হে মুসলিম যুবক, জাতির স্তম্ভ, শ্রেষ্ঠ দানবীর, জাতি বিনির্মাণের সূতিকাগার এবং বিজয় ও সম্ভাবনাময় প্রজন্ম! তোমাদের জন্যই এই সকল বাণী-উপদেশ-নির্দেশনা; তোমাদের তরে তা উপস্থাপন করছি যেন আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা সকলকে উপকৃত করেন, প্রত্যেককে সঠিক পথের দিশা দেন এবং হিম্মত আরো বাড়িয়ে দেন। সুতরাং হে তরুণেরা! ভাল কথা মান্য করো এবং ছহীহ হাদীছ গ্রহণ কর।
যৌবন অপরিমেয় অনুগ্রহ এবং মহাপরীক্ষা :
হে মুসলিম যুব সম্প্রদায়! প্রথমেই তোমাদের জানা আবশ্যক যে, পার্থিব জীবনে তোমাদের বেঁচে থাকা আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় অনুগ্রহ, যার জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আবশ্যক। এমর্মে আল্লাহ বলেন, ‘কিরূপে তোমরা আল্লাহকে অবিশ্বাস করছ? অথচ তোমরা নির্জ্জীব ছিলে, পরে তিনি তোমাদেরকে সঞ্জীবিত করলেন; পুনরায় তিনি তোমাদেরকে নির্জ্জীব করবেন, তৎপরে তোমাদেরকে জীবিত করবেন, অবশেষে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে’ (বাক্বারাহ ২৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে উপজীবিকা প্রদান করেছেন। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে মৃত্যু দান করবেন। তৎপর তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করবেন। ফলত তোমাদের অংশী-উপাস্যগণের মধ্যে এমন কি কেউ আছে যে, এগুলো কোন কিছু করতে পারে? বস্ত্ততপক্ষে তিনি পবিত্রতম এবং তোমারা যে অংশী স্থির কর, তিনি সেগুলো হতে সমুন্নত’ (রূম ৫৪)।
দুনিয়ার এই অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষে চিরস্থায়ী অস্তিত্ব নয়; বরং তা অত্যন্ত স্বত ও সাময়িক। বস্ত্তত চিরন্তন নিয়ামত ও চিরস্থায়িত্ব হচ্ছে পরলোকে মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভ। সেখানে মানুষ ও জিন জাতিকে স্ব স্ব কর্মানুপাতে আল্লাহর রহমতে প্রতিদান দেয়া হবে। এ বিষয়ে তিনি পবিত্র কুরআন ও হাদীছের মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তবে যে বিশ্বাস স্থাপনকারী, সে কি দুষ্ককার্যকারীর অনুরূপ? অবশ্যই তারা সমান নয়। তবে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকার্য সম্পাদন করেছে, তাদের জন্য স্বর্গোদ্যানের নিকেতন। তারা যা করেছিল, এটা (এই নিকেতন) তা-রই আতিথ্য-স্বরূপ। অপরপক্ষে যারা দুষ্কার্য সম্পাদন করে, তাদের বাসস্থান জাহান্নাম। যখনই তারা সেখানে থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেখানে পুণঃনিক্ষিপ্ত করা হবে এবং বলা হবে ‘তোমরা জাহান্নামের শাস্তি আস্বাদন কর যে বিষয়ে তোমরা অসত্যারোপ করেছিলে। আর নিশ্চয় আমি তাদেরকে বৃহত্তর শাস্তির পূর্বে লঘুতর শাস্তি আস্বাদন করাব যাতে তারা ফিরে আসে। আর কে সেই ব্যক্তির চেয়ে অধিকতর অত্যাচারী, যাকে স্বীয় প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়া সত্ত্বেও মুখ ফিরিয়ে নেয়; নিশ্চয় আমি অপরাধীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করব’ (সাজদাহ ১৮-২২)।
এমনি করে তোমাদের আরো জানা উচিত যে, যৌবনকাল আল্লাহ প্রদত্ত আয়ুষ্কালের সংক্ষিপ্ত এক অংশ এবং অবশ্যই তোমাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হতে হবে ও হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। অতঃপর তোমরা প্রতিদান প্রাপ্ত হবে। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে জীবনের এই মূল্যবান মুক্তাকে কাজে লাগানো এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করা। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিয়ে বললেন, পাঁচটি বস্ত্তর পূর্বে পাঁচটি বস্ত্তকে গণীমত মনে করবে। (১) বার্ধক্যের পূর্বে তারুণ্যকে, (২) অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে (৩) দারিদ্রে্যর পূর্বে স্বচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে (আলবানী, ছহীহুল জামে‘ হা/১০৭৭)।
