত্যাদি বিভিন্ন রোগের জন্য এই ডায়াবেটিস মেলিটাস দায়ী।
ডায়াবেটিস কত প্রকার?
ডায়াবেটিস ২ প্রকার হয়ে থাকে। যথাঃ
ডায়াবেটিস টাইপ-১ এবং
ডায়াবেটিস টাইপ-২।
ডায়াবেটিস টাইপ-১
এ ধরনের ডায়াবেটিস বেশিরভাগ কম বয়সী বা 20 বছরের কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে হয়ে থাকে। আর এটি ডায়াবেটিসে টাইপ ১ ইনসুলিন শরীরে তৈরি হয় না।
ডায়াবেটিস টাইপ-২
এ ধরনের ডায়াবেটিস বেশিরভাগ ব্যক্তিদের হয়ে থাকে। আর এটি ডায়াবেটিসে টাইপ ২ ইনসুলিন শরীরে তৈরি হয়। তবে এটি শরীরে সঠিকভাবে কাজ করে না।
ডায়াবেটিস কেন হয় ?
আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তা মুলত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা। আর এই শর্করাই হচ্ছে গ্লুকোজ এর উৎস। রক্তে গ্লুকোজ প্রবশের পরেই শুরু হয় ইনসুলিনের কাজ। ইনসুলিন এক ধরনের হরমোন যা গ্লুকোজকে মানুষের দেহের কোষগুলোতে পৌঁছে দেয়। সেই গ্লুকোজ থেকেই শক্তি উৎপাদন হয়। এখন যদি কোনও কারণে স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলে তাহলে রক্তে গ্লুকোজ এর মাত্রা বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস রোগের লক্ষণ
♦ শরীরে দূর্বলতা অনুভব করা।
♦ ঘন ঘন প্রসাব অনুভূত হাওয়া।
♦ ক্ষুদা বৃদ্ধি পাওয়া।
♦ ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে হাইপো হয়।
♦ অহেতুক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া।
♦ মিষ্টি দ্রব্যাদির ওপর আকৃষ্ট হাওয়া।
♦ শরীরের ক্ষত স্থান দীর্ঘদিন থাকা সত্বেও নিরাময় না হাওয়া অর্থাৎ ক্ষতস্থান পুরন না হাওয়া।
♦ চামড়া শুকিয়ে যাওয়া,খসখসে হাওয়া,চুলকানি বৃদ্ধি পাওয়া।
♦ চোখে কম দেখা।
♦ বিরক্তিকর অনুভব করা এবং মেজাজ খিটখিটে হাওয়া।
ডায়াবেটিস কমানোর ১0 টি সহজ উপায়
১. স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা
দেহের ওজন স্বাস্থ্যকর মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত রাখার মধ্য দিয়ে শুধু ডায়াবেটিসই নয় বরং আরো নানা ধরনের রোগ বালাই থেকে মুক্ত থাকা যায়। স্বাস্থ্যকরভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৭০% কমে আসবে।
২. সালাদ খান
প্রতিদিন অন্তত এক বাটি সালাদ খান। যার মধ্যে থাকবে গাজর, শসা, লেটুস, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি। প্রতিদিন দুপুরে বা রাতে খাবার খাওয়ার আগে এই সালাদ খেতে হবে। সালাদে এক চা চামচ ভিনেগারও যুক্ত করতে পারেন। ভিনেগার রক্তকে কমমাত্রায় সুগার শোষণে সহায়তা করে। আর রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমবে।
৩. প্রচুর হাঁটাহাঁটি করুন
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়ক সেরা ব্যায়ামগুলোর একটি হাঁটাহাঁটি। প্রতিদিন অন্তত ৪০মিনিট হাঁটাহাঁটি করলেই আপনার বিপাকীয় হার এমন পর্যায়ে থাকবে যা আপনার দেহে ইনসুলিনের মাত্রাকেও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখতে যথেষ্ট। ফলে ডায়াবেটিসেরও ঝুঁকিও কমে আসবে।
৪. পূর্ণ শস্যজাতীয় খাদ্য খান
ওটমিল, বার্লি, ব্রাউন রাইস, ভুট্টা, বাজরা ইত্যাদি পূর্ণ শস্য জাতীয় খাদ্য দিয়ে সকালের নাস্তা করুন। পূর্ণ শস্য জাতীয় খাদ্যে আছে আঁশ, যা রক্তে সুগারের মাত্রা কমাতে সহায়ক। ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে। এছাড়া পূর্ণ শস্যজাতীয় খাদ্য কোষ্ঠকাঠিন্য, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগ থেকেও বাঁচাবে।
৫. কফি পান করুন
বেশ কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিদিন অন্তত দুই কাপ কফি পান করলে টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে আসে ২৯%। তবে চিনি ছাড়া কফি পান করতে হবে। কফিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান এই কাজ করে।
৬. ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন
আজকাল চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায় নানা ধরনের ফাস্টফুড। যা দেখে হয়তো লোভ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু ফ্রাইস, পিজ্জা, বার্গার এর মতো ফাস্ট এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে স্থুলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল, হজমে সমস্যা এবং হৃদরোগের মতো নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এসব খাবার দেহে ইনসুলিনের মাত্রায়ও ক্ষতিকরভাবে হেরফের ঘটিয়ে দিতে পারে। যা থেকে ডায়াবেটিসও হতে পারে।
৭. দারুচিনি খান
দারুচিনি তেল বা পাউডার আকারে নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে আসে ৪৮%! গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, দারুচিনির আছে অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা কমিয়ে আনার প্রাকৃতিক সক্ষমতা। আর এই দুটি উপাদান প্রাকৃতিক ভাবে কমিয়ে আনতে পারলে রক্তে সুগারের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে আসে।
৮. স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকুন
মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগও হতে পারে অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে। সুতরাং আপনি যদি এমন কেউ হন যিনি প্রায়ই তীব্র মানসিক চাপে থাকেন তাহলে রিল্যাক্স করার নানা কৌশল এবং যোগ ব্যায়াম করে স্ট্রেস কমান। এতে আপনার দেহে কর্টিসোল হরমোনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাবে।
৯. ধুমপান ত্যাগ করুন
স্ট্রেসের মতোই ধুমপানও নানা ধরনের মারাত্মক রোগের আরেকটি কারণ। ফুসফুস ক্যান্সার এর মতো ভয়ঙ্কর রোগের পাশাপাশি ডায়াবেটিসেরও একটি কারণ ধুমপান। সুতরাং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে না চাইলে আজই ধুমপান ছেড়ে দিন।