ঢাকার কলাবাগানের বাসিন্দা মনসুর আহমেদ প্রায় পনেরো বছর ধরে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও নিচ্ছেন।
তিনি বলছেন, কোন কোন রোগে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ভালো উপকার পেয়েছেন।
”আঁচিল, চর্মরোগের মতো সমস্যাগুলোয় হোমিওপ্যাথি ওষুধে খুব ভালো উপকার পেয়েছি। হাসপাতালে গেলে এগুলোর জন্য সার্জারি বা লেজার করে।
কিন্তু হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে কিছুদিনের মধ্যে এগুলো ভালো হয়ে গেছে।” তিনি বলছেন।
কিন্তু শারীরিক বড় সমস্যার জন্য তিনি বরাবরই অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
কারণ হিসাবে তিনি বলছেন, ”হোমিওপ্যাথি ওষুধে ভালো হতে কিছুদিন সময় লাগে। কিন্তু সার্জারি করার মতো বা বড় কোন সমস্যায় সেই দেরী করার ঝুঁকি নিতে চাইনা বলেই এ ধরণের সমস্যা হলে হাসপাতালের চিকিৎসকের কাছে যাই।”
বাংলাদেশে মিঃ আহমেদের মতো অনেক মানুষ নানা সমস্যায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই চিকিৎসা অত্যন্ত জনপ্রিয়।
বরগুনার পাথরঘাটার হাসিনা বেগম বলছেন, ”হাসপাতালে গেলে অনেক টাকা লাগে, কিন্তু হোমিওপ্যাথিতে ডাক্তারের খরচ, ওষুধের অনেক কম।
সময় লাগলেও রোগ ভালো হয়। আর তাতেও ভালো না হলে হাসপাতাল তো আছেই।”
তিনি বলছেন, তার বোনের পেটে একটি টিউমার হওয়ায় ডাক্তার অপারেশন করতে বলেছিলেন।
কিন্তু তাতে কয়েক লাখ টাকা লাগবে, যা তার নেই। তাই হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাচ্ছেন, যদি তাতে ভালো হয়ে যান।
তবে একেবারে আলাদা মতও রয়েছে।
ফরিদপুরের বাসিন্দা রফিকুল হক বলছেন, ”আমি কখনো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নেই না, কারণ এটা আমার কাছে বিজ্ঞান সম্মত মনে হয়না, তাই ঠিক বিশ্বাস হয়না।
শারীরিক যেকোনো সমস্যার জন্য আমি বা আমার পরিবারের সদস্যরা অ্যালিপ্যাথি চিকিৎসকের কাছেই যাই।”
বাংলাদেশের হোমিওপ্যাথি বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এই বোর্ডে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি তালিকাভুক্ত চিকিৎসক রয়েছেন।
হোমিওপ্যাথির উৎপত্তি
হোমিওপ্যাথির উৎপত্তি জার্মানিতে, প্রায় দু’শ বছর আগে।
যদিও ভারতীয় উপমহাদেশে এর ব্যবহার শুরু হয় প্রায় আশি বছর আগে; অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর।
এই চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমেনের জন্মবার্ষিকীর দিনে আজ অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে আজ পালন করা হচ্ছে হোমিওপ্যাথি দিবস।
বাংলাদেশে কত মানুষ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিচ্ছেন?
বাংলাদেশে সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আব্দুল মজিদ বলছেন, ”আমরা একটি জরিপ করে দেখেছি যে, বাংলাদেশে এখন ২৮ শতাংশ মানুষ হোমিওপ্যাথি এবং ইউনানি চিকিৎসা নিচ্ছেন।”
তিনি জানান, ২০১৮ সালে তাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৪৬ হাজার রোগী, যা আগের বছরের চেয়ে বেশি।
আর ভর্তি রোগী ছিলেন ৫১০জন, যাদের দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগ রয়েছে।
দেশের বাকি ৬০টি কলেজ ও হাসপাতাল মিলিয়ে মোট চিকিৎসা পাওয়া রোগীর সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে তিনি জানান।
মিঃ মজিদ বলছেন, সহজলভ্য, কম খরচ আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন হওয়ার কারণে অনেকেই তাদের চিকিৎসার জন্য হোমিওপ্যাথিও ওপর নির্ভর করেন।
একসময় নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের মধ্যে এই চিকিৎসার জনপ্রিয়তা থাকলেও, এখন উচ্চবিত্তরাও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জন্য আসছেন বলে তিনি জানান।
কিন্তু অনেক চিকিৎসক অভিযোগ করেন, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সময় ক্ষেপণের কারণে অনেক বড় বড় রোগ আরো ছড়িয়ে পড়ে, ফলে পরবর্তীতে অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসায় আরোগ্য করা সম্ভব হয়না।
ঢাকার একটি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক তৌফিক আহমেদ বলছেন, ”অনেক সময় আমরা এমন রোগী পাই, যারা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরেও এতদিন হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসা নিয়েছেন।
আমাদের কাছে তারা এসেছেন একেবারে শেষ পর্যায়ে, যখন আমাদের কিছু করার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। ”
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থা আসলে কতটা কার্যকর?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাব্বির হায়দার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”অন্যান্য অনেক চিকিৎসা ব্যবস্থা যেমন আছে, হোমিওপ্যাথি তার মতোই একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা।
দুইশো বছর ধরে এটি চলে আসছে। এটি সফল বা কার্যকর না হলে এতো মানুষ তো এতদিন ধরে চিকিৎসা নিতো না, কোন ভিত্তিহীন বিষয় তো এতদিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো না।”
তিনি বলছেন, ওষুধের দিক থেকে পার্থক্য না থাকলেও, চিকিৎসা পদ্ধতিতে পার্থক্য আছে। একটি রোগ কিভাবে সনাক্ত করবো, সেটির চিকিৎসা কীভাবে করা হবে, সে নিয়ে অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে বড় পার্থক্য রয়েছে।
কারণ এই চিকিৎসাটি মূলত লক্ষণ ভিত্তিক আর এখানেই অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে তার একটি বড় পার্থক্য রয়েছে বলে তিনি বলছেন।