খুলাফায়ে রাশেদিন এর শাব্দিক অর্থ ন্যায় পরায়ন, ন্যায়নিষ্ঠ, সঠিকভাবে পথনির্দেশপ্রাপ্ত খলিফা। ইসলাম ধর্মের শেষ বাণীবাহক নবী মুহাম্মদের পর ইসলামী বিশ্ব শাসনকারী চারজনকে খুলাফায়ে রাশেদিন বলা হয়। তারা মুহাম্মদের সহচর ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর ইসলামের নেতৃত্ব দেন। এই চারজন হলেন: (ক) হযরত আবু বকর (রা:) (খ) হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা:) (গ) হযরত উসমান ইবন আফ্ফান (রা:) (ঘ) হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা:)
হযরত আবু বকর (রা:) এর জীবনী:
জন্ম:-অক্টোবর ৫৭৩ মক্কা,আরব দ্বীপ। মৃত্যু:-২২ আগষ্ট ৬৩৪ মদিনায়। সনকাল :-৮ জুন ৬৩২-২২ আগষ্ট ৬৩৪। বংশ:- সিদ্দিকি। হযরত আবু বকর (রা:) ইসলাম ধর্মের প্রথম খলিফা, হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর শ্বশুর। মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য নাম ছিল আবদুল্লাহ্, আবু বকর ছিল তার ডাক নাম। তিনি আশারাতুল মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত। হযরত মুহাম্মদ (স:) এর প্রিয় সাহাবি ছিলেন। তাছাড়া ইসলামের প্রথম মুসলিম পুরুষ হযরত আবু বকর (র:)। ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি সিদ্দীক (সত্যবাদী) এবং আতিক (দানশীল) খেতাব লাভ করেছিলেন। আবু বকরের পিতার নাম ছিল ওসমান, কিন্তু ইতিহাসে তিনি আবু কুহাফা নামেই সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর মাতার নাম উম্মুল খায়ের সালমা। আবু বকরের মাতাপিতা উভয়েই বিখ্যাত কুরাইশ বংশের তায়িম গোত্রের ছিলেন। তার মা প্রথমদিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পিতা হিজরীর অষ্টম বৎসরে ইসলামে দীক্ষিত হন।
আবু বকরের স্ত্রী কুতাইলা বিনতে আবদুল উজ্জা ইসলাম গ্রহণ করেন নি। তাই আবু বকর (রা:) তাকে তালাক দিয়েছিলেন এবং অন্য স্ত্রী উম্ম রুমান ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ছেলে আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর ছাড়া অন্য সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ফলে আবু বকরের সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে। আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর পরবর্তীকালে মুসলিম হয়েছিলেন। আবু বকরের ইসলাম গ্রহণ অনেককে ইসলাম গ্রহণে অণুপ্রাণিত করেছে। তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহ যোগান। তার দ্বারা উৎসাহিত হয়ে অনেকে গ্রহণ করেছিলেন।
হযরত মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। মুহাজির ও আনসাররা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচনের পক্ষে ছিল। কিছু গোত্র পুরনো প্রথা অনুযায়ী গোত্রভিত্তিক নেতৃত্ব ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়। আনসাররা সাকিফা নামক স্থানে একত্রিত হয়ে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। এরপর আবু বকর, উমর ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ এখানে আসেন। সভার আলোচনায় এক পর্যায়ে উমর ইবনুল খাত্তাব আবু বকরের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহও তার অনুসরণ করেন। এরপর বাকিরাও আবু বকরকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়।
সুন্নিরা তাকে “খলিফাতুর রাসুল” বা “আল্লাহর রাসুলের উত্তরাধিকারী” বলে সম্মান করে থাকে। তবে শিয়ারা আবু বকরকে বৈধ খলিফা বলে স্বীকার করে না। শিয়া মতাদর্শ অনুযায়ী হযরত প্রথম খলিফা হিসেবে যোগ্য। আবু বকর ছিলেন ইসলামের এক জলন্ত নক্ষত্র । তাঁর শাসনামলে ইসলাম ও জনগনের জন্য তিনি যুদ্ধও করেছেন। আবু বকরের খিলাফত ২৭ মাস অর্থাৎ দুই বছরের কিছু বেশি সময় স্থায়ী ছিল। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তাকে বেশ কিছু অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হতে হয় এবং তিনি তা সফলভাবে মোকাবেলা করেন। নতুন নবী দাবিকারী বিদ্রোহীদেরকে তিনি রিদ্ধার যুদ্ধে দমন করেছেন। তিনি বাইজেন্টাইন ও সাসনীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পরে হযরত উমর (রাঃ) ও হযরত উসমান (রাঃ) অভিযান অব্যাহত রেখেছিলেন।
