ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বলতে বোঝানো হয় বিভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব ও আচরণ। সমাজে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য বা অশান্তি সৃষ্টি না করে, একে অপরের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অনুশীলনকে সম্মান করা। ইসলাম একটি বিশ্বজনীন ধর্ম, যা শান্তি, সহিষ্ণুতা এবং মানবিক মর্যাদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ, যা ইসলামের মূলনীতি এবং শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
ইসলামের মূল শিক্ষা: সহিষ্ণুতা এবং শান্তি
ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং এটি শিখায় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে সমস্ত মানবজাতির প্রতি তাঁর বার্তা পৌঁছানো হয়েছে। ইসলাম কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সকল মানুষ ও জাতির জন্য একটি সাধারণ এবং সার্বজনীন ধর্ম। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:
“তোমরা কেউ কাউকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে চেয়ো না, বরং একে অপরকে সাহায্য করো। আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালক।”
(সূরা আল-মায়িদা, ৫:২)
এই আয়াতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, ইসলাম ধর্মের অনুশীলন ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি সম্মান বজায় রাখা উচিত। একে অপরকে সহায়তা এবং দয়া প্রদর্শন করাই ইসলামের মূল উদ্দেশ্য।
নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবন থেকে শিক্ষা
নবী মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন এক উজ্জ্বল আদর্শ, যিনি তাঁর জীবনে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সহানুভূতির অত্যন্ত বড় উদাহরণ তৈরি করেছেন। মক্কায় ইসলামের প্রচারের শুরুতে, মুসলিমদের উপর অগণিত নিপীড়ন ও অত্যাচার করা হয়েছিল। তবে, নবী (সঃ) কখনোই প্রতিশোধ বা শত্রুদের প্রতি ঘৃণা দেখাননি। বরং তিনি তাঁদেরকে সঠিক পথে আসার জন্য দাওয়াত দিয়েছেন এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন।
একটি বিখ্যাত ঘটনা হল, যখন মক্কায় কুরাইশদের নেতারা নবী (সঃ) এর সামনে মুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতা প্রস্তাব দেয়। নবী (সঃ) তাদের প্রতি তাঁর দয়ার প্রমাণ রেখে বলেছিলেন যে, ইসলাম কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সবার জন্য। তিনি সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন এবং শত্রুদের প্রতি সহিষ্ণু মনোভাব অবলম্বন করেছেন।
ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা
ইসলাম অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব পালন করতে উৎসাহিত করে। কুরআনে বলা হয়েছে:
“ধর্ম সম্পর্কে তাদের (অন্য ধর্মের অনুসারীদের) সঙ্গে ন্যায়পরায়ণ আলোচনা করো।”
(সূরা আল-আঙ্কাবুত, ২৯:৪۶)
এটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, ইসলামে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, আমরা যদি সঠিকভাবে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা না জানাই, তাহলে আমরা ইসলামের মূল শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করছি না।
এছাড়াও, ইসলামের শত্রুদের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের একটি পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত রয়েছে নবী (সঃ) এর জীবনে। যখন মদিনায় মদীনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তখন ইসলামের প্রতিষ্ঠা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে অন্যান্য ধর্মের সম্প্রদায়, যেমন ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সাথেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটি প্রমাণ করে যে, ইসলাম কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, বরং পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মের মানুষের জন্য শান্তি ও সহিষ্ণুতা চায়।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং মানবাধিকার
ইসলাম ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সাথে যুক্ত করেছে। কুরআন এবং হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষের প্রতি সৎ ও ন্যায্য আচরণ করার জন্য মুসলিমদের উৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:
“তোমরা (মুসলিমরা) মানুষের প্রতি এমনভাবে আচরণ করো যেন তাদের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তৈরি হয়।”
(সূরা আল-জুমার, ৩৯:১০)
এখানে ইসলামের মূল শিক্ষা হলো, ইসলাম মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং শান্তির পক্ষে। মুসলিমরা কোনো ধর্মের মানুষের প্রতি অত্যাচার বা বৈষম্য দেখলে তা ইসলামের আদর্শের বিরোধী। ইসলাম সমস্ত মানুষকে সমান মর্যাদা দেয় এবং সবার ধর্মীয় অধিকারকে সম্মানিত করার প্রতি গুরুত্ব দেয়।
উপসংহার
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ইসলামের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলামের শিক্ষায় আমরা দেখি, যে জাতি বা ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, তাদের প্রতি সহানুভূতি, শ্রদ্ধা এবং ন্যায্য আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ইসলাম মানুষকে প্রতিটি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে, সহানুভূতিশীল হতে এবং পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বসবাস করতে উৎসাহিত করে। আজকের পৃথিবীতে, যেখানে ধর্মীয় সহিংসতা এবং বৈষম্যের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ইসলামের এই শিক্ষা আমাদের সমাজে শান্তি এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করতে পারে।
এটি আমাদের সকলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, যে আমরা যদি একে অপরের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই, তবে আমাদের সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।