হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর তিরোধনের পর মুসলমানগণ দুই দলে বিভক্ত হয়ে পরে এক দল অর্থাৎ সুন্নি সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে নবী (সা.) তার কোন প্রতিনিধি নিয়োগ করে যাননি বরং এ গুরু দায়িত্ব তার উম্মতদের উপর অর্পন করে গেছেন। আর অন্য দল অর্থাৎ শিয়া সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে তিনি তার প্রতিনিধি বা ইমাম নিযুক্ত করে গেছেন। এই ইমামদের সংখ্যা হচ্ছে বারোজন, যাদের প্রথম হচ্ছেন হযরত আলী (আ.) আর শেষ হযরত মাহদী (আ.)। এই বারো ইমাম সর্ম্পকে বিভিন্ন হাদীস ও রেওয়াযেত বর্ণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহ হচ্ছে সহীহ আল বুখারী, সহীহ আল মুসলিম, সহীহ আত তিরমিযি, আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ। ইমামত নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলে ও হযরত মাহদী (আ.) যে শেষ ইমাম এবং শেষ যামানায় তার আবির্ভাব ঘটবে তার ইমামত সম্পর্কে কারো মধ্যেই কোন মতভেদ নেই। অবশ্য বাহাই সম্প্রদায় এ সর্ম্পকে ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করে থাকে। শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই নয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা ও তাদের ধর্মীয় গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীর শেষ যুগে একজন ত্রাণকর্তা ও মুক্তির দূত আসবেন-যিনি সমস্ত দুনিয়াকে অন্যায়-অবিচার-জুলুম-অত্যাচার ও নির্যাতনের কবল হতে মুক্ত করবেন। তিনি বিশ্বব্যাপি ইসলামী হুকুমাত ও ন্যায়বিচার কায়েম করবেন এবং পৃথিবীর বুক থেকে অসত্য এবং শোষণের পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। তার আগমন অবশ্যম্ভাবী এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই। তার আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবেনা।
প্রথম দল অর্থাৎ সুন্নি সম্প্রদায় ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের আকিদা ও বিশ্বাস মতে ইমাম মাহদী আ. শেষ যুগে মানবতার মুক্তি দূত হিসেবে আগমন করবেন। তিনি কবে ও কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন বা করেছেন কিনা সে বিষয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তারা শুধুই তাঁর আবির্ভাবের অপেক্ষায় রয়েছেন।
কিন্তু অন্য দল অর্থাৎ শিয়া সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, যেহেতু রাসূল স. তার প্রতিনিধি বা ইমাম নিযুক্ত করে গেছেন। এই ইমামদের সংখ্যা হচ্ছে বারোজন, যাদের প্রথম হচ্ছেন হযরত আলী (আ.) এবং শেষ হযরত মাহদী (আ.)। শুধু তাই নয় এই বারো জন বংশপরম্পরায় পৃথিবীতে আগমণ করবেন। যেহেতু প্রথম হযরত আলী (আ.) সবার কাছেই অত্যন্ত পরিচিত এবং একাধারে তাঁর বংশধর ইমামগণ জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে সর্বদাই পরিচিত ছিল। তাই শেষ যুগের ইমাম অর্থাৎ ইমাম মাহদী (আ.) কবে ও কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন, তা তাদের কাছে দিবালোকের মতই অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আমাদের এই প্রবন্ধে ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত শিয়া সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গিই তুলে ধরব ইন শা আল্লাহ।
নাম ও উপনাম : এই মহান ব্যক্তির নাম সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার নাম ও উপনাম হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নামেই।
নাম : মুহাম্মদ ।