আবূ বারযাহ (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, চারটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত কোন ব্যক্তি বিচার দিবসে চুল পরিমাণ নড়তে পারবে না। (১) তার সময় সম্পর্কে, কোন কাজে তা ব্যয় করেছে (২) তার জ্ঞান সম্পর্কে, কতটুকু আমল করেছে (৩) তার সম্পদ সম্পর্কে, কিভাবে তা উপার্জন করেছে এবং কোন পথে ব্যয় করেছে এবং (৪) তার শরীর সম্পর্কে, কোন কাজে সে তা ব্যবহার করেছে (তিরমিযী, হাদীছ ছহীহ)।
এমনকি হাদীছে এসেছে যে, জান্নাতের সকল অধিবাসী হবে যুবক এবং হাসান (রাঃ) ও হুসাইন (রাঃ) হবেন সকল যুবকের নেতা। (হাকেম, তিরমিযী, সিলসিলা ছহীহা হা/৪৩৮২)।
এভাবে রাসূল (ছাঃ) যুবকদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন এবং পরিপূর্ণ প্রতিদান জান্নাতুন নাঈম-এর অঙ্গীকার করতেন। ইবনু আববাস (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন, হে কুরাইশ যুবদল! নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাযত কর, ব্যভিচার করো না। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি স্বীয় লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করে, তার জন্য রয়েছে জান্নাত (হাকেম ও বায়হাকী; আলবানী ছহীহ বলেছেন)। হাসান সূত্রে বায়হাকীতে এসেছে, হে কুরাইশ যুবদল! ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ো না। নিশ্চয় যে ব্যক্তির যৌবন পাপ থেকে বেঁচে থেকেছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
সুতরাং তোমরা যৌবনের তারুণ্যকে সুউচ্চ মর্যাদা, কল্যাণ, সৎকর্ম, বিজয় ও অপার সম্ভাবনার পথ হিসাবে বেছে নাও।
বয়স ও সময় অপচয় থেকে সতর্ক হওয়া :
হে যুবসমাজ! আনুগত্যহীনতা ও অলসতায় যৌবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়কে অপচয় করা হতে সাবধান থেকো। আরো সাবধান থেকো পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে তা ধ্বংস করা হতে। কেননা বিচার দিবসে যার পুণ্যের পাল্লা হালকা হবে, সে ব্যক্তিই সেদিন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সে দিনের সে কঠিন মুহূর্তে সে পার্থিব জীবনে ফিরে আসতে চাইবে, কিন্তু তা আর সম্ভব হবে না। এ মর্মে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘এমনকি যখন তাদের কারো নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন সে বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে পুনরায় পৃথিবীতে প্রেরণ করুন যেন আমি সেখানে সৎকার্য করতে পারি যে কার্যগুলো আমি পরিত্যাগ করেছিলাম। কখনোই নয়, সে যা বলছে তা কথার কথা মাত্র। বস্ত্তত তাদের সম্মুখে উত্থান দিবস পর্যন্ত আবরণী থাকবে। অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, সেদিন তাদের মাঝে কোন আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং তারা পরস্পরে জিজ্ঞাসাও করবে না। সুতরাং যাদের (পুণ্যের) পাল্লা ভারী হবে, তারা হবে সফলকাম। আর যাদের পুণ্যের পাল্লা হালকা হবে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হবে। অনল তাদের মুখমন্ডল ঝলসিয়ে দিবে এবং সেখানে তারা বিবর্ণ হয়ে যাবে’ (মুমিনূন ৯৯-১০৪)।