এসব অভিযানের ফলে মুসলিম সাম্রাজ্য কয়েক দশকের মধ্যে শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়। খলিফা হওয়ার পর তিনি অন্যান্যদের পরামর্শক্রমে তার কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে দেন এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা গ্রহণ করতেন। এই মহান খলিফা শুধু জীবিত অবস্থায় নয় মৃত্যুর পরেও সকলের চোখের মনি ছিলেন। ৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি বিছানায় শায়িতাবস্থায় থাকেন। আবু বকর তার উত্তরসূরি মনোনীত করার জন্য প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন যাতে তার মৃত্যুর পর মুসলিমদের মধ্যে সমস্যা দেখা না দেয়। অন্যান্য সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে তিনি হযরত উমর (রাঃকে তার উত্তরসূরি হিসেবে নিয়োগ দেন। ৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট আবু বকর মারা যান। আয়েশার ঘরে হযরত মুহাম্মদ (স:)এর পাশে তাকে দাফন করা হয়। ইসলামের এই প্রথম খলিফা চির স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসের পাতায় রয়েছেন।
হযরত উমর (রা) এর জীবনী:
হযরত উমার (রাঃ) ছিলেন ঘোর ইসলাম বিরোধী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর নবুওয়াতের প্রথম পর্যায়ে। মক্কার নবদীক্ষিত মুসলিমদের উপর তিনি নির্যাতন চালাতেন । তিনি ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন বটে, কিন্তু পরোক্ষে ইসলামের প্রভাবে তাহার শুভবুদ্ধি ক্রমশ জাগরিত হয়েছিল। রাসূল (সঃ) এর অজ্ঞাতসারে একদা তাহার মুখে কুরানের আবৃত্তি শুনিয়া তাহার মনে ভাবান্তর ঘটার বর্ননা পাওয়া যায় । একদিন ভগিনী ও ভগ্নীপতিকে ইসলামে গ্রণের জন্য নির্দয়ভাবে শাসন করতে গিয়ে নিজেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং রাসূল (সঃ) এর নিকট উপস্থিত হইয়া ইসলাম গ্রহণ করেন । ইসলাম গ্রহণের ফলে তাহার জীবনের আমূল পরিবর্তন হয় । পরবর্তীকালে তিনি ইসলামের সেবার অক্ষয়কীর্তি রেখে যান ।
খিলাফত লাভের পূর্বে খেদমত: হিজরতের চার বছর পূর্বে যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ছাব্বিশ বছর। তাহার পর হইতে তিনি পূর্ন শক্তিতে ইসলামের খিদমতে নিয়জিত হয়ে পড়েন । মদিনায় তার ব্যক্তিগত উদ্যম এবং মনোবলের প্রভাবেই তিনি রাসূল (সঃ) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজে মর্যাদা লাভ করেন, গোত্রীয় মর্যাদারকারণে নয় । সৈনিক হিসাবেও তার প্রভূত খ্যাতি ছিল । তিনি বদর, উহুদ ও অন্যান্য যুদ্ধে যোগদান করেন । হাদিসে আছে যে, কুরআনের কয়েকটি স্থানে উমার (রাঃ) এর উক্তি সমর্থনে অয়ায়হি অবতীর্ন হইয়াছিল । যথাঃ ২:১২৫- কাবা গৃহের পার্শস্থ মাকাম ইব্রাহীমে সালাত আদায়; ৩৩:৫৩, রাসূল (সঃ) বিবিগণের সামনে পর্দা পালন ইত্যাদি ।
সাহাবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ) এর অগ্রগণ্য ছিলেন । হযরত উমার (রাঃ) বিনয় সহকারে তা স্বীকার করতেন এবং সর্বদা হযরত আবু বকর (রাঃ) কে যথোপযুক্ত সম্মান দেখাতেন । রাসূল কারীম (সঃ) এর বিবি হযরত হাফসা (রঃ) হযতর উমার (রাঃ) এর কন্যা ছিলেন । খেলাফত লাভ ও শাসনকার্য: হযরত আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফাতকালে হযরত উমার (রাঃ) ই ছিলেন তার প্রধান উপদেষ্টা । মৃত্যুর পূর্বে তিনি উমার (রাঃ) কেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেন, সাহাবীগণও সর্ব-সম্মতভাবে উমার (রাঃ) কে তাহাদের খলীফারুপে গ্রহণ করেন এবং এইরূপে নেতা নির্বাচনের আরবীয় প্রথানুসারে জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতেই উমার (রাঃ) তাঁর খিলাফাত শুরু করেন । মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধি করার জন্য যুদ্ধ করা তাঁর অভিপ্রেত ছিল না । যে সকল সেনাপতি মুসলিমদের প্রয়াসকে সাফল্যমণ্ডিত করেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের সকলের উত্তম ।
