শ্রীকৃষ্ণ, যিনি ভগবান হিসেবে পূজিত, পৃথিবীতে এসেছিলেন শান্তি ও ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি পুরুষোত্তম, অর্থাৎ পুরুষদের মধ্যে সর্বোত্তম। এই তত্ত্বে তিনটি প্রধান পর্যায় রয়েছে—ক্ষর পুরুষ, অক্ষর পুরুষ, এবং উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, “ক্ষর পুরুষ সর্বভূত, অক্ষর কূটস্থ পুরুষ, আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর থেকেও উত্তম, এই জন্যই আমি পুরুষোত্তম।”
পুরুষোত্তমের তিন স্তর: ক্ষর, অক্ষর, এবং উত্তম
ক্ষর পুরুষ হলো যা পরিবর্তনশীল ও ক্ষয়প্রাপ্ত। এটি আত্মার বহুমুখী প্রকাশকে বোঝায়। অক্ষর পুরুষ হলেন অপরিবর্তনশীল, স্থির এবং নীরব সাক্ষী। তিনি প্রকৃতির সব কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম হলেন এই দুইয়ের সমন্বয়, যিনি সৃষ্টির অন্তর্গত পরিবর্তনশীলতাকেও ধারণ করেন এবং একই সঙ্গে স্থির নির্লিপ্ত অবস্থানেও বিরাজ করেন।
শ্রীঅরবিন্দের ব্যাখ্যা
শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন, ক্ষর পুরুষ হলো সেই চৈতন্য, যা প্রকৃতির সাথে যুক্ত এবং বহুমুখী রূপে প্রকাশিত। অন্যদিকে, অক্ষর পুরুষ হলো নির্লিপ্ত, নীরব চৈতন্য, যা কেবল সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকে। কিন্তু উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম দুইয়ের সমন্বয়ে বিদ্যমান। তিনিই প্রকৃতি এবং এর কার্যকলাপের প্রেরণা ও সত্তা।
গীতায় পুরুষোত্তমের মহিমা
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, পুরুষোত্তম সম, শান্ত, নির্গুণ এবং অনন্ত। তিনি সর্বভূতের আত্মা। একইসঙ্গে তিনি গুণপালক, কর্মপ্রেরক, এবং যজ্ঞের ভোক্তা। সুতরাং, পুরুষোত্তমের জ্ঞান মানে সর্বভূতে ঐক্যের জ্ঞান। তাঁকে ভালোবাসা ও পূজার মাধ্যমেই ভক্তরা তাঁর সান্নিধ্য পায়। এই জ্ঞান, ভক্তি এবং কর্মের সমন্বয়ই হলো আত্মার পরম উপলব্ধি।
পুরুষোত্তমের আরেকটি দৃষ্টিকোণ
অন্য মত অনুযায়ী, অক্ষর হলো অব্যক্ত প্রকৃতি বা মায়া এবং ক্ষর হলো ব্যক্ত জগৎ। উভয়ের অতীত অবস্থানে থাকা ব্রহ্মই হলেন পুরুষোত্তম। আবার অনেকে মনে করেন, ক্ষর মানে প্রকৃতি এবং অক্ষর মানে জীবাত্মা। উভয়ের অতীতে যিনি বিরাজ করেন, তিনিই পুরুষোত্তম।
শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “যে ব্যক্তি মোহমুক্ত হয়ে আমাকে পুরুষোত্তম বলে জানতে পারে, সে সর্বজ্ঞানী এবং সর্বতোভাবে আমাকে ভজন করে।” এই তত্ত্ব জানার মাধ্যমে জীব পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছায়।
পুরুষোত্তমতত্ত্বের গুরুত্ব
শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে বলেছেন, “আমিই পরতত্ত্ব পুরুষোত্তম। ক্ষর ও অক্ষর উভয়ের অতীতে আমি অবস্থান করি। আমাকে জানলে আর কিছুই জানার প্রয়োজন হয় না। আমি নির্গুণ, সগুণ, বিশ্বরূপ এবং অবতার। এই গুহ্যতত্ত্ব জানলে জীব মুক্তি পায়।”
শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব: ধর্ম সংস্থাপনের প্রয়াস
যখনই পৃথিবীতে অধর্ম বৃদ্ধি পেয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ তখনই অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছেন। দ্বাপর যুগে রোহিণী নক্ষত্রে, অষ্টমী তিথিতে, কংসের কারাগারে দেবকী ও বসুদেবের প্রার্থনায় তিনি জন্ম নেন। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সদা প্রস্তুত।
ভক্তদের প্রিয় পুরুষোত্তম
ভক্তদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ কেবল এক দেবতা নন, পরিবারের একজন সদস্যের মতো। তিনি ভক্তদের যে নামে ডাকেন, সে নামেই সাড়া দেন। তাঁদের যে রূপে তাঁকে পেতে ইচ্ছা হয়, শ্রীকৃষ্ণ সেই রূপেই ধরা দেন।
তিনি মহাকাল ও মহাজগতের অন্তরে বিরাজমান শাশ্বত সত্য। এই কারণে ভক্তরা তাঁকে বিভিন্ন নামে সম্ভাষণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ হলেন সেই চূড়ান্ত সত্তা, যিনি ন্যায় ও শান্তির প্রতিষ্ঠা করেন এবং জীবকে মুক্তির পথে পরিচালিত করেন।
শ্রীকৃষ্ণ: শাশ্বত শান্তির প্রতীক
শ্রীকৃষ্ণ কেবল একটি ঐতিহাসিক চরিত্র নন; তিনি শাশ্বত শান্তি ও ধর্মের প্রতীক। জীবনে যে সংকটই আসুক, ভক্তরা তাঁর উপদেশ অনুসরণ করে মুক্তি লাভ করতে পারেন। তাঁর তত্ত্ব ও শিক্ষা আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের পথপ্রদর্শক।
শ্রীকৃষ্ণ সেই পুরুষোত্তম, যিনি ভক্তদের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য বারবার এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন।