ভগবান বিষ্ণু, যিনি সৃষ্টির রক্ষক, যুগে যুগে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন ধরিত্রীকে রক্ষা করার জন্য। তাঁর এই অবতারগণের মধ্যে অন্যতম বিশেষ স্থান দখল করে আছে রাম অবতার। অযোধ্যার রাজা দশরথ এবং রানি কৌশল্যার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তাঁকে রাম অবতারে মর্ত্যে আসতে হয়েছিল? অত্যাচারী রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করা যে অন্যতম প্রধান কারণ, তা অনেকেই জানেন। তবে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে যা অনেকের অজানা। আসুন, জেনে নিই ভগবান বিষ্ণুর রাম অবতারের নেপথ্যের কাহিনি।
রাবণের বিনাশের জন্য বিষ্ণুর মানবজন্ম
রামায়ণের মূল কাহিনিতে দেখা যায়, রাবণ দেবতাদের জন্য এক দুর্দান্ত বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর শক্তি এতটাই অপ্রতিরোধ্য ছিল যে কেউ তাঁকে পরাজিত করতে পারছিল না। এই অপ্রতিরোধ্যতার পেছনে ছিল এক বিশেষ বর। ব্রহ্মার আরাধনা করে রাবণ এক বরপ্রাপ্ত হন। এই বর অনুযায়ী, দেবতা, গান্ধর্ব্য, যক্ষ এবং রাক্ষস কেউই তাঁকে বধ করতে পারবে না। ফলে রাবণ প্রায় অমরত্ব লাভ করেন। তবে এই বরপ্রাপ্তির সময় রাবণ মানুষের কথা উল্লেখ করেননি, কারণ তিনি মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন।
রাবণের অত্যাচার সীমা ছাড়ালে দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। তখন বিষ্ণু সিদ্ধান্ত নেন, তিনি মানবরূপে জন্ম নেবেন এবং রাবণকে বধ করবেন। বিষ্ণু রাম রূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে সীতা-হরণ ও লঙ্কাকাণ্ডের মাধ্যমে রাবণের বিনাশ করেন।
নারদের অভিশাপ এবং বিষ্ণুর বিরহ যন্ত্রণা
ভগবান বিষ্ণুর রাম অবতারের আরেকটি কারণ ছিল দেবর্ষি নারদের অভিশাপ। একবার নারদ মুনি এক সুন্দরী রাজকন্যার প্রেমে পড়েন এবং তাঁর স্বয়ংবর সভায় অংশগ্রহণের জন্য বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করেন। বিষ্ণু নারদকে আশীর্বাদ করেন, কিন্তু একইসঙ্গে তাঁকে একটি বানরের রূপ দেন। স্বয়ংবর সভায় রাজকন্যা নারদের দিকে তাকিয়ে উপহাস করেন।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নারদ বিষ্ণুকে অভিশাপ দেন যে, তিনিও একদিন স্ত্রীবিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভোগ করবেন। বিষ্ণু নারদের অভিশাপ মাথা পেতে নেন এবং জানান, রাম অবতারের সময় তিনি এই কষ্ট ভোগ করবেন। পরবর্তীতে সীতা-হরণের ঘটনা এই অভিশাপের ফলস্বরূপ ঘটে।
বৃন্দার অভিশাপ এবং সীতাহরণ
বিষ্ণুর রাম অবতারের নেপথ্যে রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। জলন্ধর নামে এক রাক্ষস ছিলেন, যিনি তাঁর স্ত্রী বৃন্দার সতীত্বের কারণে অপরাজেয় হয়ে ওঠেন। দেবতারা জলন্ধরকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হলে, বিষ্ণু এক বিশেষ কৌশল নেন। তিনি জলন্ধরের রূপ ধারণ করে বৃন্দার সামনে উপস্থিত হন। বৃন্দা, স্বামী ভেবে তাঁকে আলিঙ্গন করেন।
পরে বিষ্ণু প্রকট হলে, বৃন্দা ক্ষোভে তাঁকে অভিশাপ দেন যে, একদিন তাঁর স্ত্রীও চুরি হয়ে যাবে। বিষ্ণু এই অভিশাপ গ্রহণ করেন। রাম রূপে জন্ম নেওয়ার সময় এই অভিশাপ ফলপ্রসূ হয় এবং সীতাহরণ ঘটে।
জয়-বিজয়ের অভিশাপ এবং রাবণ-কুম্ভকর্ণের জন্ম
ভগবান বিষ্ণুর দুই দ্বাররক্ষী, জয় এবং বিজয়, একবার ব্রহ্মার মানসপুত্র চার ঋষিকে বৈকুণ্ঠে প্রবেশে বাধা দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ঋষিরা তাঁদের অভিশাপ দেন যে, তাঁরা মর্ত্যে জন্ম নেবেন। বিষ্ণু এই অভিশাপ সম্পর্কে জানতে পেরে তাঁদের জানান, মর্ত্যে তাঁদের তিন জন্ম বিষ্ণুর শত্রু হয়ে কাটাতে হবে, অথবা সাত জন্ম বিষ্ণুর উপাসক হিসেবে জন্ম নিতে হবে।
তাঁরা প্রথম পন্থাটি বেছে নেন। সেই অভিশাপ অনুসারে, জয় এবং বিজয় রাবণ ও কুম্ভকর্ণ রূপে জন্ম নেন। বিষ্ণুর রাম অবতারের সময় এই দুই রাক্ষসকে পরাজিত করেই তাঁদের মুক্তি হয়।
ধর্ম রক্ষায় বিষ্ণুর আবির্ভাব
ভগবান বিষ্ণুর প্রতিটি অবতারের মূল লক্ষ্য ছিল ধর্ম রক্ষা। রাম অবতারে তিনি শুধু রাবণকে বধ করেননি, বরং জীবনের নীতি, ন্যায্যতা এবং পারিবারিক দায়িত্বের যে শিক্ষাগুলি রামায়ণে তুলে ধরা হয়েছে, তা মানুষের জন্য এক মহামূল্যবান বার্তা হয়ে রয়েছে। রামচন্দ্র ছিলেন সত্য, ধৈর্য এবং কর্তব্যপরায়ণতার প্রতীক। তাঁর চরিত্রে আদর্শ পুত্র, আদর্শ স্বামী এবং আদর্শ রাজা—সবই ফুটে উঠেছে।
উপসংহার
ভগবান বিষ্ণুর রাম অবতার শুধু একটি পৌরাণিক ঘটনা নয়, বরং এটি ধর্ম, ন্যায় এবং কর্তব্যের পথপ্রদর্শক। রাবণের বিনাশের পাশাপাশি, নারদের অভিশাপ, বৃন্দার অভিশাপ, এবং জয়-বিজয়ের মুক্তির জন্যই ভগবান বিষ্ণুকে রাম রূপে মর্ত্যে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। এই সমস্ত কারণগুলো রামায়ণকে শুধু একটি মহাকাব্য নয়, বরং জীবনের শিক্ষা ও আদর্শের এক মহাগ্রন্থে পরিণত করেছে।