এইক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত । হযরত উমার (রাঃ) এর সময়েই ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব ভিত্তি স্থাপিত হয় । যখনই কোন প্রশ্ন বা সমস্যার উদ্ভব হতো, তিনি সাহাবী (রাঃ) গনকে একত্র করে জিজ্ঞাসা করতেন সেই ব্যাপারে হযরত (সঃ) এর কোন উক্তি বা সিদ্ধন্ত আছে কিনা তাহাদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেন । কুরআন ও সুন্নাহ্ই ছিল তাঁহার সংবিধান এবং বিশিষ্ট সাহাবী [যথা আলী, আব্দুর রাহমান ইবন আওফ (রাঃ) প্রমুখ] গণ ছিলেন তাঁহার পরামর্শ সভার সদস্য । তাঁর জীবন যাপনের মান সাধারণ নাগরিকের অনুরূপ ছিল । এই বিষয়ে হযরত উমার (রাঃ) এর দৃষ্টান্ত সত্যই বিরল । শাহাদত: উমার (রাঃ) এর অন্তরে আল্লাহ্র ভয় ও ভক্তির মধ্যে দৃশ্যত ভয়ই ছিল প্র্রলতর ।
তিনি যে সম্মান অর্জন করেন তা তাঁর চরিত্রগুণের কারনে, শারীরিক শক্তির জন্য নয়। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর সত্যিকারের সাহাবী এবং কুরআন ও সুন্নাহ্র পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসারী খলীফারুপে মর্যাদার উচ্চ শিখরে সমাসীন থাকাকালে ২৬ জুল হিজ্জাঃ ২৩/৩ নভেম্বর, ৬৪৪ সালে তিনি মুগীরাঃ ইবন শু’বা’র খ্রিষ্টান ক্রীতদাস আবু লু’লু’র ছুরিকাঘাতে শাহাদাত হন । ইতিহাসে কথিত হইয়াছে যে, উমার (রাঃ) এর নিকট আবু লু’লু’ তাঁহার মনিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে । উমার (রাঃ) এর বিচারে অসন্তুষ্ট হইয়া সে নিহায়েত ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে অতর্কিতভাবে তাহাকে হত্যা করে । মৃত্যুর পূর্বে উমর (রাঃ) ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর নাম উল্লেখ (‘ উসমান এবং আলী (রা:) ও তাহাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ) করেছিলেন পরামর্শক্রমে তাদের মধ্যে একজনকে খলীফা মনোনীত করার উপদেশ দিয়া যান ।
ইহার ফলে হযরত উছমান (রাঃ) খলীফা মনোনীত হন । উমার (রা) এর বিখ্যাত একটি উক্তি রয়েছে, তিনি বলেছিলেন সেই দুর্ভিক্ষের সময়, “আজ যদি ফোরাতের তীরে একটা কুকুর না খেতে পেয়ে মারা যায়, তবে তার জন্য আমি উমার আল্লাহ্র কাছে দায়ী থাকব।” শেষ করছি কবি নজরুলের একটা কবিতাংশ দিয়ে: “ইসলাম – সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি? পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি। আজ বুঝি – কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর- ‘মোর পরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর’।”
হযত উসমান (রা:) এর জিবনী:
পূর্ননামঃ উসমান ইবনে আফফান জন্মঃ ৫৭৭ খিস্টাব্দ। পেশাঃ ব্যবসায়ী। উল্লেখযোগ্য পদবীঃ ইসলামের তৃতীয় খলিফা। রাজত্বকালঃ ১১ নভেম্বর ৬৪৪ – ২০ জুন ৬৫৬। পূর্বসূরিঃ হযরত উমর (সাঃ)। উত্তরসূরিঃ হযরত আলী (রাঃ)। মৃত্যুঃ ৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ২০ জুন। সমাধিস্থলঃ জান্নাতুল বাকীর পিছনে জিউস কবর স্থানে। খোদায়ী বিধানের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, দানশীলতায় অগ্রগামী, লজ্জাশীলতায় সর্বকালীন দৃষ্টান্ত, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ‘ওসমান ইবনে আফফান’ ৫৭৩ মতান্তরে ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে (ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান) মক্কার ঐতিহ্যবাহী কোরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন মধ্যমাকৃতির অত্যন্ত সুদর্শন। ইবনে আসাকির আব্দুল্লাহ ইবনে হাজাম মাজেনি থেকে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হজরত ওসমান অপেক্ষা সুদর্শন কোনো পুরুষ আমি দেখিনি। হজরত ওসমান (রা.)-এর জীবনের প্রাথমিক অবস্থার ইতিহাস খুব সামান্যই সংরক্ষিত আছে। তবে যতটুকু জানা গেছে, জাহিলিয়াতের যুগে জন্ম হলেও জাহিলিয়াতের বীভৎসতা তাঁর চরিত্রকে কলুষিত করতে পারেনি। ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি ছিলেন হানিফ ঘরানার লোক। যাঁরা নিজের বিবেকের নির্দেশনায় খারাপ কাজ থেকে বিরত থেকেছেন।