এমনিভাবে তোমাদের এটাও জেনে রাখা উচিত যে, সময়-ই তোমাদের মূল সম্পদ। যদি সময় বাজে কাজে ও ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন ব্যতীত অন্য ক্ষেত্রে অপচয় হয়, তাহলে মানুষ তার বয়স ও তারুণ্যের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলবে। কেননা আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর সন্তুষ্টি ও ইবাদতেই নিহিত রয়েছে সময় ব্যয়ের সার্থকতা। সময়ের সদ্ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রত্যেকের জন্য কল্যাণ ও সমৃদ্ধি। অপরপক্ষে সময় অপচয়ে রয়েছে আত্মপ্রতারণা। ইবনু আববাস থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, দু’টি নে‘মতের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই ধোঁকায় পড়ে রয়েছে। (১) সুস্থতা এবং (২) অবসর (বুখারী)।
পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলো একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাব, মহান আল্লাহ দিবা-নিশি, প্রাতঃকাল, পূর্বাহৃ, মধ্যাহৃ, অপরাহৃ ইত্যাদির শপথ করেছেন। বস্ত্তত সৃষ্টিতে স্বীয় ক্ষমতার নিদর্শন স্বরূপ এবং শরী‘আত নির্দেশিত পথে সময়ের সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্যই আল্লাহ এমনটি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় নভোমন্ডল ও ভূমমন্ডল সৃজনে এবং দিবস ও রজনীর পরিবর্তনে জ্ঞানবানের জন্য স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে। (জ্ঞানবান তারা) যারা দন্ডায়মান, উপবেশন ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা করে (বলে), ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এগুলো বৃথা সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্রতম। অতএব আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন’ (আলে ইমরান ১৯০-১৯১)।
অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হল, বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমান হেলায়-ফেলায় সময় নষ্ট করে চলেছে, কাঙ্খিত সাফল্য অর্জনে প্রচেষ্টাহীনভাবে সময় কাটাচ্ছে। কখনো কখনো পাপকর্মে নিমজ্জিত হয়ে, অনর্থক স্থানে বা চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে, অসৎ সঙ্গীর সাথে এবং পরশ্রীকাতরতা ও কুৎসা রটনার মত গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে মূল্যবান সময়কে নির্বিকার নষ্ট করছে। এমনকি তারা বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও অশ্লীল সাইটে দিবা-রাত্রি অতিবাহিত করছে। যেখানে যেনা-ব্যভিচার, অশ্লীলতা-বেলেল্লাপনার দৃশ্য। এতে ব্যক্তিত্ব-পৌরুষত্ব-লজ্জা বলতে কিছুই থাকে না। বরং মুসলমানদের মাঝে গর্হিত কর্মকান্ড ছড়িয়ে পড়ে। বস্ত্ততপক্ষে একজন প্রকৃত ও জ্ঞানবান মুসলিমের নিকট এগুলো অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
আলী (রাঃ) বলেন, আমি তোমাদের জন্য দুইটি বিষয়ে শঙ্কিত। (১) উচ্চাকাঙ্খা এবং (২) প্রবৃত্তির অনুসরণ। কেননা উচ্চাকাঙ্খা মানুষকে পরকাল বিমুখ করে দেয় এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ সত্য থেকে বিচ্যুৎ করে।
আওন বলেন, আজকের দিনে পদার্পণকারী কত ব্যক্তি সে দিনকে পরিপূর্ণ করতে পারছে না এবং আগামীকালের অপেক্ষাকারী সেদিনে পৌঁছাতে পারছে না। যদি তোমরা সময় ও তার প্রবাহের প্রতি লক্ষ্য কর তাহলে অবশ্যই আকাঙ্খা ও তার প্রতারণা তোমাদেরকে ক্রদ্ধ করবে। কবি বলেন,
دقات قلب المرأ قائلة له * إن الحياة دقائق وثوانى
‘ব্যক্তির হৃদয়স্পন্দন তাকে বলে, জীবন হচ্ছে কয়েক সেকেন্ড ও মিনিটের সমাহার’।
