ৃথিবীর শেষ সময়ে কিয়ামতের পূর্বে মিথ্যুক দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। দাজ্জালের আগমন কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সবচেয়ে বড় আলামত। মানব জাতির জন্য দাজ্জালের ফেতনা সবচেয়ে বড় ও ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে সে সময় যে সব মুমিন জীবিত থাকবে তাদের জন্য ঈমান নিয়ে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। সব নবী ও রাসুল তাদের উম্মতকে দাজ্জালের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
দাজ্জালের পরিচয়
দাজ্জালের পুরো নাম ‘মাসিহুদ দাজ্জাল’। মাসিহ অর্থ স্পর্শকারী। সে হাতের স্পর্শে অনেক অলৌকিক বিষয়ের প্রকাশ ঘটাবে। আর দাজ্জাল অর্থ অন্ধকার সৃষ্টিকারী, সত্যকে আচ্ছাদনকারী, সে সত্যকে আচ্ছাদিত করবে। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, দাজ্জালের এই নামকরণের কারণ হচ্ছে সে পৃথিবীতে ব্যাপক নৈরাজ্য ও ধ্বংসলীলা চালাবে।’ (ফাতহুল বারি : ৬/৪৭২)। তবে দাজ্জাল মানব বংশ থেকেই হবে। ‘সে হবে মানব বংশোদ্ভ‚ত একজন নিকৃষ্ট ব্যক্তি।’ (মুসলিম : ১৭৯)
শারীরিক অবয়ব ও আকৃতি
হজরত উবাদা ইবনে সামেত (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জেনে রাখ, দাজ্জাল উচ্চতায় একটু খাটো হবে। দুই পা থাকবে বাঁকা। মাথার চুল হবে কোঁকড়ানো। এক চোখ অন্ধ থাকবে। তবে অন্য চোখ সুন্দর হবে। কোটরে গেড়ে যাওয়া বা ওপরের দিকে উত্থিত না।’ (আবু দাউদ : ৪৩২০)। আরেকটি হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘দাজ্জাল হবে বৃহদাকার একজন যুবক পুরুষ, শরীরের রঙ হবে লাল, বেঁটে, মাথার চুল হবে কোঁকড়া, কপাল হবে উঁচু, বক্ষ হবে প্রশস্ত, চক্ষু হবে টেরা এবং আঙুর ফলের মতো উঁচু।’ (বুখারি : ১৭১)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের দাজ্জাল সম্পর্কে সংবাদ দেব, যা নুহ (আ.) থেকে সব নবীই তার উম্মতকে বলেছেন? শোনো, দাজ্জাল হবে কানা ও অন্ধ। তার সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নাম নামে দুটো ভেল্কি থাকবে। যাকে সে জান্নাত বলবে, সেটা মূলত জাহান্নাম। আর যাকে সে জাহান্নাম বলবে, সেটা মূলত জান্নাত।’ (মুসলিম : ২৯৩৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘দাজ্জালের সঙ্গে যা থাকবে তা আমি অবগত আছি। তার সঙ্গে দুটি নদী প্রবাহিত থাকবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটিতে সুন্দর পরিষ্কার পানি দেখা যাবে। অন্যটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যাবে। যার সঙ্গে দাজ্জালের সাক্ষাৎ হবে সে যেন দাজ্জালের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে পান করে। কারণ, তা সুমিষ্ট পানি। তার চোখের ওপরে মোটা আবরণ থাকবে। কপালে কাফের লেখা থাকবে। মূর্খ ও শিক্ষিত সব ঈমানদার লোকই তা পড়তে সক্ষম হবে।
(বুখারি : ৬৫৯৮)
মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করার ক্ষমতা
