ঈমান অনেক বড় সম্পদ। কিন্তু বর্তমান এই ফেতনা ফ্যাসাদের যমানায় এই ঈমান ঠিক রাখা অনেক বেশী কঠিন। প্রতিনিয়ত গুনাহের সাগরে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার অন্যতম উপায় হল নিজের ঈমান বৃদ্ধি করা। আবার এই ঈমান বৃদ্ধি করতে হলে অনুসরণ করতে হবে বেশ কিছু কাজ।
ঈমান বৃদ্ধির উপায় অনেক রয়েছে। তবে এই লেখায় আমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করবো, যা ঈমান বৃদ্ধি এবং মজবুত করতে সহায়তা করবে। এসব উপায় গুলো দৈনন্দিন অভ্যাসের সাথে যুক্ত। আর সবগুলো কাজ ইসলামের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সব কথার অন্যতম একটি কথা হলো ঈমান মজবুত রাখার জন্য সবসময় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাতে হবে।
প্রথম উপায়ঃ আল্লাহর সমস্ত নাম ও গুণাবলীসহ আল্লাহ তাআ’লার পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। আল্লাহ তাআ’লা এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই বৃদ্ধি পাবে, নিঃসন্দেহে তার ঈমানও তত বৃদ্ধি পাবে। এ জন্যই যে সমস্ত আলেম আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তারা এ সম্পর্কে জ্ঞানহীন আলেমদের চেয়ে ঈমানের দিক থেকে অধিক শক্তিশালী।
দ্বিতীয় উপায়ঃ সৃষ্টির ভিতরে আল্লাহর নিদর্শন সমূহ সম্পর্কে গবেষণা করা এবং আল্লাহ মানব জাতিকে যে জীবন বিধান দিয়েছেন, তার ভিতরে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে যতই চিন্তা করবে, ততই তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ وَفِي أَنفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ
“বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে নিদর্শনাবলী রয়েছে। এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও, তোমরা কি অনুধাবন করবে না?” (সূরা যারিয়াতঃ ২০) আল্লাহর সৃষ্টিরাজির মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করলে যে ঈমান বৃদ্ধি পায়, এ মর্মে অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে।
তৃতীয় উপায়ঃ বেশী বেশী সৎ কাজ সম্পাদন করা। সৎ আমল যতই বৃদ্ধি পাবে, ঈমান ততই বৃদ্ধি পাবে। এই সৎ আমল মুখের কথার মাধ্যমে হোক, কিংবা কাজের মাধ্যমে হোক যেমন যিক্র-আযকার, নামায, রোযা এবং হজ্জ। এসব কিছুই ঈমান বৃদ্ধির মাধ্যম।
ঈমান কমে যাওয়ার কারণ সমূহঃ
প্রথম কারণঃ আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা ঈমান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কেননা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই কমবে, ঈমানও তত কমতে থাকবে।
দ্বিতীয় কারণঃ সৃষ্টিতে ও শরীয়তে আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে গবেষণা করা থেকে বিরত থাকা। কেননা আল্লাহর সৃষ্টিতে চিন্তা-ভাবনা না করা ঈমানের ঘাটতি হওয়ার অন্যতম কারণ।
তৃতীয় কারণঃ গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া। কেননা গুনাহের কাজ করলে অন্তরে এবং ঈমানের উপর বিরাট প্রভাব পড়ে। এই জন্যই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَا يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ
“ব্যভিচারী ঈমান থাকা অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না।”