তিনি ছিলেন আরবের মুষ্টিমেয় শিক্ষিত লোকের একজন। তিনি ছিলেন কোরাইশ বংশের অন্যতম কুস্তিবিদ্যা বিশারদ। কোরাইশদের প্রাচীন ইতিহাস বিষয়েও তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। বংশীয় আভিজাত্যের ধারায় তিনি ব্যবসায় নিয়োজিত হন। সর্বোচ্চ সততা ও বিশ্বস্ততার দরুন অল্প সময়েই তিনি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন। বিপুল ধন-ঐশ্বয্যের কারণে তিনি ‘গনি’ উপাধি লাভ করেন। মমতা, সহনশীলতা, আত্দমর্যাদাবোধ, দান ও লজ্জা ছিল তাঁর মহৎ চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এছাড়াও তিনি আশারায়ে বাশ্শারা’র একজন এবং সেই ৬ জন সাহাবীর মধ্যে অন্যতম যাদের উপর মুহাম্মদ আমরণ সন্তুষ্ট ছিলেন। এক নজরে হযরত ওসমান (রাঃ) ওসমান (রাঃ) এর পরিবার ও বংশ তিনি কুরাইশ বংশের উমাইয়্যা শাখার সন্তান ছিলেন। তার উর্ধ্ব পুরুষ আবদে মান্নাফে গিয়ে হযরত মুহাম্ম(সাঃ) এর বংশের সাথে মিলিত হয়েছে। তার নানী বায়দা বিনতু আবদিল মুত্তালিব ছিলেন হযরত মুহাম্ম(সাঃ)এর ফুফু। ইসলাম গ্রহণের পর হযরত মুহাম্ম(সাঃ) তার কন্যা রুকাইয়্যার সাথে তার বিয়ে দেন। হিজরী দ্বিতীয় সনে তাবুক যুদ্ধের পরপর মদিনায় রুকাইয়্যা মারা যায়। এরপর নবী তার দ্বিতীয় কন্যা উম্মু কুলসুমের সাথে তার বিয়ে দেন।
এ কারণেই তিনি মুসলিমদের কাছে যুন-নূরাইন বা দুই জ্যোতির অধিকারী হিসেবে খ্যাত। উসমান(রাঃ) এবং রুকাইয়্যা ছিলেন প্রথম হিজরতকারী মুসলিম পরিবার। তারা প্রথম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। সেখানে তাদের একটি ছেলে জন্ম নেয় যার নাম রাখা হয় আবদুল্লাহ ইবন উসমান। প্রাথমিক জীবন ও ইসলাম গ্রহনঃ কুরাইশদের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে তার অগাধ জ্ঞান ছিল। ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও তার এমন বিশেষ কোন অভ্যাস ছিলনা যা ইসলামী নীতিতে ঘৃণিত। যৌবনেকালে তিনি অন্যান্য অভিজাত কুরাইশদের মত ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা খাতে তার সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। মক্কার সমাজে একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন বলেই তার উপাধি হয়েছিল গনী যার অর্ধ ধনী। ইসলাম গ্রহনঃ হজরত ওসমান (রা.) প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম।
হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর উৎসাহে তিনি দ্বীনে ইসলাম গ্রহণ করেন যৌবনে, যখন তাঁর বয়স ত্রিশের কোটায়। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি ইসলাম গ্রহণকারী চারজনের মধ্যে চতুর্থ।’ হজরত আবু বকর, হজরত আলী ও জায়েদ বিন হারিসের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কোরাইশ বংশের অত্যন্ত সম্মানিত ও বিত্তবান ব্যক্তি হওয়া সত্তে¡ও ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তাঁকে কাফিরদের অমানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তাঁর চাচা ‘হাকাম ইবনে আবিল আস’ তাঁকে রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করত আর বলত, যতক্ষণ পর্যন্ত মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্ম ত্যাগ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোকে ছাড়া হবে না।
‘সীমাহীন নির্যাতনের পরও তাঁর ইমান একটুও টলেনি। খলিফা মনোনীত হওয়ার ইতিহাস: হযরত ওমর (রা.) যখন ছুরিকাহত হয়ে মৃত্যুশয্যায়, তখন তাঁর কাছে পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের দাবি উত্থাপিত হলে তিনি বলেন, তোমাদের সামনে এমন একটি দল রয়েছে, যাদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তাঁরা জান্নাতের অধিবাসী। তাঁরা হলেন হযরত আলী, ওসমান, আব্দুর রহমান, সাদ, জুবাইর ও তালহা। তাঁদের যেকোনো একজনকে খলিফা নির্বাচিত করতে হবে। হযরত ওমর (রা.)-এর মৃত্যুকালীন উপরিউক্ত উক্তি থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয়, আদর্শের মানদন্ডে উন্নীত রাসুল (সা.)-এর জবানে জান্নাতের বাশারাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই খিলাফতের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী।
