রমজান মাস প্রতিটি মুসলিমের জন্য নিজের পরকালের মুক্তি এবং জীবনকে সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ। জীবনে সফল হতে গেলে যেসব গুণের প্রয়োজন – তার অনেক গুলোই রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব।
আত্মবিশ্বাস, নিষ্ঠা, ধৈর্য – ইত্যাদি গুণ অনুশীলন করতে চাইলে, এবং এগুলোকে নিজের অভ্যাসের অংশ করতে চাইলে, রমজানের রোজা হতে পারে একটি দারুন উপায়। তবে রোজার আসল উদ্দেশ্য ভুলে গেলে চলবে না। রোজার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। বাকি গুলো বাড়তি পাওনা। এবং এগুলোও আল্লাহর তরফ থেকেই আমাদের জন্য উপহার।
তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক এমন ৬টি বিষয়, যার মাধ্যমে রমজানের রোজা আপনাকে জীবনে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে পারে।
১. কঠিন অবস্থার সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা বাড়ায়
রমজানের রোজা একজন মানুষকে কঠিন ও হঠাৎ পরিবর্তিত অবস্থার সাথে মানিয়ে নেয়ার দারুন একটি ট্রেনিং দেয়। রমজান আসার সাথে সাথেই একজন মুসলিমকে হঠাৎ করেই তার দৈনন্দিন অভ্যাসকে বদলে ফেলতে হয়। সারা বছর এক ভাবে চলে হঠাৎ করেই একটি নতুন নিয়মে দিন কাটানোর জন্য অসাধারণ মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়। আপনি যখন এক মাস ধরে এইভাবে নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হবেন – তখন আপনার মাঝে একটি অন্যরকম মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা সৃষ্টি হবে।
জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে হঠাৎ করে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে মনে করুন কিভাবে আপনি এক দিনের নোটিশে নিজের পুরো দৈনিক রুটিন বদলে ফেলতে পেরেছেন। যখনই এভাবে চিন্তা করবেন – দেখবেন কোনও পরিস্থিতিতেই আপনি বিচলিত হচ্ছেন না। তার বদলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা এবং মানিয়ে চলার জন্য নতুন আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন।
২. আত্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও ফোকাস বৃদ্ধি করে
জীবনে যে কোনও ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা খুবই জরুরী। কাজের সময়ে কাজ করা, এবং অন্য কোনও দিকে ফোকাস না করা – প্রোডাক্টিভিটির অন্যতম শর্ত। কিন্তু আমরা বেশিরভাগই সফল হতে চেয়েও নানান ধরনের বিনোদন ও অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করি।সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ তার শারীরিক ও মানসিক প্রবৃত্তির দাস। শারীরিক ও মানসিক অনুভূতির ওপর মানুষের কাজ অনেকটাই নির্ভর করে। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা এগুলোকে জয় করতে পেরেছেন, এবং সাধারণ মানুষের কাতার থেকে নিজেদের অনেক ওপরে নিয়ে গেছেন।আপনিও যদি এইসব প্রবৃত্তিকে জয় করে শুধুমাত্র নিজের আধ্যাত্মিক মুক্তি ও জাগতিক সত্যিকার সাফল্যের দিকে ফোকাস করতে চান, তবে রমজানের রোজা হতে পারে আপনার জন্য একটি সেরা উপায়।
ক্ষুধা মানুষের সবচেয়ে আদিম এবং শক্তিশালী জৈবিক চাহিদা। পেটে খাবার না গেলে ক্ষুধা লাগবেই, এবং শরীর যে কোনও মূল্যে খাবার চাইবে। কিন্তু একজন রোজাদার হিসেবে আপনি প্রতিনিয়ত জৈবিক চাহিদাকে মানসিক শক্তি দিয়ে পরাজিত করবেন।ামনে সুস্বাদু সব খাবার, পানীয় – ইত্যাদি থাকলেও আপনি ইফতারের আগে এগুলো থেকে দূরে থাকবেন।এছাড়া রোজা রাখার সময়ে টিভি দেখা, সিনেমা দেখা, এবং গান শোনা থেকেও দূরে থাকতে হয়। এগুলো প্রিয় টাইমপাস হলেও এগুলো রোজদাররা এড়িয়ে চলেন।এই প্রাকটিসটি আপনাকে জৈবিক চাহিদা এবং আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে। আপনি যখন কোনও জরুরী কাজ করছেন, তখন কোনও টিভি শো এর কথা মনে হলে, বা বন্ধুদের সাথে নিরর্থক আড্ডার কথা মনে হলে আপনি আগের চেয়ে অনেক ভালোভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। লোভনীয় অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড, এনার্জি ড্রিংক থেকে দূরে থাকতে পারবেন- যদি রোজা রাখার মাধ্যমে পাওয়া মানসিক শক্তিকে কাজে লাগান।কাজের প্রতি ফোকাস এবং সুস্থতা ধরে রাখতে এই শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারলে আপনি পরকালের মুক্তির পাশাপাশি জাগতিক সাফল্য লাভেও অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবেন।
৩. রোজা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াবে