সময় সম্পর্কে ঔদাসীন্য বড়ই বিপজ্জনক ব্যাপার। কেননা উদাসীনতা হচ্ছে ঘাতক সদৃশ ক্ষতিকর; দুরারোগ্য ও ধ্বংসাত্মক ব্যাধি। আর এই আলস্য তথা উদাসীনতা এমন পন্থা যাতে গুটিকয়েক রহমতপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত সকলেই নিপতিত। এই ব্যাধি কয়েক শতাব্দী থেকে মুসলিম সমাজে অতি সন্তর্পণে প্রবেশ করে স্বীয় লক্ষ্য অর্জনে বাঁধ সেধেছে, তার শক্তি দুর্বল করে ফেলেছে, এমনকি পার্থিব জীবনে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনেও তাকে নির্লিপ্ত করেছে। চিন্তাশীল ও ভাবুক ব্যক্তিমাত্রই কুরআনের আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ্য করে সেখানে আল্লাহ তা‘আলা অলসতা নামক ধ্বংসাত্মক ব্যাধির ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন, এই ব্যাধি দেখতে পাবে যে তা জাতির ওপর চেপে বসেছে, জাতিকে লক্ষচ্যুত করেছে এবং আল্লাহর শাস্তিকে ত্বরান্বিত করেছে। এমর্মে আল্লাহ বলেন, ‘যেন আপনি সে সম্প্রদায়কে ভীতি প্রদর্শন করেন যাদের পিতৃপুরুষগণ ভীতি প্রদর্শিত হয়নি। ফলে তারা অমনোযোগীই থেকে গিয়েছে। নিশ্চয় তাদের অধিকাংশের ওপর সেই বাক্য সত্যে পরিণত হয়েছে, ফলে তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না (ইয়াসীন ৬-৭)।
সালাফে ছালেহীনের সময়নিষ্ঠা :
আমাদের পূর্বপুরুষগণ সময়ের যথাযথ ব্যবহারে ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। ফলে উভয় জগতের সাফল্য তাদের করতলে আসতে বাধ্য হয়। আবুল ওয়াফা বিন আকীল বলেন, জীবনের এক মূহূর্ত সময় নষ্ট করাও আমার জন্য সমীচীন নয়। এমনকি আমার জিহবা ও চক্ষু অধ্যয়ন করতে অপরাগ হয়ে গেলে আমি একটু বিশ্রাম নিব মনে করি। এতদত্ত্বেও মনের গহীনে উদিত কথা না লেখা পর্যন্ত আমি উঠতে পারিনা। ইবনুল জাওযীর কাছে যখন এমন ব্যক্তি আসত যার সম্পর্কে তার ধারণা হত যে, সে তার সময় নষ্ট করবে। তখন তিনি সময় নষ্ট না করার জন্য কলম প্রস্তুতকরণ ও খাতার পাতা ঠিক করতে ব্যস্ত থাকতেন।
ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি ঐদিনের মতো কোন দিনের জন্য আফসোস করি না যে দিনের সূর্য অস্তমিত হয়ে যাচ্ছে এবং আমার বয়স কমে যাচ্ছে, কিন্তু আমার আমল বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন, সময়ের অপচয় মৃত্যু অপেক্ষা অধিকতর ভয়াবহ। কেননা সময়ের অপচয় ব্যক্তিকে আল্লাহবিমুখ ও আখেরাতবিমুখ করে দেয়। পক্ষান্তরে মৃত্যু মানুষকে পার্থিব জগতের ভোগ-বিলাস থেকে বিমুখ করে। হাসান বাছরী বলেন, আমি অনেক লোককে দেখেছি যারা নিজেদের সময় সম্পর্কে তোমাদের সম্পদ সচেতনতার চেয়েও অধিকতর সচেতন ছিলেন।
ছাহাবীদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুধাবন করা :
হে যুব সম্প্রদায়! তোমরা কখনো ভুলে যেওনা যে, যারা প্রথম দাওয়াতে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, যারা তাঁকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, বিপদসঙ্কুল মুহূর্তে তাঁর সাথে হিজরত করেছিলেন, তারা অধিকাংশ-ই ছিলেন তেজোদীপ্ত যুবক। যেমন আবু বকর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর চেয়ে বয়সে ছোট ছিলেন। অনুরূপ মুছ‘আব বিন উমায়ের, আলী বিন আবু তালেব, আরকাম বিন আবিল আরকামসহ আরো অনেকে। এরা মাক্কী জীবনের প্রথম দিকে ঈমান এনেছিলেন। অতঃপর আল্লাহর একত্ববাদ ও দাসত্বের গুরুভার নিয়ে দিকদিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। এক আল্লাহর ইবাদত করা এবং অপরকে ইবাদতের প্রতি আহবান করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। ফলে ইসলাম ও ঈমানের শক্তিতে এক এক করে পৃথিবীর বহু দেশ তারা জয় করেছিলেন। যদ্দরুণ বাধাহীন গতিতে তারা রিসালাতের বাণী প্রচার করতে