দাজ্জাল তার কর্মকান্ডে শয়তানের সহযোগিতা নেবে। শয়তান শুধু মিথ্যা ও গোমরাহী এবং কুফরী কাজেই সাহায্য করে থাকে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দাজ্জাল মানুষের কাছে গিয়ে বলবে, আমি যদি তোমার মৃত পিতা-মাতাকে জীবিত করে দেখাই তাহলে কি তুমি আমাকে প্রভু হিসেবে মানবে? সে বলবে অবশ্যই মানব। এ সুযোগে শয়তান তার পিতা-মাতার আকৃতি ধরে সন্তানকে বলবে, হে সন্তান! তুমি তার অনুসরণ কর। সে তোমার প্রতিপালক।’ (সহিহুল জামেউস সগির : ৭৭৫২)
দ্রুত ভ্রমণ করার ক্ষমতা
খুব অল্প সময়ে সে পুরো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণ করবে এবং নানা জনপদে মানুষকে তার বশ্যতা স্বীকার করতে প্রলুব্ধ করবে। হাদিসে এসেছে, হজরত নাওয়াস বিন সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলকে (সা.) দাজ্জালের চলার গতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ‘দ্রুতগামী বাতাস বৃষ্টিকে যেভাবে চালিয়ে নেয় দাজ্জালের চলার গতিও সে রকম হবে।’ (মুসলিম : ২৯৩৭; তিরমিজি : ২২৪০)
দাজ্জাল বের হওয়ার স্থান
দাজ্জাল বের হওয়ার স্থান সম্পর্কে রাসুল (সা.) বর্ণনা দিয়েছেন। সে পূর্বের পারস্যের দিক থেকে বের হবে। সে স্থানটির নাম হবে খোরাসান। সেখান থেকে বের হয়ে সমগ্র দুনিয়া ভ্রমণ করবে। তবে মক্কা-মদিনায় প্রবেশ করতে পারবে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পূর্ব দিকের একটি ভূখন্ড থেকে আত্মপ্রকাশ ঘটবে। সে স্থানের নাম খোরাসান।’ (তিরমিজি : ২২৩৭; ইবনে মাজা : ৪০৭২)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, ‘দাজ্জাল মধ্যবয়সি একজন যুবক হবে। সে শাম (সিরিয়া) ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থান থেকে আবির্ভুত হবে।’ (মুসলিম : ২৯৩৭)। বর্তমান মানচিত্রে দেখা যায়, ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী কিছু অঞ্চল খোরাসানের অন্তর্ভুক্ত।
মক্কা ও মদিনায় প্রবেশ করতে না পারা
দাজ্জালের জন্য মক্কা ও মদিনায় প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। মক্কা-মদিনা ছাড়া পৃথিবীর সব ভূখন্ডেই সে প্রবেশ করবে। ফাতেমা বিনতে কায়েস (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে রয়েছে, ‘অতঃপর দাজ্জাল বলল আমি হলাম দাজ্জাল। অচিরেই আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। আমি বের হয়ে চল্লিশ দিনের ভেতরে পৃথিবীর সব দেশ ভ্রমণ করব। তবে মক্কা-মদিনায় প্রবেশ করা আমার জন্য নিষিদ্ধ থাকবে। যখনই আমি মক্কা বা মদিনায় প্রবেশ করতে চাইব তখনই কোষমুক্ত তলোয়ার হাতে নিয়ে ফেরেশতাগণ আমাকে তাড়া করবে। মক্কা-মদিনার প্রতিটি প্রবেশ পথে ফেরেশতাগণ পাহারা দেবে।’ (মুসলিম)। হজরত আবু বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মদিনার ভেতর দাজ্জাল ভয়েও প্রবেশ করবে না। সে সময় মদিনার সাতটি দরজা থাকবে। প্রতিটি দরজায় দুজন করে ফেরেশতা পাহারায় নিয়োজিত থাকবেন।’ (বুখারি : ৭১২৫-২৬)
পৃথিবীতে অবস্থান ও বিচরণ