রোজা রাখতে গেলে মাঝে মাঝে দিনের একটা সময়ে আপনার মনে হবে আর সহ্য করতে পারছেন না। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি আপনাকে কাবু করতে চাইবে। কিন্তু আপনি সেই কষ্ট সহ্য করেও রোজা পূর্ণ করবেন। পুরো রমজান মাস জুড়েই যখন আপনি এভাবে কঠিন পরিস্থিতির মাঝেও নিজের লক্ষ্য পূরণ করবেন – তখন যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজের লক্ষ্যে অটল থাকার আত্মবিশ্বাস আপনার মাঝে সৃষ্টি হবে। অবস্থা যত কঠিনই হোক, চেষ্টা করলে আপনি লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন – এই বিষয়টি আপনি রোজার মাধ্যমে খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারবেন – এবং এই আত্মবিশ্বাস জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে সফল হতে আপনাকে সাহায্য করবে।
৪. কথা দিয়ে কথা রাখার দৃঢ়তা এবং নৈতিকতা বাড়বে
রমজান মাসটি নীতি নৈতিকতা মেনে চলার একটি দারুন ট্রেইনিং। আপনি জানেন যে রমজানের রোজা স্বয়ং স্রষ্টার তরফ থেকে বেঁধে দেয়া দায়িত্ব। এবং রোজা রাখার নিয়্যত করার মাধ্যমে আপনি মহান আল্লাহ কে কথা দিচ্ছেন যে আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি পালন করবেন। এবং এই প্রতিশ্রুতি আপনি বেশিরভাগ সময়েই রক্ষা করতে পারবেন। এভাবে দীর্ঘ এক মাস ধরে এই বিষয়টি অভ্যাস হতে হতে আপনার মাঝে প্রতিশ্রুতি পূরণের দৃঢ়তা সৃষ্টি হবে। যে কোনও অভ্যাসই একটি চর্চার বিষয়। এবং ৩০ দিন টানা কিছু করা, সেই বিষয়কে অভ্যাসে পরিনত করার জন্য দারুন একটি সময়সীমা। এই সময়টা কাজে লাগিয়ে আপনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এবং নৈতিকতাকে দৈনন্দিন অভ্যাসের অংশ বানিয়ে ফেলতে পারবেন।
৫. ধৈর্যশীলতা বৃদ্ধি
ধৈর্য একটি অসাধারণ মানসিক শক্তি। শুধুমাত্র এই একটি শক্তি দিয়েই অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলা যায়। আর ধৈর্যশীলতা চর্চা করার জন্য রমজানের চেয়ে ভালো সময় আর হতে পারে না। রোজা মানে শুধুই না খেয়ে থাকা নয়। সব ক্ষেত্রেই আপনাকে সংযমী হতে হবে। কেউ আপনাকে রাগাতে চেষ্টা করছে, এবং আপনার রাগ উঠছে – কিন্তু রোজা থাকার কারণে আপনি রাগ প্রকাশ করছেন না। – এটা একটা চরম ধৈর্যের পরিচয়। আবার ৮-১০ ঘন্টা যাবৎ কিছুই খাননি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে – হাত বাড়ালেই মজার মজার খাবার, ফ্রিজ খুললে বা দোকানে গেলেই ঠান্ডা পানীয় পেতে পারেন। কিন্তু আপনি সেগুলো থেকে দূরে থাকছেন আরও বেশ কয়েক ঘন্টার জন্য। – এটা যে বিশাল ধৈর্যের ব্যাপার – তা কাউকে অনেক্ষণ ধরে বোঝাতে হবে না।
দীর্ঘ এক মাস ধরে এই চরম ধৈর্য যদি সঠিক ভাবে কেউ চর্চা করতে পারেন – তবে যে কোনও অবস্থাতেই তার জন্য ধৈর্য ধরা অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে। আর জীবনের সব ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্যই ধৈর্য ধরে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোনও বিকল্প নেই।
৬. সব সময়ে ইতিবাচক থাকতে শিখবেন
আপনি যে লক্ষ্যই পূরণ করতে চান, অথবা যা-ই অর্জন করতে চান, আপনাকে সব সময়ে আশাবাদী ও ইতিবাচক থাকতে হবে। এবং মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি যার অটল ভরসা আছে, তারচেয়ে বেশি ইতিবাচক কারও পক্ষেই হওয়া সম্ভব নয়। আর আপনি আল্লাহর যত কাছাকাছি হতে পারবেন – আপনার মাঝে আশাবাদীতা ও ইতিবাচক চিন্তাও তত বাড়বে। যত যা-ই ঘটুক না কেন – আপনি সব সময়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এর ওপর ভরসা রাখবেন। আন্তরিক ভাবে, খাঁটি মনে তাঁর কাছে চাইলে তিনি কাউকেই ফিরিয়ে দেন না। কিন্তু সেই চাওয়ার জন্য নিজের ভেতরে বিশ্বাস বা ঈমানকে খাঁটি হতে হবে। স্রষ্টার প্রতি গভীর বিশ্বাস ও মমতা থাকতে হবে। – আর সেই গভীর বিশ্বাস ও মমতাকে দৃঢ় করার জন্য শ্রেষ্ঠ একটি সময় হল রোজার মাস রমজান।
আপনি যদি সঠিক ভাবে রোজা রাখেন, নামাজ পড়েন, রাত জেগে নফল এবাদত করেন – তবে আপনার মাঝে স্রষ্টার প্রতি টান ও আত্মিক চেতনা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। নেকী অর্জন, পরকালের মুক্তি পাওয়ার পুঁজির পাশাপাশি আপনার আত্মা হয়ে উঠবে পরিশুদ্ধ। এবং আপনি সব অবস্থাতেই স্রষ্টার ওপর ভরসা করতে পারবেন। কোনও অবস্থাতেই নেতিবাচক চিন্তা বা হতাশা আপনাকে কাবু করতে পারবে না।
মানবজাতির মধ্যে মুসলিম জাতিকে আল্লাহ এমন অনেক উপহার দিয়েছেন – যা আর কাউকে দেননি। আর এর মধ্যে অন্যতম একটি হল এই রমজান মাস। শক্তিশালী ও আদর্শ মানুষ হওয়ার জন্য রমজানের বিষয়গুলোর চর্চা একজন মানুষকে অনেকটাই এগিয়ে দিতে পারে।