Image default
ইতিহাসজানা অজানাধর্মহিন্দু

শিবের জন্ম রহস্য: পুরাণে দেবাদিদেব মহাদেবের আবির্ভাব

দেবাদিদেব মহাদেব, ত্রিলোকনাথ শিব—শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। তাঁর মহিমা যুগে যুগে অব্যাহত। শিব পুরাণের ভাষায়, “শিব হতে শ্রেষ্ঠতর কিছুমাত্র নাই। শ্রীশিব সবার শ্রেষ্ঠ জানিবে সবাই।” এই দেবতার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রাচীন কাল থেকেই অমলিন। শস্যশ্যামল বাংলার বুকে, স্ফীত পেট, গোঁফদাড়িময় ভোলানাথ হয়ে শিব যেন প্রতিটি ঘরের আপনজন।

শিব: সৃষ্টিকর্তা নাকি স্বয়ম্ভূ?

পুরাণ মতে, শিবের জন্ম রহস্য বেশ চমকপ্রদ। ‘বৃহৎ শিবপুরাণ’ বলছে, তিনি স্বয়ম্ভূ। অর্থাৎ, তাঁকে কেউ সৃষ্টি করেননি; তিনি নিজেই নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। যখন কিছুই ছিল না, তখনও তিনি ছিলেন। আর যখন সব ধ্বংস হয়ে যাবে, তখনও তিনিই থাকবেন।

পুরাণে আরও বলা হয়েছে, সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায়ে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু নতুন নতুন জন্ম লাভ করেন, কিন্তু শিব সব কালের প্রাচীনতম। ত্রিদেবের মধ্যে তিনিই মূল সৃষ্টিকর্তা ও সংহারক।

ব্রহ্মা-বিষ্ণুর কলহ ও শিবের আবির্ভাব

অন্য একটি পৌরাণিক কাহিনিতে শিবের আবির্ভাব আরও রোমাঞ্চকর। একবার ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তীব্র কলহ শুরু হয়। ঠিক সেই মুহূর্তে এক প্রকাণ্ড জ্বলন্ত স্তম্ভ আবির্ভূত হয়। এই স্তম্ভের আদি-অন্ত কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এক দৈববাণী জানাল যে, এই স্তম্ভের আদি ও অন্ত যিনি খুঁজে পাবেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ।

ব্রহ্মা হাঁসের রূপ ধরে আকাশপথে উড়ে চললেন স্তম্ভের শীর্ষ খুঁজতে। বিষ্ণু শূকরের রূপ নিয়ে মাটির নিচে স্তম্ভের শেষাংশের সন্ধান শুরু করলেন। কিন্তু বহু প্রচেষ্টার পরও কেউই স্তম্ভের আদি বা অন্ত খুঁজে পেলেন না। একসময় তাঁরা হাল ছেড়ে দিলেন। তখনই স্তম্ভের মধ্য থেকে শিবের আবির্ভাব। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু শিবের চিরন্তন রূপ প্রত্যক্ষ করে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করলেন।

শিবের অর্থ ও মহিমা: সত্যম, শিবম, সুন্দরম

‘শিব’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হল “সত্যম শিবম সুন্দরম”, অর্থাৎ সত্য ও সুন্দরের সেতুবন্ধ। শিব হলেন অদ্বিতীয়ম পরমব্রহ্ম। সৃষ্টি, স্থিতি, ও প্রলয়ের মধ্যে তিনি প্রলয়ের প্রতীক। এই কারণেই তিনি শুধু ধ্বংসের দেবতা নন; তিনি মঙ্গলময়ও বটে।

শিবের প্রাচীনতম রূপ

শিবচেতনার শুরু কবে তা নিয়ে নিশ্চিত কোনো ধারণা নেই। তবে মনে করা হয়, বৈদিক যুগেরও বহু আগের থেকে শিবের উপাসনা প্রচলিত ছিল। সিন্ধু সভ্যতায় মূলত মাতৃপূজার প্রচলন থাকলেও পুরুষ দেবতার অস্তিত্বও ছিল। এই সভ্যতায় এক ত্রিমুখ দেবতার সিল পাওয়া যায়, যিনি শিবের আদিরূপ বলে বিশ্বাস করা হয়। তিনি পশুপতি, যোগেশ্বর, মহাযোগী নানা নামে পরিচিত।

