শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখে কোমর। মানব শরীরের মাঝামাঝি অবস্থান হওয়ায় এর ওপর অনেক চাপ পড়ে। আঘাতজনিত কারণ, অতিরিক্ত ওজন বহন, দুর্ঘটনা— এসব কারণে নিতম্বে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হাঁটাচলা বা পুরো পা মাটিতে ফেলে স্বাধীনভাবে নড়াচড়া করা যায় এই কোমরের মাধ্যমেই। কোনো কারণে হিটে আঘাত পেলে বা এটি অকার্যকর হলে, তখন ওই হিপ ফেলে দিয়ে কৃত্রিম হিপ প্রতিস্থাপন করা হয়। একেই বলে হিপ রিপ্লেসমেন্ট।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন অর্থোপেডিক ও অর্থোপ্লাস্টি সার্জন অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন।
সাধারণত কোমরের ইনজুরি, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, মারাত্মক অস্টিও আর্থ্রাইটিস, হাড় ক্ষয়, হাড়ের টিউমার, অস্থিতে রক্ত সরবরাহ বন্ধসহ নানা জটিল পরিস্থিতিতে হিপ রিপ্লেসমেন্ট করা হয়। বেশি ওজনের বা স্থূল আকৃতির বয়স্ক পুরুষ ও নারী, কম হাঁটাচলা করা ব্যক্তি, প্রতিদিন দীর্ঘ সময় হাঁটু ভাঁজ করে পিঁড়িতে বসে কাজ করা ব্যক্তি, অযাচিত ও দীর্ঘমাত্রায় রোগীর স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনকারীদের হিপ রিপ্লেসমেন্ট করাতে হতে পারে।
লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আসায় দিন দিন কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে মানুষের। বিশেষ করে কায়িক পরিশ্রম না করা ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনব্যবস্থা মানুষকে খুব অলস করে দিচ্ছে। দেহ ভারি হয়ে কোমর ও হাঁটুর জয়েন্ট নষ্ট করে অসহনীয় অবস্থা তৈরি হচ্ছে। তখন শুধু তীব্র ব্যথা ও যন্ত্রণাই নয়; বরং পুরো জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। ব্যক্তিটি হয়ে যাচ্ছে পরিবারের বোঝা।
কোনো কারণে আঘাত পেলে, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, হাড় ক্ষয়, হাড়ের টিউমার, অস্থিতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধসহ অন্যান্য অসুখ হলে কোমর বা হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। তখন হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায় এবং অন্যান্য চিকিৎসা দিয়েও রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায় না। চিকিৎসকরা সেই পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন।
সাধারণত ষাটোর্ধ্ব রোগীদের এটা বেশি করা হলেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উন্নত ও দীর্ঘমেয়াদি কৃত্রিম অস্থিসন্ধি ব্যবহার করে অল্পবয়সি রোগীদেরও আজকাল কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপন হচ্ছে।
স্বাভাবিক জীবন
কোমরের কৃত্রিম এই জয়েন্ট বা প্রতিস্থাপন আধুনিক চিকিৎসার অংশ। মানবদেহের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে যুক্তরাষ্ট্র, জাপানে টাইটেনিয়াম ইমপ্লান্ট (এক ধরনের মেটাল দিয়ে কৃত্রিম জয়েন্ট তৈরি) করা হয়। মাত্র এক থেকে দুই ঘণ্টার এই অস্ত্রোপচারের পর এক বা দুদিন রোগীকে হাসপাতালে থাকতে হয়। এর পরই উঠে বসা, হাঁটাচলা, ব্যায়াম, সিঁড়ি ভাঙাসহ সব ধরনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে। এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। চিকিৎসার পর রোগী ২০-৩৫ বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, তেমন কোনো সমস্যা ছাড়াই। কৃত্রিম জয়েন্ট প্রতিস্থাপনের পর খেলোয়াড়রাও তাদের খেলাধুলা চালিয়ে যেতে পারেন।
জটিলতা
কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপনের অপারেশন নিরাপদ। তবে অন্যান্য অস্ত্রোপচারের মতো এতে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ জন্য পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধে বিশেষ কমপ্রেশন ডিভাইস যেমন— হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ইলাস্টিক মোজা এবং ব্যায়ামের পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়।
অনেক সময় শারীরিক আসন নতুন প্রতিস্থাপিত অস্থিসন্ধি থেকে কৃত্রিম অংশকে ছুটিয়ে দিতে পারে। এ জন্য রোগীর অস্ত্রোপচারের পর কখনই কোমর সন্ধি বা হিপ জয়েন্টকে ১০০ ডিগ্রির বেশি বাঁকানো এবং পা দুটোকে শরীরের মাঝামাঝি বরাবর ভাঁজ করা ঠিক হবে না।
অনেক সময় প্রতিস্থাপিত কৃত্রিম কোমরসন্ধি ঢিলা হয়ে ব্যথার কারণ হতে পারে। এ ছাড়া কিছু কিছু সময় আশপাশের নরম কোষকলাগুলো জমাট ও শক্ত করে নড়াচড়ায় কষ্টকর করে তুলতে পারে। এসব সমস্যা মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
চিকিৎসা ব্যয়
বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এই হিপ ও হাঁটু রিপ্লেসমেন্ট। এতে অপারেশন করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইসটি বসিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ চিকিৎসায় খরচ পড়ে ২০-৩০ লাখ থেকে এক-দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত।
আমেরিকায় হিপ রিপ্লেসমেন্ট বাবদ খরচ হয় ৫০-৫৫ হাজার ইউএস ডলার, সিঙ্গাপুরে ৩০-৩৫ হাজার ডলার, থাইল্যান্ডে ২০-২৫ হাজার ডলার, ভারতে ১০-১২ হাজার ডলার, আর বাংলাদেশে সেটি হচ্ছে মাত্র তিন-চার হাজার ডলার বা আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায়।
প্রতিরোধে করণীয়
শুধু সচেতনতার অভাবে প্রতি বছর কোমর ও হাঁটুর নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ। তাই এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে করণীয় হলো—
* দেহের প্রতিটি মাংসপেশি সচল রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
* ফাস্টফুড, ভেজাল খাবার বর্জন করতে হবে।
* ওজন বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে হবে।
* উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
* কবিরাজি ওষুধ, স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ সেবনের কারণে কোমর ও হাঁটুর জয়েন্ট নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এসব থেকে বিরত থাকতে হবে।
* শুধু শুয়েবসে থাকলে ওজন বাড়বে, তাই মুভমেন্ট বাড়াতে হবে ও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
তথ্য সূত্র : https://www.jugantor.com/