ইয়াজুজ ও মাজুজ ইসলামি ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত দুটি শক্তিশালী জাতি বা গোষ্ঠী, যাদেরকে কিয়ামতের দিন আগমনের একটি আলামত বা চিহ্ন হিসেবে গণ্য করা হয়। কুরআনে এবং হাদিসে ইয়াজুজ ও মাজুজ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে, এবং ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থেও তাঁদের উল্লেখ আছে।
ইয়াজুজ ও মাজুজের পরিচয়
ইয়াজুজ ও মাজুজ সম্পর্কে কুরআনে সূরা কাহাফ ও সূরা আম্বিয়া-তে উল্লেখ রয়েছে। কুরআনের ভাষ্যমতে, ইয়াজুজ ও মাজুজ এমন দুটি বিপুলসংখ্যক জাতি যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংস সাধন করবে। তাঁরা এমন এক শক্তিশালী জাতি ছিল, যাঁরা সৃষ্টিকর্তার অনুমোদন ছাড়া কেউ তাঁদেরকে প্রতিরোধ করতে পারবে না।
পরবর্তী কিছু ঐতিহ্য ইয়াজুজ এবং মাজুজের চিত্রকে প্রসারিত করে, তাদের বিভিন্ন বর্ণনা প্রদান করে। কিছু যজুজ এবং মাজুজ এরস গাছের মতো লম্বা, অন্যগুলো লম্বার মতো চওড়া, এবং কিছু তাদের কান দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ঢেকে রাখা হয়। তারা শেষের চিহ্ন হিসাবে প্রাচীন বিশ্বের উত্তর-পূর্বে প্রচুর সংখ্যায় উপস্থিত হবে , তারপরে ইস্রায়েলের দিকে দক্ষিণে এগিয়ে যাবে, টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদী বা গ্যালিল সাগরের জল পান করবে এবং পথে সবাইকে হত্যা করবে। যখন তাদের তীরগুলির জন্য আর কোন মানব লক্ষ্য অবশিষ্ট থাকবে না, তখন যজুজ এবং মাজুজ আকাশে গুলি চালাবে, স্বর্গ ধ্বংস করার আশায়। অতঃপর আল্লাহ তাদের ঘাড়ে কৃমি দিয়ে আক্রমণ করবেন যা তাদের কান ও নাক পূর্ণ করবে, এভাবে তাদের হত্যা করবে।
ইয়াজুজ-মাজুজ কারা?
ইয়াজুজ মাজুজ বনী আদমের অন্তর্ভুক্ত দু’টি জাতি। তারা বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা যুল-কারনাইনের ঘটনায় বলেন,
﴿حَتَّىٰٓ إِذَا بَلَغَ بَيۡنَ ٱلسَّدَّيۡنِ وَجَدَ مِن دُونِهِمَا قَوۡمٗا لَّا يَكَادُونَ يَفۡقَهُونَ قَوۡلٗا ٩٣ قَالُواْ يَٰذَا ٱلۡقَرۡنَيۡنِ إِنَّ يَأۡجُوجَ وَمَأۡجُوجَ مُفۡسِدُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَهَلۡ نَجۡعَلُ لَكَ خَرۡجًا عَلَىٰٓ أَن تَجۡعَلَ بَيۡنَنَا وَبَيۡنَهُمۡ سَدّٗا ٩٤ قَالَ مَا مَكَّنِّي فِيهِ رَبِّي خَيۡرٞ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجۡعَلۡ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُمۡ رَدۡمًا ٩٥ ءَاتُونِي زُبَرَ ٱلۡحَدِيدِۖ حَتَّىٰٓ إِذَا سَاوَىٰ بَيۡنَ ٱلصَّدَفَيۡنِ قَالَ ٱنفُخُواْۖ حَتَّىٰٓ إِذَا جَعَلَهُۥ نَارٗا قَالَ ءَاتُونِيٓ أُفۡرِغۡ عَلَيۡهِ قِطۡرٗا ٩٦ فَمَا ٱسۡطَٰعُوٓاْ أَن يَظۡهَرُوهُ وَمَا ٱسۡتَطَٰعُواْ لَهُۥ نَقۡبٗا ٩٧ قَالَ هَٰذَا رَحۡمَةٞ مِّن رَّبِّيۖ فَإِذَا جَآءَ وَعۡدُ رَبِّي جَعَلَهُۥ دَكَّآءَۖ وَكَانَ وَعۡدُ رَبِّي حَقّٗا ٩٨﴾ [الكهف: ٩٣، ٩٨]
“অবশেষে যখন তিনি দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্থলে পৌঁছলেন, তখন তিনি সেখানে এক জাতিকে পেলেন, যারা তাঁর কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, হে যুল-কারনাইন, ইয়াজুজ ও মাজুজ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আপনি বললে আমরা আপনার জন্য কিছু কর ধার্য করব এ শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রচীর নির্মাণ করে দিবেন। তিনি বললেন, আমার রব আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দিব। তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা হাঁপরে ফুঁক দিতে থাক। অবশেষে যখন তা আগুনে পরিণত হলো, তখন তিনি বললেন, তোমরা গলিত তামা নিয়ে আস। আমি তা এর উপর ঢেলে দেই। অতঃপর ইয়াজুজ ও মাজুজের দল তার উপরে আরোহণ করতে পারল না এবং তা ভেদ করতেও সক্ষম হলো না। -কারনাইন বললেন, এটা আমার রবের অনুগ্রহ। যখন আমার রবর প্রতিশ্রুত সময় আসবে, তখন তিনি একে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন এবং আমার রবের প্রতিশ্রুতি সত্য।” [সূরা কাহাফ, আয়াত: ৯৩-৯৮]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى يَا آدَمُ فَيَقُولُ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِي يَدَيْكَ فَيَقُولُ أَخْرِجْ بَعْثَ النَّارِ قَالَ وَمَا بَعْثُ النَّارِ قَالَ مِنْ كُلِّ أَلْفٍ تِسْعَ مِائَةٍ وَتِسْعَةً وَتِسْعِينَ فَعِنْدَهُ يَشِيبُ الصَّغِيرُ ( وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ ) قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَأَيُّنَا ذَلِكَ الْوَاحِدُ قَالَ أَبْشِرُوا فَإِنَّ مِنْكُمْ رَجُلًا وَمِنْ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ أَلْفًا»
“আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন আদম আলাইহিস সালামকে ডাক দিবেন। আদম আলাইহিস সালাম বলবেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার দরবারে হাযির আছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার বংশধর থেকে জাহান্নামী দলকে পৃথক কর। আদম আলাইহিস সালাম বলবেন, জাহান্নামের দল কারা? আল্লাহ বলবেন, প্রত্যেক এক হাজারের মধ্যে থেকে নয়শত নিরানব্বই জন। তখন কোলের শিশু বৃদ্ধ হয়ে যাবে। গর্ভবতী মহিলারা সন্তান প্রসব করে দেবে। মানুষদেরকে আপনি মাতাল অবস্থায় দেখবেন। অথচ তারা মাতাল নয়। আল্লাহর আযাব খুবই কঠিন। সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে থেকে কে হবে সেই এক ব্যক্তি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সুসংবাদ গ্রহণ কর, তোমাদের মধ্যে থেকে হবে সেই এক ব্যক্তি। আর বাকীরা হবে ইয়াজুজ-মাজুজের দল।”[1]
ইয়াজুজ-মাজুজের দল বের হয়ে আসা কিয়ামতের অন্যতম আলামত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেই ইয়াজুজ-মাজুজ বের হওয়ার লক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে। উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে আছে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা পেরেশান ও রক্তিম চেহারা নিয়ে আমাদের কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি বলছিলেন,
«لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مِثْلُ هَذِهِ وَحَلَّقَ بِإِصْبَعَيْهِ الْإِبْهَامِ وَالَّتِي تَلِيهَا»
“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আরবদের জন্য ধ্বংস অনিবার্য। অকল্যাণ নিকটবর্তী হয়ে গেছে। ইয়াজুজ-মাজুজের প্রাচীর এ পরিমাণ খুলে দেওয়া হয়েছে। এ বলে তিনি হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনি আঙ্গুলি দিয়ে গোলাকৃতি করে দেখালেন।”[2]
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: আহাদীসুল আন্বিয়া।
[2] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল ফিতান।
ধুলকারনাইন ও দেয়ালের নির্মাণ
কুরআনে সূরা কাহাফে একটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে ধুলকারনাইন নামক একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক ইয়াজুজ ও মাজুজকে প্রতিরোধ করার জন্য একটি বিশাল দেয়াল নির্মাণ করেন। তাঁর এই নির্মাণের মাধ্যমে তিনি জনগণকে ইয়াজুজ ও মাজুজের হামলা থেকে নিরাপদ করেন। তিনি তাঁদের প্রবেশ বন্ধ করার জন্য লোহা ও তামা ব্যবহার করে একটি মজবুত দেয়াল তৈরি করেন।
হাদিসে ইয়াজুজ ও মাজুজ
ইসলামি হাদিসসমূহে বলা হয়েছে যে কিয়ামতের দিন ইয়াজুজ ও মাজুজকে বের করে দেয়া হবে, এবং তাঁরা পৃথিবীতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন। তাঁদের জনসংখ্যা এত বেশি হবে যে তাঁরা পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ও পানি শোষণ করবে। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর বিভিন্ন হাদিসে ইয়াজুজ ও মাজুজের আগমনের বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
ইয়াজুজ ও মাজুজের কিয়ামতের সাথে সম্পর্ক
ইয়াজুজ ও মাজুজের আগমনকে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ের একটি আলামত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইসলামী বিশ্বাস মতে, আল্লাহর অনুমোদনে একদিন এই দেয়াল ভেঙে যাবে এবং তাঁরা পৃথিবীতে মুক্ত হয়ে আসবেন। তাঁদের আগমন সাধারণ মানুষের জন্য বিপদ সংকেত হবে এবং এর পরে কিয়ামতের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
ইয়াজুজ ও মাজুজ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত
ইয়াজুজ ও মাজুজের পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও মতামত রয়েছে। কেউ তাঁদেরকে আক্ষরিক অর্থে মানবগোষ্ঠী মনে করেন, আবার কেউ কেউ তাঁদেরকে বিপুল শক্তিশালী জাতি বা প্রতীকী অর্থে বিশৃঙ্খলা বা অপশক্তির প্রতিনিধিত্ব হিসেবেও ব্যাখ্যা করেছেন।
সংক্ষেপে, ইয়াজুজ ও মাজুজ ইসলামি বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তাঁদের আগমনকে কিয়ামতের একটি বড় আলামত হিসেবে দেখা হয়।