মুসলিম বিশ্বের জন্য এক মহিমান্বিত মাস রমজান। এই মাসকে ঘিরে তাই রয়েছে নানা অনুষ্ঠান আর রীতিরেওয়াজ। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবিহর নামাজ পড়া ইত্যাদি এসব কিছুর বাইরের আনন্দ-উৎসব করার মাধ্যমেও সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ।চলমান করোনা অতিমারিতে থমকে গেছে অনেক কিছুই। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোজার সময়কার নানা আনন্দানুষ্ঠানও। অথচ ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানের চেয়ে এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবেই বেশি জনপ্রিয়। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রমজান উদযাপনের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। তারই কিছু তথ্য দেওয়া যাক।
মেসেহারাতি ; মিসর
ইতিহাসজুড়েই আছে মিসরীয়দের জমকালো সব সৃষ্টির কথা। সভ্যতার আদিযুগ থেকেই শানদার এই জাতির রমজান পালনের রীতিও খুবই চমৎকার। যেমন জমকালো তাদের সব কৃষ্টি ও নিদর্শন, তেমনি রমজান উদযাপনও করে জমকালো সব বাতি জালিয়ে।অনেকটা ফানুস আকৃতির এসব বাতি তৈরি হয় ধাতু ও রঙিন কাচ দিয়ে। নিখুঁত এসব কারুকাজ মূলত শতবর্ষব্যাপী প্রচলিত মিসরীয় সংস্কৃতির অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্মকেই মনে করিয়ে দেয়।
পুরো রমজান মাসে রাস্তা, দোকান, বাড়ির ছাদ—সর্বত্র ছেয়ে যায় এই বাতির আলোয়। রমজান মাসের মহিমা যেন পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে আলো হয়ে। সবার মনে জেগে ওঠা ত্যাগের মহিমার বাস্তবিক প্রকাশ হয়ে ওঠে এই বাতি। এ ছাড়া সাহরিতে সবাইকে জাগিয়ে দেওয়ার চিরায়ত মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মিসরের রাস্তায় ‘মেসেহারাতি’ নামের একদল মানুষের দেখা মেলে। তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সবাইকে জাগিয়ে দেন সাহরির জন্য।
হক-আল-লায়লা ; সংযুক্ত আরব আমিরাত
রমজান শুরুর আগেই আমিরাতে রমজান উদযাপনের ধুম লেগে যায়। বেশ উল্লাসের সঙ্গে পালন করা হয় ‘হক-আল-লায়লা’। পবিত্র রমজান শুরুর আগেই ১৫ শাবান আসন্ন রমজানকে উদযাপন করতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এ অনুষ্ঠান অনেকটাই হ্যালুইনের ট্রিক অর ট্রিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হতে পারে। কারণ, এখানেও বাচ্চাদের হাতে দেওয়া হয় খেজুর ও চকলেট। তবে এ উৎসবের পেছনের উদ্দেশ্যটা একটু আলাদা। মূলত রমজানের মাহাত্ম্য ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে শিশুদের সামনে আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে তুলে ধরার প্রয়াসই হলো এই হাক-আল-লায়লা। বহু বছর ধরে পালিত হয়ে আসা এ উৎসব তাই এখন আমিরাতের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ঢোল পিটিয়ে সেহ্রিতে উঠানো ; তুর্কি
অটোম্যান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে আজ অবধি সেহ্রিতে ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জেগে ওঠার নিয়ম চলে আসছে তুর্কিতে। বিংশ শতাব্দীর এই সময়ে অ্যালার্ম ঘড়ি থাকা সত্বেও রমজান মাসে তুর্কির রাস্তায় ২০০০ এরও বেশি মানুষ ঢোল পিটিয়ে সেহ্রিতে জেগে ওঠার আহ্বান জানান। স্থানীয় সম্প্রদায়ের লোকজন মিলেই রমজান মাসে এই রীতিটি পালন করে থাকেন।
যারা ঢোল বাজান, তারা ঐতিহ্যবাহী অটোম্যান পোশাক পরে থাকেন। দাভুল (তুর্কির বিশেষ ধরনের ঢোল) বাজিয়ে সেহ্রিতে ডেকে তোলার জন্য তুর্কি নাগরিকরা তাদের বাহ্শিস (বকশিস) দিয়ে থাকেন এমনকি তাদের সাথে সেহ্রি খাওয়ার দাওয়াতও দেন। বর্তমানে তুর্কিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢোল পিটিয়ে সেহ্রিতে জেগে তোলা ব্যক্তিদের জন্য মেম্বারশিপ কার্ড দেওয়ার নিয়ম চালু হয়েছে যাতে করে তারা এই কাজের জন্য সম্মানিতবোধ করেন। এছাড়াও পুরনো এই ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মও যেন উদ্বুদ্ধ হয় সেজন্যই এই উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে।