অর্থাৎ উপরিউক্ত ব্যক্তিদের আয়ুষ্কাল পর্যন্তই ‘খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়্যাহ’ সীমাবদ্ধ। হজরত ওমর (রা,) উল্লিখিত ছয়জনকে নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করে তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়ে বললেন, ‘আমার মৃত্যুর পর তাঁরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজেদের যেকোনো একজনকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে খলিফা মনোনীত করবেন।’ হজরত ওমর (সা.)-এর ইন্তেকাল হলো। বোর্ড সদস্যরা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলেন, তুমুল তর্ক-বিতর্ক, বাগ্বিতণ্ডা চলল। সময় গড়িয়ে দুই দিন পেরিয়ে গেল। মসজিদে নববি লোকে লোকারণ্য। শেষদিনে আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বললেন, ‘আমি আমার খিলাফতের দাবি ত্যাগ করছি।
এবার তোমরা তোমাদের মধ্যে যোগ্যতম ব্যক্তি নির্বাচনের দায়িত্ব আমাকে অর্পণ করতে পারো।’ সবাই খলিফা নির্বাচনের ক্ষমতা আব্দুর রহমানকে অর্পণ করলেন। তিনি সম্ভ্রান্ত সবার সঙ্গে পরামর্শ করলেন। অতঃপর ওমর (রা.) কর্তৃক বেঁধে দেওয়া সময়ের শেষ দিনে ফজরের নামাজের পর মসজিদে নববিতে সমবেত মদিনাবাসীর উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর তিনি খলিফা হিসেবে হযরত ওসমান (রা.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন, অতঃপর সবাই। এভাবে মানবতাবাদী, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সদাতৎপর, বিনয় ও ভদ্রতার অবতার হযরত ওসমান (রা.) খিলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। খলিফা হিসেবে হযরত ওসমান (রাঃ): দ্বায়িত গ্রহনের পরে হযরত উসমান (রাঃ) তা’লা পুরো রাজ্য জুড়ে বেশ ক’জন নির্দেশকারী তথা দূত নিযুক্ত করেছিলেন।
তাদের দ্বায়িত্ব ছিলো হযরত উমর (রাঃ) এর প্রণয়নকৃত আইনসমূহ কে অধিষ্ঠান করা। উসমান (রাঃ) এর রাজত্ব বিস্তৃত করেছিলেন পশ্চিম থেকে পুরো মরোক্কো পর্যন্ত, পূর্ব দক্ষিন পূর্ব তথা বর্তমান পাকিস্তান পর্যন্ত এবং উত্তর আমেরিকা থেকে আজারবাইজান পর্যন্ত।। উসমান (রাঃ) এর রাজত্বকালে তিনিই সবপ্রথম ইসলামিক নৌবাহিনি গড়ে তুলেছিলেন।উসমান(রাঃ) অনেক বিশিষ্ট সাহাবাদেরকে উনার নিজস্ব প্রতিনিধি হিসেবে, রাজত্বের অবস্থা, জনগনের সুযোগ সুবিধা, অসুবিধা, অবস্থা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, তার বাস্তবায়ন খতিয়ে দেখার লক্ষে বিভিন্ন প্রদেশে পাঠাতেন। উসমান(রাঃ) বারো বছর যাবৎ খলিফা হিসেবে রাজত্ব করেছিলেন।
এই রাজত্বকালের প্রথম ছয় বছর রাজ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করেছিলেন এবং তিনি খুব খুলাফায়ে রাসিদিন দের মধ্যে অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, পরবর্তী সময়ে তিনি রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। ওসমান (রাঃ) এর শাসনকালে উন্নয়ন: বিপুল ধন-ঐশ্বয্যের মালিক হযরত ওসমান (রা.) মুসলিম জাহানের খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। হযরত হাসান (রা.) থেকে বর্ণিতথতিনি বলেন, হযরত ওসমান (রা.) মসজিদে নববিতে মাথার নিচে চাদর দিয়ে শুয়ে থাকতেন। মানুষ তাঁর পাশে এসে বসত।
তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। মনে হতো তিনি তাদেরই একজন। জুবাইর ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন, ‘হযরত ওসমান সারা বছর রোজা রাখতেন এবং সারা রাত নামাজ পড়তেন। রাতের প্রথমার্ধে একটু ঘুমাতেন।’ হযরত ওসমান (রা.) তাঁর শাসনামলের প্রথমদিকে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। তাঁর জনহিতকর কার্যাবলি সমাজের আদল পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তিনি মদিনা শহর রক্ষাবাঁধ ‘মাহরু’ নির্মাণ করেন। খাল খনন করে কৃষিতে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন।
পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করে জনগণের অত্যন্ত প্রিয় খলিফায় পরিণত হন। মসজিদে নববির আধুনিকায়ন করেন তিনি। তাঁর সময় অর্থনৈতিক সচ্ছলতা মদিনার ঘরে ঘরে পৌছে গিয়েছিল। আল-কুরআন সংকলনে অবদান: কোন আয়াত বা সূরা নাযিলের পরপর সাহাবাদের মুখস্ত করতে ও লিখে রাখতে নির্দেশ দেয়া হত। এটা বলা ভুল যে হযরত ওসমান (রাঃ) কুরআন সংকলন করেছেন প্রকৃতপক্ষে রাসুল (সাঃ)-এর জীবিতকালে কুরআন সংকলন ও সংরক্ষিত হয়েছিল। যখন কোন আয়াত রাসুল (সাঃ) এর প্রতি নাযিল হতো তিনি অনতিবিলম্বে তা মুখস্ত করে নিতেন এবং সাহাবাদের শোনাতেন এবং তাদেঁর মুখস্ত করতে ও লিখে রাখতে নির্দেশ দিতেন,এবং তিনি সাহাবাদের পড়িয়ে শোনাতে বলতেন শুদ্ধতা যাচাই করতেন অর্থাৎ সাহাবীদের স্মরন শক্তি পরীক্ষা করে দেখতেন ।
তিনি সাহাবাদের সুরার ধারাবাহিকতা বলে রাখতেন ,যেমন-প্রথম যে সুরা নাযিল হয়েছে সুরা ইকরা যা পবিত্র কুরআনে ৯৬নং সূরা যা তিনি জীবরঈল (আঃ) এর মাধ্যমে জানতে পেরেছেন । বর্তমানে যে পর্যায় ক্রমিক সূরায় কুরআন সংকলিত আছে তার অনুরূপ ‘লাওহে মাহফুজে’ লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রতি রমজানে রাসুল (সাঃ) জীবরাঈল (আঃ) দ্বারা পুনরাবৃত্তি করতেন তাঁর মৃত্যুকালীন বছরে রমজানের সময় তিনি দুবার পুনরাবৃত্তি করছিলেন। কুরআন একত্রিকরন: কুরআন সংরক্ষিত হয়েছিল বিভিন্ন আঙ্গিকে-গাছের বাকলে,চমড়ায় ,উটের সেডলে ,সমতল পাথরে,গাছের পাতায়। ১ম খলীফা আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফত কালে ইয়ামামার যুদ্ধে বহু কুরআনে হাফেজ শহীদ হন। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ) সাহাবীগনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে যয়িদ-বিন-সাবিদ(রাঃ)-কে কুরআন সংকলনের জন্য দায়িত্ব প্রদান করেন।
সব সাহাবীদের একসাথে করে যয়িদ-বিন-সাবিদ (রাঃ) সব কুরআনের আয়াতকে একসাথে করেন। এরপর তা দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) এর তত্তাবধানে আসলে তাঁর হাত হতে হযরত হাফসা (রাঃ) এর নিকট পৌঁছায়। রাসুল (সঃ) এর বন্ধু: আলাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে হজরত ওসমান (রা.)-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মানবতার কল্যাণে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গকারী এ সাহাবি সম্পর্কে রাসুলে খোদা (সা.) বলেছেন, ‘উসমান হলো তাঁদেরই একজন, যাঁরা আলাহ ও রাসুলকে বন্ধু ভাবেন এবং আলাহ ও রাসুল তাঁদের বন্ধু ভাবেন।’ রাসুলুলাহ (সা.) প্রথমে নিজের মেয়ে হজরত খাদিজার (রা.) গর্ভজাত সন্তান রুকাইয়াকে ওসমান (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ দেন।
হজরত রুকাইয়ার ইন্তেকাল হলে তাঁর সহোদরা উম্মে কুলসুমকে হজরত ওসমান (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। রাসুল (সা.)-এর দুই মেয়েকে বিয়ের কারণে তাঁকে ‘জিননুরাইন’ বলা হয়। উম্মে কুলসুমের ইন্তেকালের পর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার যদি আরো একটি মেয়ে থাকত, তাহলে তাকেও আমি ওসমানের সঙ্গে বিয়ে দিতাম।’ তিনি রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে পীড়িত স্ত্রী রুকাইয়ার সেবায় মদিনায় অবস্থানের কারণে একমাত্র বদর ছাড়া সব যুদ্ধেই রাসুলুলাহ (সা.)-এর সঙ্গে অংশ নেন।
রাসুলুলাহ (সা.) তাঁকে একাধিকবার জান্নাতের শুভ সংবাদ দিয়েছেন। রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে, জান্নাতে আমার বন্ধু হবে ওসমান।’ তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর কাতেবে ওহি দলের অন্যতম। মৃত্যুর পূর্বের পেক্ষাপট ও মৃত্যু হজরত ওসমান (রা.) খিলাফতের মসনদে আসীন হয়েই বড় ধরনের এক সমস্যার সম্মুখীন হন। ‘উবায়দুলাহ ইবনে উমার’ হজরত ফারুকে আজমের হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে কয়েকজন নাসারা ও মুনাফিক প্রকৃতির মুসলমানকে হত্যা করেন। বিষয়টি খলিফার সামনে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার পূর্বাভাস হিসেবে আবির্ভূত হলো। হজরত ওসমান (রা.) নিজের সম্পদ থেকে নিহতদের ওয়ারিশদের রক্তপণ দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করলেন। ফলে মুসলমানদের ভেতরের সব বিভেদের অবসান হয়। হজরত ওসমান (রা.) অত্যন্ত জনপ্রিয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যেতে লাগলেন।
