নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় রুকন এবং দৈনিক পাঁচবারের ফরজ ইবাদত। এটি মুসলমানদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ত্যাগ, এবং আত্মশুদ্ধির প্রকাশ। নামাজ পড়ার সঠিক নিয়ম এবং পদ্ধতি শিখে সঠিকভাবে নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। নামাজের সঠিক পদ্ধতি জানা এবং তা নিয়মিত পালন করা আল্লাহর কাছ থেকে রহমত ও মাগফিরাত লাভের একটি মাধ্যম।
এখানে নামাজ পড়ার নিয়ম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, ছবি সহ এক নজরে তুলে ধরা হলো:
১. নামাজের জন্য প্রস্তুতি
নামাজ আদায় করার আগে কয়েকটি প্রস্তুতি প্রয়োজন:
- বিশুদ্ধতা: নামাজের আগে ওযু (অবশ্যিক গোসল) করা জরুরি। যদি কেউ উযু না করে নামাজ শুরু করে, তাহলে তার নামাজ বাতিল হয়ে যাবে।
- কিবলা নির্ধারণ: নামাজের সময় মক্কায় অবস্থিত কাবা শরীফের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে হয়, যা কিবলা হিসাবে পরিচিত।
- পবিত্র স্থান: নামাজ আদায় করার জন্য কোনো পরিষ্কার এবং পবিত্র স্থান নির্বাচন করা উচিত।
২. নামাজ শুরু করা: তাকবির ও তাকবির-তাহরিমা
নামাজের প্রথমে তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলতে হয়। এটি হল নামাজ শুরু করার জন্য উচ্চস্বরে বলা একটি শব্দ। আপনি দাঁড়িয়ে পড়লে, প্রথমে দুই হাত উঁচু করে আল্লাহু আকবার বলুন, এবং এরপর হাত বুকের কাছ দিয়ে বেঁধে ফেলুন। এর মাধ্যমে নামাজ শুরু হয়।
৩. সুরাহ ফাতিহা ও সুরাহ পড়া
নামাজের প্রথম রাকআতে সুরাহ আল-ফাতিহা (فاتحة) পড়তে হয়। এটি পড়ার পর, আপনি একটি ছোট সুরাহ বা আয়াত পড়েন। যেমন, সুরাহ ইখলাস, সুরাহ আল-ফিল, সুরাহ কওসার ইত্যাদি।
সুরাহ ফাতিহা:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينَ
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّآلِّينَ
তারপর আপনি একে একে আল্লাহর প্রতি স্নেহ প্রকাশ করতে ছোট একটি সুরাহ পাঠ করবেন।
৪. রুকু (দণ্ডায়মান)
নামাজের প্রথম সুরাহ পড়া শেষ হলে, আপনি রুকু করতে যান। রুকু হল মাথা ও কোমর সমান্তরাল রেখে দণ্ডায়মান হয়ে যাওয়া। হাত দুইটি হাঁটুর উপর রেখে শরীরের উপরের অংশকে সোজা রেখে মাথা নিচে করে রুকুতে যান। রুকুতে তিনটি বার সুবহান রাব্বিয়াল আযিম (سبحان ربي العظيم) বলা প্রয়োজন।
৫. কায়াম (সোজা দাঁড়িয়ে থাকা)
রুকুর পর, আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সামি’আল্লাহু liman হামিদাহ বলুন। এরপর, দাঁড়িয়ে আপনার হাতে প্রার্থনা করুন।
৬. সিজদা (পাক মাটিতে মাথা ঠেকানো)
নামাজের পরবর্তী ধাপ হলো সিজদা, যেখানে আপনি মাটিতে সিজদা করবেন। এটি নামাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সিজদার সময় আপনার দুই হাত, দুই হাঁটু, দুই পা এবং মস্তক মাটির ওপর রাখবেন। সিজদায় গিয়ে সুবহান রাব্বিয়াল আ’লা (سبحان ربي الاعلى) তিনবার বলুন।
৭. দ্বিতীয় সিজদা ও দ্বিতীয় রাকআত
প্রথম সিজদা শেষে আপনি আবার সোজা হয়ে বসবেন এবং আবার দ্বিতীয় সিজদা করবেন। এরপর নামাজের দ্বিতীয় রাকআত শুরু হবে।
৮. তাশাহুদ (নামাজের মাঝামাঝি বসা)
নামাজের দ্বিতীয় রাকআত শেষে, আপনি তাশাহুদ অবস্থায় বসবেন। এখানে আপনি আত-তাহিয়্যাতু (تحيات) পড়বেন। তাশাহুদ শেষ হলে, যদি নামাজ শেষ না হয়ে থাকে, তাহলে তৃতীয় রাকআতে চলে যান।
তুর্থ রাকাতে চলে যাবেন, তখন আপনি পুনরায় তাশাহুদ পড়ে এবং তারপরে দুরুদে ইব্রাহিম এবং দোয়া মাসূরা পড়বেন। এবং পরিশেষে সালাম ফিরিয়ে নিবেন।
অর্থাৎ দুই কাধের থেকে দুইবার মুখ করে সালাম ফিরিয়ে নেবেন। প্রথমবার ডান কাঁধের দিকে সালাম ফিরানোর সময়, আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ পড়বেন, তারপরে দ্বিতীয় কাদের দিকে সালাম ফিরানোর সময় আবারো আসসালামু আলাইকুম রাহমাতুল্লাহ পড়বেন।
তাহলে সালাত আদায় করার কাজ শেষ হয়ে যাবে।
তাশাহুদ বাংলা উচ্চারণ সহ
তাশাহুদের অর্থ ও উচ্চারণ:
