Image default
ইতিহাসজানা অজানাধর্মবাংলাদেশহিন্দু

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা: ইতিহাস, অর্থ এবং আচার-অনুষ্ঠান

বাংলা সংস্কৃতিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। এটি একটি গৃহস্থ পূজা, যা আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত হয়। মূলত বাংলায় দুর্গাপূজার পরেই আসে এই পূর্ণিমার দিন, যাকে বাঙালি ঘরে ঘরে “কোজাগরী পূর্ণিমা” বা “লক্ষ্মী পূর্ণিমা” নামে পালন করা হয়। এই পূজার মাধ্যমে ধন ও সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।

বাংলায় কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা বিশেষভাবে পালন করা হয় ধনসম্পদ ও সৌভাগ্যের কামনায়। তবে এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে এক প্রাচীন লোকবিশ্বাস ও ঐতিহ্য।

কোজাগরী শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য

“কোজাগরী” শব্দের উৎপত্তি দুটি শব্দের মিলিত রূপ। “কো জাগরী” অর্থাৎ “কে জেগে আছো?”—এই প্রশ্ন থেকে এসেছে কোজাগরী শব্দটি। বিশ্বাস করা হয় যে, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা রাতে দেবী লক্ষ্মী পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞাসা করেন, “কে জেগে আছো?” যারা এই রাতে দেবীর আরাধনা করে এবং জেগে থাকে, তাদের ঘরে তিনি ধনসম্পদের বর্ষণ করেন।

কোজাগরী শব্দটি, এইভাবে, সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের আশায় জেগে থাকা এবং ধনলাভের কামনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই পূজায় বিশ্বাসী মানুষেরা বিশ্বাস করেন, এই রাতে দেবী লক্ষ্মী যে ঘরে প্রবেশ করেন, সেই ঘর পূর্ণ হয়ে ওঠে সুখ ও সমৃদ্ধিতে। এই বিশ্বাস থেকেই এই পূজা কোজাগরী পূজা নামে পরিচিত।

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার ঐতিহ্য

লক্ষ্মী দেবীকে বাঙালিরা ধনসম্পদের দেবী হিসেবে পূজা করেন। শস্যের দেবী হিসেবেও তাঁর আরাধনা করা হয়। বলা হয়, লক্ষ্মী দেবী চঞ্চলা অর্থাৎ তিনি স্থির থাকেন না। তাই দেবীর আরাধনা করলে তিনি সেই ঘরে স্থায়ীভাবে বাস করেন।

শস্যের ঋতুতে যেমন ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি এবং চৈত্র সংক্রান্তিতে লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। আবার দীপাবলিতেও দেবীর আরাধনা করা হয়। কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী পূজার মূল কারণ হিসেবে গ্রামবাংলার কৃষিজীবী সমাজে ভালো ফলনের প্রার্থনা করা হত। দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করে ভালো ফলনের কামনা করা, প্রকৃতির কাছ থেকে আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য এই পূজার প্রচলন ছিল।

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আচার-অনুষ্ঠান

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা বেশ সরল আচার-অনুষ্ঠানে পালিত হয়। এই পূজায় প্রধানত ফল, ফুল, বাতাসা, চাল এবং পিঠে-লাড়ু মিষ্টান্ন নিবেদন করা হয়। প্রতিটি গৃহস্থের ঘরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে লক্ষ্মী পিঁড়ি পাতার রীতি আছে। এর জন্য একটি কাঠের জলচৌকি বা উঁচু পাটের ওপর মা লক্ষ্মীর সরা বা মাটির প্রতিমা স্থাপন করা হয়। পূজার স্থানটি কলাপাতা, ধান, টাকা, সোনা-রূপার মুদ্রা এবং হলুদ-মসলার মাধ্যমে সাজানো হয়।

এই পূজার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আচার হলো আল্পনা আঁকা। বাড়ির মহিলারা চালের গুঁড়ো দিয়ে মেঝেতে বিভিন্ন নকশা আঁকেন। মায়ের পায়ের ছাপ দিয়ে গৃহে প্রবেশের পথ নির্দেশ করা হয়, যাতে মা লক্ষ্মী সরাসরি গৃহস্থের ঘরে প্রবেশ করেন।

আসনে ফুল ও বাতাসা নিবেদন করে, ১৪টি পাত্রে ফলমূল এবং মিষ্টান্ন সাজিয়ে পূজার প্রধান অংশটি সমাপ্ত করা হয়। এছাড়াও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে জল দানের রীতি অনুসরণ করা হয়।

কোজাগরী পূজার আলপনার তাৎপর্য

আলপনা হলো এই পূজার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কামনা ও প্রার্থনার একটি প্রতীকী উপস্থাপনা। এই আলপনায় পায়ের ছাপ আঁকা হয়, যা নির্দেশ করে লক্ষ্মী দেবী এই পথে গৃহস্থের ঘরে প্রবেশ করবেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাংলার ব্রত’ গ্রন্থে আলপনা এবং লক্ষ্মী পূজার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। আলপনাকে বলা হয় ‘কামনার প্রতিচ্ছবি’। এটি একটি শিল্প যা গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দুই বাংলায় লক্ষ্মী পূজার ভিন্নতা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা পালিত হলেও, এই পূজার আচার ও রীতিতে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে এই পূজা প্রধানত মাটির প্রতিমায় সম্পন্ন হয়, যেখানে বাংলাদেশে লক্ষ্মীর সরা বা মাটির পাত্রে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করা হয়। পূজা শেষে দেবীর কৃপায় ভালো ফলনের জন্য প্রার্থনা করা হয়।

লক্ষ্মী পূজার সময় এবং বৈশিষ্ট্য

কোজাগরী পূর্ণিমা তিথিতে দেবী লক্ষ্মী আরাধনার সময় দেবীর কাছে ধনসম্পদ এবং সুখ-সমৃদ্ধির প্রার্থনা করা হয়। এই পূজার মাধ্যমে দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়, এবং তাঁর আশীর্বাদ কামনা করা হয়। যে গৃহস্থ প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী বার করে থাকেন, তাঁরাও এই পূর্ণিমা রাতে বিশেষভাবে দেবীকে আরাধনা করেন।

দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে অবাঙালি পরিবারগুলিতে, লক্ষ্মী পূজা দীপাবলিতে উদযাপিত হয়। কিন্তু বাঙালিরা তাদের সংস্কৃতির অনুসারে দেবীপক্ষের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী পূজা করেন।

উপসংহার

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা বাঙালি সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ। এটি একটি গৃহস্থ পূজা হলেও এর আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসে বিশেষ তাৎপর্য বিদ্যমান। এই পূজার মাধ্যমে দেবী লক্ষ্মীর কাছে ধন, শস্য এবং সুখ-সমৃদ্ধির প্রার্থনা করা হয়। এই ঐতিহ্যবাহী পূজার মাধ্যমে বাঙালিরা দেবীর কাছ থেকে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে তাঁদের গৃহকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।

Related posts

করোনা সংক্রমণ রোধে চট্টগ্রামে অভিযান, ১৬৭৫০ টাকা অর্থদণ্ড

News Desk

টঙ্গীতে সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ৬৯

News Desk

এক ফেরিতে ৫ শতাধিক যাত্রী

News Desk

Leave a Comment