পেরেছিলেন। তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতেন না। কেননা তারা পাথির্ব জীবনে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে বেশ ভালভাবেই অবগত হয়েছিলেন। তারা এও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, কেন আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং আল্লাহ পরকালে জান্নাতে তাদের জন্য কি প্রস্ত্তত করে রেখেছেন এ সম্পর্কেও তারা অবহিত ছিলেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যখন বিশ্বাসীরা শত্রুদল সমূহকে প্রত্যক্ষ করল তখন বলতে লাগল, ‘এটা তো তা-ই যে বিষয়ে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্য আরও বৃদ্ধি পেল। বিশ্বাসীগণের মধ্যে এমনও কেউ কেউ আছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে, সুতরাং তাদের কেউ কেউ (শাহাদাতের) মানত পূর্ণ করেছে এবং কেউ কেউ অপেক্ষমান রয়েছে এবং (নিজেদের সংকল্পকে) বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করেনি। যেন আল্লাহ সত্যবাদীগণকে তাদের সত্যিকার প্রতিদান দেন এবং চাইলে কপট-বিশ্বাসীদের শাস্তি প্রদান করেন অথবা ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পরমদয়ালু অতিশয় ক্ষমাশীল’ (আহযাব ২২-২৩)।
ইসলামের প্রাক্কালে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাথীগণ স্বীয় নীতিতে অবিচল ছিলেন। সকল প্রকার যড়যন্ত্র, প্রবঞ্চনা, বাধা-বিপত্তি, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, বয়কট এবং হাযারো উস্কানিতেও তারা ধৈর্য হারাননি। তারা নিজেদের সম্পদ এমনকি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজনকে একমাত্র আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যেই বিসর্জন দিয়েছিলেন। সত্য ও নীতির ওপর অবিচল থাকার ব্যাপারে তারা ছিলেন একমাত্র আদর্শ। সময় ব্যয় ও সহযোগিতা করার ব্যাপারে তারা ছিলেন অনন্য।
প্রত্যেক ছাহাবী পৃথিবীতে স্বীয় অস্তিত্বের উদ্দেশ্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে তাঁরা নিজেদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণে পূর্ণ সজাগ ছিলেন এবং আল্লাহর পথে উত্তম পদ্ধতিতে জিহাদ করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁরা আমাদের জন্য আদর্শ। সুতরাং রাসূল (ছাঃ)-এর পরে তাদেরকে-ই অনুপম আদর্শরূপে আমাদের গ্রহণ করা উচিৎ। মোটকথা আমাদের কর্তব্য তাদের অনুকরণ-অনুসরণ করা।
আজকের যুবসমাজ ও পূর্ববর্তী মনীষীগণের মাঝে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। বর্তমান যুবকেরা জীবনের মৌলিক লক্ষ্য সম্পর্কে উদাসীন। তারা অবৈধ প্রণয়, গান-বাজনা, হাসি-তামাশা, উদ্দেশ্যহীনভাবে পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো ও ঈমান-আখলাক ধ্বিংসী সাহিত্য অন্বেষণের মত গুরুত্বহীন নিকৃষ্ট কাজকে নিজেদের লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছে। সুতরাং স্বীয়কর্তব্য অবগত যুবক ও কর্তব্যজ্ঞানহীন যুবকদের মাঝে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে। দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন যুবকেরা দায়িত্ব পালনের তরে সার্বিক প্রচেষ্টা চালায় এবং তা বাস্তবায়নে কোনরূপ ত্রুটি করে না। নিঃসন্দেহে পরকালে এরাই সফলকাম।
সূরা আনকাবূতের ৬৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আমার তরে জীবন বিলিয়ে দিবে, আমি তাদেরকে অবশ্যই সুপথ প্রদর্শন করব, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে রয়েছেন।
সুতরাং সময় দ্বারা উপকৃত হওয়ার একটি মাত্র পথ রয়েছে। তা হল প্রত্যেক মুসলমানকে নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে তা বাস্তবায়নে কাজ করবে।