তাশাহহুদ : التَّحِيَّاتُ لِلَّهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ ، السَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ ، السَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
উচ্চারণ: আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস-সালাওয়াতু ওয়াত-ত্বায়্যিবাতু; আস-সালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ; আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিছ ছালিহীন; আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।
অর্থ : ‘সব মৌখিক ইবাদত আল্লাহর জন্য। হে নবি! আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও বরকত বর্ষিত হোক। শান্তি আমাদের ওপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ বা উপাস্য নাই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসুল।
দুরুদে ইব্রাহীম, বাংলা উচ্চারণ সহ
দরুদে ইব্রাহিমের আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ-
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدُ، اَللّهُمَّ بَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
উচ্চারণ:
আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউঅআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা স্বাল্লাইতা আলা ইবরা-হীমা অ আলা আ-লি ইবরা-হীম, ইন্নাকাহামীদুম মাজীদ। আল্লা-হুম্মা বা-রিক আলা মুহাম্মাদিঁউঅ আলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বা-রাকতা আলা ইবরা-হীমা অ আলা আ-লি ইবরা-হীম, ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।
অর্থ:
হে আল্লাহ! তুমি হজরত মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরের উপর রহমত বর্ষণ কর, যেমন তুমি হজরত ইব্রাহিম ও তাঁর বংশধরের উপর রহমত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত।
হে আল্লাহ! তুমি হজরত মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ কর, যেমন তুমি হজরত ইব্রাহিম ও তাঁর বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত। (বুখারী, মিশকাত)
দুয়া মাসুরা
আরবি :
اللهم إني ظلمت نفسي ظلما كثيرا ولا يغفر الذنوب إلا أنت فاغفرلي مغفرة من عندك وارحمني إنك أنت الغفور الرحيم
বাংলা উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসি জুলমান কাসিরা । ওয়ালা ইয়াগ ফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা। ফাগফির লি, মাগফিরাতাম মিন ইনদিকা; ওয়ার হামনি, ইন্নাকা আনতাল গাফুরুর রাহিম।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি নিজের উপর অনেক জুলুম করেছি। আর আপনি ছাড়া গুনাহ ক্ষমাকারী আর কেউ নেই। আপনি নিজ অনুগ্রহে আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি রহম করুন। নিঃসন্দেহে আপনিই ক্ষমাকারী, করুণাময়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৩৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭০৫)
নামাজ পড়ার নিয়ম সম্পর্কে যে তথ্যটি আপনাকে জানিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল, সেটি উপায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তবে আপনি যদি আরো ভালোভাবে নামাজ শিখতে চান, তাহলে আপনার আশেপাশে কোন একজন বিজ্ঞ আলেমের সহায়তা নিতে পারেন।
নামাজ একটি ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত যা মুসলমানদের আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার উপায়। সঠিকভাবে নামাজ পড়া জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নিয়মিত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা সম্ভব, এবং একটি পরিপূর্ণ ইসলামী জীবনযাপন গঠন করা যায়।
নামাজের প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে সুনির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ এবং পদ্ধতি রয়েছে, যা প্রতিটি মুসলিমের জন্য পালন করা আবশ্যক। নামাজ একটি অন্তর্নিহিত প্রশান্তির উৎস, যা শুধু দেহের জন্য নয়, বরং আত্মার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।