রমা মুসলিমদের বাল্লাদ ; আলবেনিয়া
রমা মুসলিমরা হলেন রোমানি যারা হানাফি মাযহাব এর সুন্নি ইসলাম অবলম্বন করেন এবং ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেন। বহু শতাব্দী ধরে, অটোম্যান সাম্রাজ্যের সময় থেকে রমা মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা সেহ্রি এবং ইফতার শুরুর আগে ঐতিহ্যবাহী গান গেয়ে সবাইকে জানান দেন। রমজান মাসে প্রতিদিন তারা রাস্তায় রাস্তায় লোদ্রা (শেষের দুই দিকে ভেড়া ও ছাগলের চামড়া দিয়ে বানানো ঢোল) বাজান। মুসলিম পরিবারগুলো রমজান মাসে প্রায়ই ইফতার শুরুর আগে উদযাপন হিসেবে ঐতিহ্যবাহী বাল্লাদ আয়োজন করার জন্য তাদের ঘরে নিমন্ত্রণ দেন।
রঙিন ফানুসে রমজান উদযাপন ; মিশর
প্রতি বছর রমজান মাসে মিশরীয়রা এই পবিত্র মাসের ঐক্য এবং আনন্দের প্রতীক হিসেবে রঙ বেরঙের ফানুস দিয়ে পুরো শহর সাজায়। মিশরের নাগরিকদের কাছে এই ঐতিহ্যটি বেশ আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ। শত বছর পুরনো এই ফানুস ঝুলানোর ঐতিহ্য শুরু হয়েছিলো ৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। মিশরে খলিফা আল-মুয়িজ লি-দ্বীন-কে রমজানের প্রথম দিনে স্বাগতম জানাতে সেখানকার সৈন্যসদস্যরা স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে এক্তি করে মোমবাতি দিয়ে আলোকসজ্জার আয়োজন করেছিলেন। ফানুসগুলো যেন নিভে না যায় তাই কাঠের একটি ফ্রেমে মোমবাতি রাখা হয়েছিলো।
সেই আলোকসজ্জা খলিফার এতোই ভালো লেগেছিলো যে তিনি বাণিজ্যিকভাবে এই গড়নের আলোকসজ্জা তৈরি করে পুরো মিশরে এর প্রসার ঘটানোর নির্দেশ দেন। সেখান থেকেই ওই আলোকসজ্জার আদলে তৈরি হয় ফানুস। এছাড়াও তিনি বলেছিলেন মিশরের বাসিন্দারা যেন সকলে তাদের ঘরের সামন ফানুস ঝুলায়। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত ফানুস ঝুলানোর এই সংস্কৃতি রক্ষা করে আসছেন মিশরীয়রা।
ঘরে ঘরে রঙের ছোঁয়া, যোয়াকা ; মরক্কো
উত্তর আফ্রিকার সুনিপুণ কারিগরি খ্যাত দেশ মরক্কোতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে থেকেই রমজান মাস উদযাপনের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং পুরো বাড়ি নতুনভাবে রঙ করে তারা রমজান মাসকে স্বাগতম জানান। যোয়াকা, মরক্কোতে রমজান আগমনের খবর ও ইফতারের সময় জানান দেওয়ার একটি ঐতিহ্য।
উচ্চ শব্দে সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোষণা দেওয়া হয় যোয়াকার মাধ্যমে। রমজান মাসে খবর জানাতে সাতবার আর প্রতিদিন শহরের সীমান্ত থেকে সেনাবাহিনী কামান দিয়ে ইফাতেরর সময় জানানোর পর একবার যোয়াকা বাজানো হয়।
রমজান মাসে শিশুদের আয়োজন ; কারকিয়া’ন, কুয়েত
রমজান মাস, কুরআন নাযিলের এই মাসটি মুসলিম সম্প্রদায় আন্তরিক ভালোবাসায় এবং আধ্যাত্মিক মহিমায় পালন করে থাকে নানান ঐতিহ্যবাহী আয়োজন। কুয়েতে রমজানের মাঝামাঝি সময়ে শিশুদের নিয়ে তিন দিনব্যাপী আয়োজন করা হয় কারকিয়া’ন। এই আয়োজনের তারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নানান রকম গান গায়। ছেলে এবং মেয়ে শিশুদের গানগুলো আলাদা হয়ে থাকে। তবে যার জন্য গান গাচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে প্রত্যেকের গানে শব্দের কিছুটা ভিন্নতা থাকে। এই গানের জন্য শিশুদের উপহার হিসেবে চকলেট এবং মিষ্টি দেওয়া হয়। অনেকের মতে এই কারকিয়া’ন মূলত ফাতিমা (রাঃ) রমজান মাসের দুই সপ্তাহ মিষ্টি বিতরণ করতেন সেই বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই আয়োজন করাআ হয়।
সামাজিকতায় সংস্কৃতি রক্ষা ; কোমরোস
সমাজের সবাই আত্মিকভাবে, একতাবদ্ধভাবে থাকবে-এই শিক্ষাই উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির রমজান মাসে বছর পুরানো ঐতিহ্য। ফজরের আজান দেওয়ার ঠিক পরেই কোমরোসের মানুষজন একত্রিত হয় ‘বানগাওয়ি’ নামক একটি জায়গায়। এই জায়গাটিতে মূলত জনগনের সমাগম বেশি হয়ে থাকে।
এখানে সবাই একসাথে জড়ো হয়ে একসাথে মসজিদে যায়। সেখানে গিয়ে সবাই একত্রে বসে খেজুর ও কফি খায়। এরপর নামাজ শেষ হয়ে গেলে সবাই নিজেদের বাড়িতে চলে যায়।
পরিচ্ছন্নতায় পরিশুদ্ধি ; ইন্দোনেশিয়া
রমজান শুরুর আগের দিন পুরো ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকরা গোসল করার বেশ পুরনো ঐতিহ্য পালন করে থাকেন। রমজানের চাঁদ দেখার কাজ সেরে নেওয়ার ঠিক পরপরই ইন্দোনেশিয়ার বাসিন্দারা পরিষ্কার হয়ে গোসল করেন। কিছু কিছু জায়গায় এই নিয়মের হালকা হেরফের হলেও জাভা, অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব ও মধ্য দিকের অঞ্চলে এই গোসল করার নিয়মটি সাংস্কৃতিকভাবে মূল্যবোধের মতোই বিবেচনা করা হয়।
এই রীতিটি ‘পাদুসান’ নামে পরিচিত। এই নিয়মটি ওয়ালি সাঙ্গাদের সময় থেকে চলে আসছে যাকে মূলত পবিত্র রমজান মাসে শুরুর আগে শরীর, মন ও আত্মার পরিশুদ্ধির উপায় হিসেবে মানা হয়। আগে এই রীতিটি ঝর্নার পানিতে গোসল করা প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে সবাই নিজেদের বাসাতেই ‘পাদুসান’ এর নিয়ম পালন করে থাকেন।
কবিতার পসরা ; রাইভারু ; মালদ্বীপ
চারিদিকে দ্বীপ বিশিষ্ট এই দেশটিতে রমজান মাসে আয়োজন করা হয় বিশেষ ধরনের কবিতার আয়োজন যা ‘রাইভারু’ নামে পরিচিত। এই কবিতায় তাহকে রমজান মাস সম্পর্কিত নানান ধরনের তথ্য ও কথা। ব্যতিক্রমধর্মী সুরে আবৃত্তি করা এই কবিতাগুলো তিন অথবা তার চাইতে বেশি লাইনের হয়। বহু আগে থেকেই মালদ্বীপে ‘রাইভারু’ এর প্রচলন চলে আসছে।
মিদফা-আল-ইফতার ; লেবানন
সাহরির মতোই ইফতারের সময়ও সবাইকে জানিয়ে দেওয়াকে মুসলিমদের ইমানি কর্তব্য হিসেবে ধরা হয়। এই বিশ্বাস থেকেই লেবাননে ইফতারের সময় ঘোষণা করা হয় জাঁকজমকের সঙ্গে। কামান চালিয়ে সেই তীব্র আওয়াজের সঙ্গে জানান দেওয়া হয় রোজা ভাঙার সময়ের। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো এই রীতির নাম ‘মিদফা-আল-ইফতার’।
ইতিহাস অনুযায়ী এই রীতির জন্ম প্রাচীন মিসরে এবং ইসলামিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই এই রীতি প্রচলিত ছিল বিভিন্ন সময়। নানা চক্রে, সময়ের পরিক্রমায় আজ সেই মিসরীয় রীতি সগৌরবে পালিত হয় লেবাননে, যা হয়ে উঠেছে লেবানিজ সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মেহবিস ; ইরাক
রমজান মাসকে উদযাপনের সবচেয়ে ভিন্নধর্মী ও আনন্দমুখর রীতি সম্ভবত ইরাকেই দেখা যায়। ইফতারের পরে ইরাকি পুরুষেরা মেতে ওঠেন ‘মেহবিস’ নামের এক খেলায়, যা চলে সারা রাত। মূলত রমজানের ইবাদত ও নিয়মমাফিক জীবনকে একটু প্রাণবন্ত করে রাখতেই এই আয়োজন।
৪০ থেকে ২০০ জন মানুষ মিলে খেলা হয় মেহবিস। এই খেলার উৎপত্তি বিষয়ে সঠিক ইতিহাস জানা সম্ভব না হলেও একসময় ইরাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই খেলার আয়োজন করা হতো। রমজান উদযাপনের এমন ইতিহাস সত্যিই বিরল। পরবর্তী সময়ে যদিও যুদ্ধবিগ্রহ ও অরাজক পরিস্থিতির কারণে এই খেলা বৃহৎ উদ্যোগে আয়োজিত হয়নি অনেক দিন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আবারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই ইতিহাসবিজড়িত মেহবিস।
এভাবেই দেশে দেশে নিজেদের মতো করে সবাই পালন করে রমজানের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য। কিন্তু এই বছর করোনা মহামারিতে এসব রীতি পালন থমকে গেছে অনেকাংশেই। তাই রমজানের এই শুভ মাসে আমরা সবাই চাই, পৃথিবী আবার সুস্থ হয়ে উঠুক, ফিরে আসুক সব সুন্দর ও ঐতিহ্যমণ্ডিত এসব রীতিনীতি।
সূত্র : প্রথম আলো, জীবন্ত জীবন