ইসলামি শরিয়ত নারীদের সম্মান-মর্যাদা এবং তাদের সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। তাই যে ক্ষেত্রে তাদের সম্মান-মর্যাদা বা সুরক্ষা বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সে ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়ত তাদের জন্য বিশেষ বিধান দিয়েছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামি শরিয়তের সাধারণ বিধান হচ্ছে— স্বামী বা মাহরাম ছাড়া একাকী সফর করা নারীদের জন্য বৈধ নয়।
যদি ৪৮ মাইল (৭৭ কিলোমিটার) বা তার বেশি দূরত্বে সফর হয়, তবে যতক্ষণ পর্যন্ত পুরুষদের থেকে নিজের কোনো মাহরাম আত্মীয় বা স্বামী সঙ্গে না থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো নারীর জন্য সফর করা জায়েজ নেই। তা হজের সফর হোক বা উচ্চশিক্ষার জন্য সফর হোক।
হাদিস শরিফে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণ সফর এবং হজের সফর— সবক্ষেত্রেই মাহরাম ছাড়া নারীদের একাকী সফর করতে নিষেধ করেছেন।
হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মাহরামকে সঙ্গে না নিয়ে কোনো নারী তিন দিন দূরত্বের পথে সফর করবে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস ১০৮৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৩৩৮)
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে নারী আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তার জন্য নিজের বাবা, ছেলে, স্বামী, ভাই বা অন্য কোনো মাহরামকে সঙ্গে না নিয়ে তিন দিন বা ততোধিক দূরত্বের পথ সফর করা বৈধ নয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৩৪০; সুনানে কুবরা, বাইহাকি ৩/১৩৮
এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মাহরাম ছাড়া হজের মতো সফরেও বের হওয়া যাবে না। আর এত সুস্পষ্ট হাদিস থাকার পর এখানে ভিন্ন কোনো যুক্তি দাঁড় করানো বাঞ্ছনীয় নয়।
এমনিভাবে বুখারি শরিফের এক বর্ণনায় এসেছে— হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, নবীজি বলেছেন, কোনো পুরুষ যেন কোনো নারীর সঙ্গে তার মাহরাম ব্যতিরেকে একাকী অবস্থান না করে। তখন এক ব্যক্তি উঠে বলল— ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি তো অমুক অমুক যুদ্ধের জন্য নাম লিখিয়েছি। ওদিকে আমার স্ত্রী হজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। নবীজি বললেন, ফিরে যাও। তোমার স্ত্রীর সঙ্গে হজ কর। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৫২৩৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৩৪১)
এসব বর্ণনায় একটু চিন্তা করলে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নারীর জন্য মাহরাম ব্যতীত ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার ওপর কতটা জোর দেওয়া হয়েছে যে, কোথাও আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ইমান আনা যেই রকম জোরের পর এ নিষেধাজ্ঞা আসে।
কোথাও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে স্বামীকে জিহাদের মতো পবিত্র দায়িত্বের পরিবর্তে স্ত্রীকে নিয়ে হজ করতে বলা হচ্ছে।
এ ছাড়া হজ ফরজ হওয়ার পরও মাহরাম ছাড়া কোনো নারীর জন্য তা আদায় করা ওয়াজিব নয়।
বরং তার জন্য হুকুম হলো— যদি মৃত্যু পর্যন্ত মাহরাম পাওয়া না যায়, তা হলে সে মৃত্যুর পূর্বে হজের অসিয়ত করে যাবে।
এখানে আরেকটি বিষয় হলো— ওমরাহ একজন ব্যক্তি ইবাদত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করে থাকে। কিন্তু মহানবীর (সা.) নির্দেশ অমান্য করে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশা করা নিরর্থক ও বোকামি।
তা ছাড়া ইসলামি শরিয়তে একজন নারীর সফরের জন্য মাহরামের শর্ত করা হয়েছে তার সম্মান ও সুরক্ষা জন্য এবং তাকে সন্দেহ, বদনাম ও অপবাদ থেকে রক্ষা করার জন্য, যা ছাড়া নারীর কোনো মূল্য নেই।
তাই নারীদের উচিত— শরিয়তের বিধিবিধান মেনে চলা এবং ইসলামি শরিয়তকে নিজের উপকারী হিসাবে বিবেচনা করা।
তাই নারীর জন্য মাহরাম ব্যতীত সফর করা জায়েজ নেই, তা হজ-ওমরাহর জন্যই হোক বা শিক্ষার জন্যই হোক এবং সে একা সফর করুক বা নারীদের কাফেলার সঙ্গে হোক, সে যুবতী হোক বা বৃদ্ধা। সাধারণভাবে নারীদের জন্য মাহরাম ছাড়া সফর করা জায়েজ নেই।
এর হেকমত হলো— সফরে স্বামী ও মাহরাম ব্যক্তি একজন নারীর যতটুকু সম্মান এবং সুরক্ষা করতে পারে, অন্য নারীরা তা রক্ষা করতে পারে না। বরং সেই নারীরা নিজেরাই তো তাদের সতীত্ব রক্ষার জন্য অন্যদের মুখাপেক্ষী।
আল্লাহ এবং রাসুল (সা.) আমাদের যে বিধান দিয়েছেন, আমরা তা মানতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা আছে কী নেই, বদনামের ভয় আছে কী নেই— এটি আমরা বিবেচনা করব না।
বিষয়টি এমন না যে নিরাপত্তার ভয় থাকলে মাহরাম ছাড়া সফর করা জায়েজ নেই। আর যদি নিরাপত্তা পরিপূর্ণ বজায় থাকে, বদনামের কোনো ভয় না থাকে, তা হলে মাহরাম ছাড়া সফর করা জায়েজ আছে। বিষয়টি কখনই এমন না।
তবে হ্যাঁ, যদি বেশি প্রয়োজন দেখা দেয়, যেমন বর্তমানে এমন হয় যে কোনো নারী হজের জন্য টাকা জমা দিয়েছে বা সব কিছু রেডি তখন হঠাৎ করে স্বামী মারা গেল বা যে মাহরামের সঙ্গে হজে যাবে, সে মারা গেল তখন অন্য নিরাপদ নারীদের সঙ্গে হজে যেতে পারবে। অন্যথায় তো তার এই টাকাটা বৃথা যাবে। যেহেতু এটি অকাট্য হুকুম না, তাই এ এ ধরনের জটিল ওজরের ক্ষেত্রে মাহরাম ছাড়াও হজে যেতে পারবে।
সূত্র: আলবাহরুর রায়েক ২/৩১৪-৩১৫; আদদুররুল মুখতার ২/৪৬৪-৪৬৫; মানাসিক, মোল্লা আলী কারী পৃ. ৭৬ ও ৭৮; গুনয়াতুন নাসিক পৃষ্ঠা ২৬-২৭ ও ২৯; ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১৫৬; বাদায়েস সানায়ে ২/১২৩