চতুর্থ কারণঃ সৎ আমল না করা ঈমান হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু যদি বিনা কারণে কোন ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে ঈমান কমার সাথে সাথে সে শাস্তির সম্মুখীন হবে। অবশ্য গ্রহণযোগ্য কারণে ওয়াজিব ছেড়ে দিলে অথবা ওয়াজিব নয় এমন কাজ ছেড়ে দিলে ঈমানের ঘাটতি হবে, কিন্তু শাস্তির সম্মুখীন হবে না। এই জন্যই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলাদেরকে জ্ঞান ও দ্বীনের ক্ষেত্রে অপূর্ণ বলেছেন। এর কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তাদের যখন মাসিকের রক্ত বের হয়, তখন তারা নামায-রোযা থেকে বিরত থাকে। অথচ মাসিক অবস্থায় নামায-রোযা থেকে বিরত থাকার কারণে তাদেরকে দোষারূপ করা হয় না। বরং তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেহেতু পুরুষদের তুলনায় তাদের আমল কম হয়ে গেল, সে হিসাবে তারা পুরুষেরে চেয়ে কম ঈমানের অধিকারী।
দুর্বল ঈমানের লক্ষণ:
গুনাহ করার পর কোন অপরাধ বোধ কাজ করবে না।
অন্তর কঠিন হয়ে যাবে ফলে কুরআন তিলাওয়াত করতে ইচ্ছা করবে না।
ইবাদত করার ক্ষেত্রে অলসতা কাজ করবে।
সুন্নত পালনে অবহেলা।
অধিকাংশ সময় মন ও মেজাজ খারাপ এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত থাকবে।
কুরআন তিলাওয়াত কিংবা আল্লাহর কথা শুনার পর কোন অনুভূতি আসবে না। যেমন আখিরাত তথা জাহান্নামের ভয়ের কথা শোনার পর চোখে পানি আসবে না।
আল্লাহর নাম স্মরণ তথা জিকির করাকে কঠিন কাজ বলে মনে হবে।
শরীয়ত বিরোধী কাজ করার পরে খারাপ অনুভব হবে না।
সবসময় দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ আর সম্মানের ইচ্ছা হবে।
নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।
অন্যের ইসলাম পালনকে অবজ্ঞা এবং তিরস্কার করা।
১. নিজের গুনাহের জন্য অনুশোচনা করা
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন,
আর তোমরা নিজেদের পালনকর্তার সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অনন্তর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর। তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন এবং অধিক আমল কারীকে বেশী করে দেবেন আর যদি তোমরা বিমুখ হতে থাক, তবে আমি তোমাদের উপর এক মহা দিবসের আযাবের আশঙ্কা করছি।
– সূরা হুদ : ৩
মানুষ হিসেবে যেকোন সময় গুনাহ হয়ে যেতে পারে তবে এজন্য হতাশ হওয়া যাবে না বরং এই গুনাহের জন্য তওবা এবং অনুশোচনা করতে হবে। তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই ক্ষমা করবেন। তবে কিছু শর্তের উপর নির্ভর করে আপনার তওবা কুবল হওয়া কিংবা না হওয়া। যথা:
প্রথমত: গুনাহ পরিত্যাগ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত: যে গুনাহ করা হয়ে গেছে তার জন্য অনুশোচনা করতে হবে।
তৃতীয়ত: একই গুনাহ যেন পুনরাবৃত্তি না হয় এজন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।
চতুর্থত: যদি কোন ব্যক্তির ক্ষতি বা অধিকার হরণ করা হয় তবে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
একজন মুসলমান যখন তার গুনাহের জন্য তওবা করবে স্বাভাবিক ভাবে সে সর্বদা নেক আমলের জন্য উৎসাহী হবে আর নেক আমল তার ঈমানকে বৃদ্ধি করবে।
২. সময়মত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা
নামাজ মানুষকে সকল পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এছাড়া ঈমান বৃদ্ধির জন্য নামাজের উত্তম বিকল্প আর কিছু নেই। রাসূল সাঃ এর হাদিস মোতাবেক প্রবাহমান নদীতে নিয়মিত ৫ বার গোসল করলে যেমন শরীরে কোন ময়লা থাকে না তেমনি নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে কোন গুনাহ থাকে না। পূর্বে বলা হয়েছে গুনাহ না করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়।
তবে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় অনুসরণ করতে হবে যথা:
খুশু খুজু তথা আল্লাহর ধ্যান খেয়াল অন্তরে রেখে নামাজ আদায় করতে হবে।
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করতে হবে।
নামাযের সূরা কিরাত সহীহ শুদ্ধ ভাবে আদায় করতে হবে।