উপনাম : আবুল কাসেম। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন “মাহদীর নাম আমার নামেই” অনুরূপ ভাবে হযরত আলী (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে “মুহাম্মদ” মাহদীর নাম। (বোরহান ফি আলামতে মাহদী আখেরী যামান, মুত্তাকী হিন্দি, ৩য় অধ্যায় হাদিস নং ৮,৯।)
উপাধী : তার বিভিন্ন উপাধীর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্ল্যেখযোগ্য হচ্ছে মাহদী, কাসেম, সাহেবুজ্জামান, সাহেবুল আমর , মুনতাজার ও হুজ্জাত । তবে তিনি মাহদী নামেই অধিক পরিচিত। এটি তার সু প্রসিদ্ধ নাম। তাকে ‘মাহদী’ বলা হয়েছে এ কারণে যে, তিনি নিজে হেদায়েত প্রাপ্ত এবং অন্যদেরকে সঠিক পথে হেদায়েত দান করবেন। তাকে ‘কায়েম’ বলা হয়েছে কেননা তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন। তাকে ‘মুনতাজার’ বলা হয়েছে কেননা সকলেই তার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। তাকে ‘বাকিয়াতুল্লাহ’ বলা হয়েছে কেননা তিনি হচ্ছেন আল্লাহর হুজ্জাত। হুজ্জাত অর্থাৎ সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর স্পষ্ট দলিল ।
বংশ পরিচয় : তিনি নবী পরিবারের বারোতম পুরুষ, ইমাম হোসাইন (আ.) এর নবম বংশধর, পিতা ১১ তম ইমাম হযরত হাসান আসকারী (আ.), মাতা নারজেস।
জন্ম : হযরত মাহদীর (আ.) জন্ম ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। যা মনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। হযরত হাসান আসকারী (আ.) ইরাকের সামেরায় জীবন যাপন করতেন। ইমামকে আব্বাসী খলিফা মুতাওয়াক্কেল নজর বন্দী করে রাখত। মাঝে মধ্যেই খলিফার কর্মচারীরা ইমামের বাড়ী হানা দিত। তাকে খলিফার দরবারে জোর করে নিয়ে যেত এবং বিভিন্নভাবে তার উপরে নির্যাতন চালাত। (বিহারুল আনওয়ার, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং-৯৩।)
ইমাম মাহদী (আ.) এর জন্ম সম্পর্কে ঐ সময়ের মুসলমানরা এমনকি শাসকরা পর্যন্ত জানতো যে, ইমাম আসকারী (আ.) এর ঔরসে এক মহামানব জন্ম গ্রহন করবেন। যিনি সমস্ত অন্যায়, অবিচার জুলুম অত্যাচারকে সমুলে উপড়ে ফেলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এই কারণে তারা ইমামের উপর বিভিন্ন কঠোরতা, অবরোধ আরোপ করে। যেন তাকে নিঃশেষ করে ইমাম মাহদী (আ.) এর জন্ম ও ইমামতের ধারাকে রুখতে পারে। (শেখ তুসি, কিতাবুল গেইবাত, পৃ. ২৩১।)
ইমাম আসকারী (আ.) তার ঘনিষ্ঠ জনদেরকে তার পরবর্তী ইমামের দুনিয়ায় আগমনের সংবাদ দিয়ে বলতেন শিঘ্রই আল্লাহ আমাকে একজন সন্তান দান করবেন এবং আমাকে তার দয়া ও অনুকম্পার অন্তর্ভুক্ত করবেন। আরও বলতেন যে, কোন শক্তিই কোন ষড়যন্ত্রই মহান আল্লাহ তা’আলার এই ইচ্ছাকে রুখতে পারবেনা। আল্লাহর অঙ্গিকার পূর্ণ হবেই। অন্যদিকে শত্রুরাও তাদের সমস্ত শক্তি সামর্থ নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। যেন আল্লাহর এই অঙ্গিকার পূর্ণতা না পায়। তারা ইমামকে সম্পূর্ণ নজর বন্দী করে রাখে, এমনকি তার বাড়িতে তার সঙ্গী-সাথী, আত্মীয় স্বজন এবং পাড়া প্রতিবেশীদের যাওয়া আসা ও নিয়ন্ত্রন করতো । কিছু কর্মচারীকে শুধুমাত্র এই কারণে নিযুক্ত করে রেখেছিল যে, যদি কোন ছেলে সন্তানকে ইমামের বাড়িতে ভূমিষ্ট হতে দেখে তাহলে যেন তাকে হত্যা করে। (ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাহ, হাফিজ সুলাইমান,পৃ. ৪৫৫।) এত কিছুর পরে ও নারজেস খাতুন গর্ভবতী হন, শুধুমাত্র ইমাম এবং তার বিশেষ কিছু সঙ্গী সাথী ও নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ এ খবর জানতো না ।