কিন্তু খলিফার সরলতা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার সুযোগে স্বার্থান্বেষী চক্র হজরত ওসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। বনি হাশিম ও বনি উমাইয়ার বিরোধ, কোরাইশ-অকুরাইশ দ্বন্দ্ব, মুহাজির-আনসার স¤প্রীতি বিনষ্ট, ইবনে সাবরে অপপ্রচার, অমুসলিমদের বিদ্বেষ ইত্যাদি কারণে মুসলিম সাম্রাজ্যে এক চরম সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি হলো। খিলাফতের অষ্টম বছরে এসে হজরত ওসমান (রা.) স্বজনপ্রীতি, কোরআন দগ্ধীকরণ, চারণভূমির রক্ষণাবেক্ষণ, আবুজর গিফারির নির্বাসন, বাইতুল মালের অর্থ অপচয় ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিরুদ্ধবাদীদের চরম বিরোধিতা ও বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। হজরত আলী (রা.)-এর সমর্থকদের অপপ্রচার বিদ্রোহের আগুনে ইন্ধন হিসেবে কাজ করে। অথচ খলিফার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই ছিল মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও অবাস্তব। হাম্মাদ ইবনে সালামা বর্ণনা করেন, ‘ওসমান (রা.) যেদিন খলিফা নির্বাচিত হন, সেদিন তিনি সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন।
আর যখন তাঁকে লোকেরা হত্যা করল, তিনি সেদিন থেকেও উত্তম ছিলেন যেদিন তাঁকে খলিফা বানানো হয়েছিল।’ রাসুলুলাহ (সা.) বলে গেছেন, ‘আলাহ পাকের হিকমতানুসারে জিননুরাইনের ওপর মতানৈক্য দেখা দেবে এবং লোকেরা তাঁকে শহীদ করবে। অথচ তিনি তখন হকের ওপরই থাকবেন এবং তাঁর বিরোধীরা থাকবে বাতিলের ওপর।’ শেষ পর্যন্ত মিসর, বসরা ও কুফার বিদ্রোহী গোষ্ঠী একাট্টা হয়ে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় সমবেত হয়ে খলিফার পদত্যাগ দাবি করে। হজ উপলক্ষে অধিকাংশ মদিনাবাসী মক্কা গমন করায় তারা এ সময়কেই মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। খলিফা পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে তারা হত্যার হুমকি দিয়ে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
হজরত ওসমান (রা.) রক্তপাতের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। বিশাল মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে মুষ্টিমেয় বিদ্রোহীর কঠোর শাস্তিদানের পরিবর্তে তিনি তাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে থাকলেন। হজরত আলী, তালহা ও জুবাইর (রা.)-এর ছেলেদের দ্বারা গঠিত ১৮ নিরাপত্তারক্ষী বিপথগামী বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় ব্যর্থ হন। অবশেষে তারা ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন হিজরি ৩৫ সনের ১৮ জিলহজ্জ শুক্রবার আসরের নামাজের পর ৮২ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ খলিফাকে অত্যন্ত বর্বরভাবে হত্যা করে। তিনি ১২ দিন কম ১২ বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। জুুবাইর ইবনে মুতইম (রা.) তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন। জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়।
হযরত আলী (রাঃ) -এর জীবনী:
হযরত আলী (রাঃ) (৬৫৬ – ৬৬১) ইসলামের চতুর্থ ও শেষ খলিফা । হয়রত আলী কোরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন । শিশু বয়স থেকেই তিনি হযরত মুহাম্মদের সঙ্গে লালিত-পালিত হন ।। হয়রত আলী কোরায়েশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন । শিশু বয়স থেকেই তিনি হযরত মুহাম্মদের সঙ্গে লালিত-পালিত হন । ইসলামের ইতিহাসে তিনি পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি হযরত মুহাম্মদের সাথে নামাজ আদায় করতেন । বালক দের মধ্যে তিনি সর্ব প্রথম বালক যিনি নবুয়তের ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন । তিনি ছিলেন একজন অকুতভয় যোদ্ধা । বদর যুদ্ধে বিশেষ বীরত্তের জন্য মুহাম্মদ তাঁকে জুলফিকার নামক তরবারি উপহার দিয়েছিলেন ।