বৈদিক যুগে রুদ্র নামে পরিচিত এক দেবতার উপাসনা শুরু হয়, যিনি শিবের পূর্বসূরি। রুদ্র ছিলেন প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপের প্রতীক, আর শিব ছিলেন শান্ত ও মঙ্গলময়। সময়ের সঙ্গে রুদ্র ও শিবের ধারণা একীভূত হয়ে যায়।

শিবলিঙ্গ উপাসনা

শিবের প্রতীকী রূপ হিসাবে শিবলিঙ্গ উপাসনার প্রচলনও প্রাচীন। অনেকের মতে, এটি অনার্য সভ্যতার চিন্তার প্রতিফলন। শিবলিঙ্গ প্রকৃতির সৃষ্টিশীল শক্তির প্রতীক। পৌরাণিক যুগ থেকে আজও এই উপাসনা অব্যাহত রয়েছে।

বাঙালি জীবনে শিব

বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে শিবের ভূমিকা গভীর ও বহুমুখী। এখানে শিব শুধু দেবতা নন; তিনি ঘরের মানুষ। বাঙালি সংস্কৃতিতে শিবের রূপ অনেকটাই মানবিক। তিনি এখানে পেশিবহুল, জ্যোতির্ময় দেবতা নন; বরং এক মধ্যবয়সি বাঙালি পুরুষের প্রতিচ্ছবি। মুখে গোঁফদাড়ি, হাতে কলকে, স্ফীত পেট, আর বাঘছাল পরিহিত এই শিব বাঙালির হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন।

বাঙালি সংস্কৃতিতে শিব: গাজন ও চড়ক উৎসব

বাঙালির ধর্মীয় জীবনে শিব পূজার বিশেষ স্থান। শিবরাত্রি, গাজন, নীলপুজো, চড়ক উৎসবের মাধ্যমে শিব আরাধনা বাঙালির জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে শিবের উল্লেখ বহুল। মৎস্যজীবীদের কাছে তিনি মাকাল ঠাকুর, গ্রামীণ সমাজে তিনি পাঁচু ঠাকুর, ক্ষেত্রপাল বা ধর্মঠাকুর নামেও পরিচিত।

পৌরাণিক শিব বনাম লোকশিল্পের শিব

বাঙালি লোকশিল্পে শিবের রূপ আরও বৈচিত্র্যময়। কালীঘাটের পটচিত্র থেকে যামিনী রায়ের চিত্রকলায়, শিবকে কখনো দেবতা, কখনো গ্রামীণ দেবতা রূপে দেখা যায়। শ্মশানের শিব থেকে লোকজ সংস্কৃতির অংশ হয়ে তিনি বাঙালির হৃদয়ে অমলিন।

শিব: অনন্ত মহিমার প্রতীক

পুরাণ বলছে, শিব হলেন চিরন্তন ও আদিঅন্তহীন। শিবের প্রকৃত রূপ বা স্বরূপ মানুষ কখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি, কিন্তু যুগ যুগ ধরে তিনি ভক্তি ও আরাধনার পাত্র হয়ে আছেন। তাঁর লীলারহস্য ও মহিমা কখনো পুরাণে, কখনো বাংলার মাটিতে বেঁচে থাকে। সময়ের পরিবর্তনে শিবের উপাসনার ধরন বদলালেও তাঁর প্রতি মানুষের ভালবাসা ও ভক্তি অমলিন।

শিব সেই দেবতা, যিনি ধ্বংস ও সৃষ্টির মধ্য দিয়ে চিরন্তন সত্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে আছেন। তাঁর রূপ-গুণ, লীলাকাহিনি এবং চিরন্তন উপস্থিতি—সব কিছুই শিবকে এক অনন্যসাধারণ দেবতা করে তুলেছে।

“শিবই সর্বোচ্চ, শিবই চিরন্তন।”

Related posts

আরেক রফিক-সালামের প্রচেষ্টায় একুশ পেয়েছিল বিশ্বস্বীকৃতি

News Desk

ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনী

News Desk

ইংরেজি রিডিং পড়ার সহজ নিয়ম

News Desk

Leave a Comment