অবশেষে এই মহান ব্যক্তি ১৫ ই শাবান ২৫৫ হিজরী ইরাকের সামেরা শহরে জন্ম গ্রহন করেন। যারা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার আহলে বাইত (ইমামদের) থেকে ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে বর্ণিত সহীহ মুতাওয়াত্তির হাদীসের প্রতি ইমান রাখে, তাদের জন্য মাহদী (আ.) ও তার জন্মের ব্যপারে ইমান রাখা ও স্বীকার করা ওয়াজিব। এটা অসম্ভব ব্যপার, যে ইমাম মাহদী (আ.) এখন ও দুনিয়াতে আসেননি । হাদীসে এসছে নবী (সা.) বলেছেন “ দ্বীন ইসলাম ধ্বংস হবেনা কিয়ামত পর্যন্ত অথবা বারোজন খলিফার আগমন পর্যন্ত তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছেন আলী ইবনে আবি তালিব অত:পর হাসান তারপর হোসাইন (আ.) তারপর মুহাম্মদ ইবনে আলী , আলী ইবনে মুহাম্মদ, হাসান ইবনে আলী এবং তাদের সর্ব শেষ হচ্ছেন আল মাহদী (আ.) ”। (সহীহ মুসলিম,৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩-৪ ; সহীহ আল বুখারী ৪র্থ খণ্ড , পৃ. ১৫৬; ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৯ ; সহীহ আত তিরমিযি ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪২; সুনানে আবু দাউদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০২; কানযূল উম্মাল; ১২তম খণ্ড,পৃ. ১৬৫।)
এটা ও সত্য এবং প্রমানিত যে, ইমাম আসকারী (আ.) বিষাক্রান্ত হয়ে দুনিয়া থেকে চলে যান। তার দাফন কাফন ও জানাযায় হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহন করেছিল এবং জনগনের সম্মুখেই তাকে কবর দেয়া হয়। ইমাম মাহদী (আ.) এর জন্ম হয়েছে এ কথা মেনে নেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। কেননা এটা অসম্ভব ব্যপার যে, তার পিতা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন অথচ তার জন্ম হয়নি অথবা তার পিতার মৃত্যুর সময় তিনি মাতৃগর্ভে ছিলেন এবং পিতার মৃত্যূর কিছু কাল পর ভুমিষ্ট হয়েছেন। কেননা এটা কখোনই সম্ভব নয় যে, একজন মানুষ মারা যাবে আর তার সস্তান যে তার রক্ত মাংশে মিশে আছে শত শত বছর পর জন্ম নিবে। নিঃসন্দেহে ইমাম মাহদী (আ.) ভুমিষ্ট হয়েছেন এতে কোন সন্দেহ, সংশয় নেই এবং তিনি এখন পর্যন্ত জীবিত আছেন এবং আল্লাহর নির্দেশে লোক চক্ষুর অন্তরালে আত্মগোপন করে আছেন। এটা ও সম্ভব পর নয় যে, তিনি আত্মপ্রকাশের পূর্বেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন।
ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও মহামানব রাসূল (সা.) এর সাথে ইমাম মাহদীর বেশ কিছু বিষয়ে চমৎকার মিল পাওয়া যায়। মহানবী (সা.) যেমন সর্বশেষ নবী তেমনি ইমাম মাহদী ও সর্বশেষ ইমাম। মহানবী (সা.) এর শুভাগমন সম্পর্কে যেমন পূর্ববর্তী নবী বা রাসূলগণ ভবিষ্যৎ বাণী করে গেছেন, তেমনি ইমাম মাহদী (আ.) এর আগমন সম্পর্কেও মহানবী (সা.) এবং পূর্ববর্তী ইমামগণ বাণী রেখে গেছেন।
প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদীকে সাধারণত : ‘ইমামুল আসর’ বা নির্দিষ্ট সময়ের ইমাম এবং সাহিবুজ্জামান বা জামানার নেতা বলা হয়। জন্মের পর মহানবী (সা.) এর নামেই তার নাম রাখা হয়। তিনি জন্মের পর থেকে তার শ্রদ্ধেয় পিতা ইমাম আসকারী (আ.) এর প্রত্যক্ষ ও বিশেষ তত্ত্বাবধানে ছিলেন। স্বৈরশাসকের হুমকীর কারণে ইমামে মাহদীর (আ.) জন্মের খবর গোপন রাখা হয়েছিল। কারণ আব্বাসীয় শাসকরা ইমামের বংশ ধারকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে হন্যে হয়ে খুজছিল। বাড়ি বাড়ি তল্লাশী করে খুজে বের করার জন্য ওরা গোপন ঘাতক বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল। তাই স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা শিশু ইমামকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা ও সুরক্ষিত রেখেছিলেন।