খাইবারের সুরক্ষিত কামূস দুর্গ জয় করলে মহানবী তাঁকে “আসাদুলাহ” বা আলাহর সিংহ উপাধি দেন । তিনি ছিলেন রাসূল (সা:) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (রা:) এর স্বামী । রাসূল (সা:) যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিযরত করেন তখন হযরত আলীকে রাসূল (সা:) এর বিছানায় রেখে যান । তিনি সাহসের সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন ।হযরত আলী(রাঃ) একজন দুঃসাহসী এবং দক্ষ কৌশলী যোদ্ধা ছিলেন। তিনি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে প্রায় সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মহানবী(সাঃ) এর কন্যা হযরত ফাতিমা(রাঃ) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। খেলাফতের নির্বাচনের পরপরই তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী, মদীনা থেকে ইরাকের কুফায় সরিয়ে নেন, যা ছিল অধিকতর কেন্দ্রীয় একটি স্থান।
তাঁর নির্বাচনের পরপরই তিনি জনগণের বিশেষ করে মহানবী (সাঃ) এর প্রভাবশালী সাহাবী যেমন হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ) এর উত্থাপিত ‘হযরত উসমান(রাঃ)-এর হত্যাকারীদের যথাশীঘ্র শাস্তির জনপ্রিয় দাবীর সম্মুখিন হন। হযরত আলী(রাঃ) ঘোষণা করেন যে, তাঁর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রাষ্ট্রে শান্তি- শৃংখলা পুনঃস্থাপন করা এবং কেবল তারপরই তিনি হযরত উসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখিন করতে পারবেন। কিন্তু হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ), হযরত আলী(রাঃ) এর এই সিদ্ধান্তে রাজী হননি; তারা সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করা শুরু করেন। হযরত আয়েশা (রাঃ), যিনি প্রকৃত অবস্থা অবগত ছিলেন না, তিনিও হযরত উসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ) এর সাথে যোগ দেন।
তিনজনে মিলে বসরার উদ্দেশ্যে এক সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। হযরত আলী (রাঃ) যুদ্ধ এবং রক্তপাত এড়াতে যারপরনাই চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, তাঁর এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) এর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়, যদিও, হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবায়ের (রাঃ) যুদ্ধের পূর্বেই সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং অন্য কোন শত্রুর দ্বারা নিহত হন। হযরত আয়েশার (রাঃ) সৈন্যরা পরাজিত হয় কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং তাঁর নিরাপত্তার খেয়াল রাখেন।
তিনি তাঁর ভাই মোহাম্মদ বিন আবু বকর (রাঃ) এর রক্ষাবেষ্টনীতে তাঁকে মদীনায় প্রেরণ করেন। এটি ‘উটের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত; কারণ হযরত আয়েশা(রাঃ) যুদ্ধের সময় উটের উপর সওয়ারী ছিলেন। পরবর্তীতে, হযরত আয়েশা (রাঃ) জীবনভর হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অনুতপ্তা ছিলেন। উটের যুদ্ধের পর হযরত আলী (রাঃ), হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কে, যিনি তখনও তাঁর হাতে বয়’আত গ্রহণ করেননি, ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর নিকট আত্বসমর্পণ করার আহŸান জানান।
কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এই অজুহাতে তাঁর নিকট নিজেকে সমর্পণ করেনি যে, হযরত উসমান(রাঃ) যিনি উমাইয়া বংশোদ্ভূত ছিলেন, তার রক্তের প্রতিশোধ প্রথমে নিতে হবে। এই বিপর্যস্ত পরাজয়ের পর খারেজীরা হযরত আলী (রাঃ), হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এবং আমর বিন আস (রাঃ) কে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরবর্তী দু’জন হত্যা প্রচেষ্টা হতে বেঁচে যেতে সক্ষম হলেও হযরত আলী (রাঃ) ফযরের নামাজের জন্য মসজিদে যাবার সময় আক্রমণকারীর দ্বারা গুরুতর আহত হন। দু’দিন পর এই অমিত সাহসী এবং ধর্মপ্রাণ খলীফা ৪০ হিজরীর ২০ রমযানে পরলোক গমন করেন। নিঃসন্দেহে, হযরত আলী (রাঃ) খেলাফতের পবিত্রতা এবং মর্যাদা রক্ষার খাতিরে তাঁর জীবন কুরবান করেন।
তিনিও সেই দশজন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সাঃ) যাঁদের বেহেস্তের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। কারবালার বিজয়ী নায়ক ইবনে জিয়াদের কবর কোথায় কেউ জানেনা। সাড়ে ১৪ শত বছর আগ থেকে এখনো পর্যন্ত এজিদ নামটি কেউ রাখেনি।