সর্বোপরি নামাজের সকল হুকুম আহকাম নিয়ম মাফিক আদায় করতে হবে।
৩. নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত
কুরাআন হলো মানুষের আত্মার খোরাক, অন্তরের আলো এবং সরল পথের দিশারী। যখনই আপনি আপনার অন্তরের শক্তি হারিয়ে ফেলবেন, ঈমানের ঘাটতি অনুভব করবেন তখনই কুরআনের দিকে ফিরে আসুন আসল শান্তির খোঁজ পাবেন। কুরআন ব্যাখ্যা দিয়েছে কিভাবে আপনি আপনার ঈমানের রিচার্জ করবেন। আল্লাহ তায়লা বলেন,
আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এ সূরা তোমাদের মধ্যেকার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করলো? অতএব যারা ঈমানদার, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে।
– সূরা তওবাহ: ১২৪
৪. স্বেচ্ছায় রোযা রাখার অভ্যাস করুন
রোযা তাকওয়া অর্জনের অন্যতম উপায়। কেননা রোযা খুব কম মানুষ, লোক দেখানোর জন্য রাখে। আত্মার পরিশুদ্ধতার জন্যে রোযা রাখা জরুরি। রোযা রাখার দ্বারা শয়তানের চক্রান্ত আর খারাপ ইচ্ছা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হয়। এছাড়া রোযা রাখার দ্বারা আল্লাহর সাথে আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়।
রোযা রাখার দ্বারা যেহেতু আল্লাহর সাথে আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয় এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকা যায় তাই রোযা ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক।
৫. সর্বদা আল্লাহর জিকির করা
জিকির বলতে মূলত সর্বদা আল্লাহর কথা অন্তরে স্মরণ রাখা বোঝায়। এখন সেটা হতে পারে সুবহানাল্লাহ কিংবা আলহামদুলিল্লাহ বলার দ্বারাও। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।
– সূরা আর রা’দ: ২৮
জিকির করার দ্বারা আপনার অন্তরে সর্বদা আল্লাহর নাম জপতে থাকবে আর যার অন্তরে আল্লাহর নাম থাকবে তার ঈমান বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
এছাড়া দৈনিক আপনি নিচের জিকির গুলো করতে পারেন,
সুবহানাল্লাহ – প্রতিদিন ১০০ বার।
সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী – প্রতিদিন ১০০ বার।
আলহামদুলিল্লাহ
আল্লাহু আকবার
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
সুবহানআল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর
সকাল-বিকাল দুরুদ পাঠ
৬. সর্বদা মৃত্যুর কথা স্মরণ
প্রত্যেক মানুষ মৃত্যুর স্বাদ নিবে। এক্ষেত্রে কে ধনী বা কে গরিব, কে বৃদ্ধ বা কে তরুণ এসব বিবেচনা করা হবে না প্রত্যেকেই মৃত্যুবরণ করবে। যখন আমরা নিয়মিত এই মৃত্যুর কথা স্মরণ করবো তখন আমাদের অন্তর সর্বদা নেক আমল করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। জান্নাত লাভের আকাঙ্ক্ষা আমাদের অন্তরে আসবে। আর সর্বদা মৃত্যুর কথা স্মরণ করার দ্বারা আমাদের ঈমানও বৃদ্ধি পাবে।
৭. আলেমের সহবত এবং ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা
আলেমের সাথে সম্পর্ক, তাদের সাথে ইসলামী আলোচনা এবং ইসলামী জ্ঞান অর্জনের দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেন,
যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।
– সূরা যুমার: ৯
৮. আল্লাহর নিকট দোয়া করা
রাসূল সাঃ বলেছেন, দোয়া হলো মুমিনের হাতিয়ার। ঈমান হ্রাস পেয়েছে এরূপ ঘটলে যেমন আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে তেমনি সর্ব অবস্থায় আল্লাহর নিকট দোয়া করতে হবে। বেশ কিছু সময় দোয়া কবুল হয় যথা:
যখন আপনি মজলুম থাকবেন।
আযান এবং ইকামতের মধ্যবর্তী সময়।
আযানের সময়।
অসুস্থতার সময়।
তাহাজ্জুদ নামাজের সময়।
রমজান মাসে বিশেষভাবে শবে কদরের রাত্রে।
মুসাফির অবস্থায়।
সিজদাহরত অবস্থায়।
শুক্রবার আসর নামাজের পর।
সন্তানের জন্য পিতা-মাতার।