সাহাবিরা রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, দাজ্জাল পৃথিবীতে কত দিন অবস্থান করবে? উত্তরে নবীজি বললেন সে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। প্রথম দিনটি হবে এক বছরের মতো দীর্ঘ। দ্বিতীয় দিনটি হবে এক মাসের মতো দীর্ঘ। তৃতীয় দিনটি হবে এক সপ্তাহের মতো দীর্ঘ। আর বাকি দিনগুলো দুনিয়ার স্বাভাবিক দিনের মতোই হবে। আমরা বললাম যে দিনটি এক বছরের মতো দীর্ঘ হবে সে দিন কি এক দিনের নামাজই যথেষ্ট হবে? উত্তরে তিনি বললেন না; বরং তোমরা অনুমান করে সময় নির্ধারণ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে।’ (মুসলিম : ২৯৪০)
ভয়ঙ্কর ফেতনা বিস্তার
পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির জন্য দাজ্জালের চেয়ে বড় ফেতনা আর নেই। সে এমন অলৌকিক বিষয় দেখাবে যা দেখে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়বে। দাজ্জাল নিজেকে প্রভু ও আল্লাহ হিসেবে দাবি করবে। তার দাবির পক্ষে এমন কিছু প্রমাণও উপস্থাপন করবে যে সম্পর্কে নবী (সা.) আগেই সতর্ক করেছেন। মুমিন বান্দাগণ এগুলো দেখে মিথ্যুক দাজ্জালকে সহজেই চিনতে পারবে এবং আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু দুর্বল ঈমানদার লোকেরা বিভ্রান্তিতে পড়ে ঈমান হারা হবে। দাজ্জাল নিজেকে রাব্ব বা প্রভু হিসেবেও দাবি করবে। ঈমানদারের কাছে এ দাবিটি সুস্পষ্ট দিবালোকের মতো মিথ্যা বলে প্রকাশিত হবে। দাজ্জাল তার দাবির পক্ষে যত বড় অলৌকিক ঘটনাই পেশ করুক না কেন মুমিন ব্যক্তির কাছে এটি সুস্পষ্ট হবে যে সে একজন অক্ষম মানুষ, পানাহার করে, নিদ্রা যায়, পেশাব-পায়খানা করে। সর্বোপরি সে হবে অন্ধ। যার ভেতরে মানবীয় সব দোষ-গুণ বিদ্যমান সে কীভাবে রাব্ব ও আল্লাহ হতে পারে! একজন সত্যিকার মুমিনের মুমিনের বিশ্বাস হলো মহান আল্লাহ সর্বপ্রকার মানবীয় দোষ-ত্রুটি হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। কোনো সৃষ্টজীবই তার মতো নয়। আল্লাহকে দুনিয়ার জগতে কোনো মানুষের পক্ষে দেখাও সম্ভব নয়।
দাজ্জালের শেষ পরিণতি
মক্কা-মদিনা ছাড়া পৃথিবীর সব দেশেই সে ভ্রমণ করবে। তার অনুসারীর সংখ্যা হবে প্রচুর। সমগ্র দুনিয়ায় তার ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে। সামান্য সংখ্যক মুমিনই তার ফেতনা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারবে। ঠিক সে সময় দামেস্ক শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এক মসজিদের সাদা মিনারের ওপর ঈসা (আ.) আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। মুসলমানগণ তার পাশ্বে একত্রিত হবে। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দাজ্জালের দিকে রওনা দেবেন। দাজ্জাল সে সময় বায়তুল মাকদিসের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। অতঃপর ঈসা (আ.) ফিলিস্তিনের লুদ শহরের গেটে দাজ্জালকে পাকড়াও করবেন। ঈসাকে (আ.) দেখে সে পানিতে লবণ গলার মতো গলতে শুরু করবে। ঈসা (আ.) তাকে লক্ষ করে বলবেন, তোমাকে আমি একটি আঘাত করব যা থেকে তুমি কখনও রেহাই পাবে না। ঈসা (আ.) তাকে বর্শা দিয়ে আঘাত করবেন এবং বর্শার ফলায় দাজ্জালের রক্ত দেখাবেন। (মুসলিম : ২৯৩৭; আবু দাউদ : ২/২৩৭; ইবনে মাজা : ৩০৬)