ইবাদতই আমাদের মহান দায়িত্ব ও পার্থিব জীবনে কর্তব্য। আর ইবাদতে যে ধরনেরই হোক না কেন, তাতে ব্যস্ততা রয়েছে।
মুসলিম যুবকদের উচিৎ এই গুরুত্বপূর্ণ ও মহান লক্ষ্যকে উপলব্ধি করা। পৃথিবীতে আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা। তিনি আমাদেরকে মহৎ উদ্দেশ্যে স্বীয় প্রজ্ঞায় সৃষ্টি করেছেন। আর সে উদ্দেশ্য হচ্ছে কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক না করে একমাত্র তাঁর ইবাদত করা।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পবিত্র কালামে (শিরক প্রসঙ্গে) আগেই বলে দিয়েছেন যাতে কেউ বিচার দিবসে বিপত্তি করতে না পারে। যেমন তিনি বলেন, ‘আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি’ (যারিয়াত ৫৬)। অত্র আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ আমাদেরকে অনর্থক খেল-তামাশা, প্রবৃত্তির পূজায় ব্যস্ত থাকা ও পার্থিব জগতের ক্ষণস্থায়ী আনন্দ-উল্লাসে ডুবে থাকার জন্য সৃষ্টি করেননি। নিশ্চয় তিনি আমাদেরকে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহর ইবাদত করা বলতে বুঝায় ব্যক্তির পুরো জীবনটা আল্লাহর আদেশ পালনে উৎসর্গ করা এবং তিনি যে সকল বিধান স্বীয় রাসূলের মাধ্যমে প্রবর্তন করেছেন, তা পালন করা। এমর্মে তিনি বলেন, ‘হে নবী আপনি বলে দিন, ‘আমার ছালাত, আমার কোরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবই বিশ্বচরাচরের অধিপতি আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন অংশীদার নেই আর এই দাওয়াতের ব্যাপারেই তো আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম মুসলিম’ (আন‘আম ১৬২-৬৩)। সুতরাং নযর-নেওয়াজ, কোরবানী, ইবাদত, কোনকিছুই আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ পাওয়ার অধিকার রাখে না।
মহানবী (ছাঃ)-ই ইবাদতে অনুপম দৃষ্টান্ত :
হে তরুণসমাজ! যদি আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবন-চরিতের প্রতি লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাব যে, রাসূল (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের জন্য ইবাদত ও আল্লাহর হুকুম অনুসরণে মহৎ দৃষ্টান্ত পেশ করে গেছেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা খোদ রাসূলকে-ই মহৎ দৃষ্টান্ত ও উত্তম আদর্শ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদর্শকে কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিমের অনুকরণ-অনুসরণ করা উচিৎ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ বিদ্যমান রয়েছে এবং সে ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহকে ও পরকালকে প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করে’ (আহযাব ২১)।
রাসূলের ইবাদত-পদ্ধতি :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাক্কী জীবনে গভীর রাতে আরামের নিন্দ্রা পরিত্যাগ করে ছালাত আদায় করতেন, অর্থ বুঝে তারতীল সহকারে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহীভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতেন, কুরআন থেকে পাথেয় ও ঈমান আহরণ করতেন। যাতে করে তিনি অধিক আল্লাহভীতি অর্জন করতে পারেন। রিসালাতের মহান দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বব্যাপী আল্লাহর বাণী প্রচারে ব্রতী হন। তার মাক্কী জীবনের ইবাদত-সম্পর্কে সূরা মুযযাম্মিলের দিকে লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সেখানে আল্লাহ বলেন, ‘হে চাদরাবৃত ব্যক্তি। রাত্রিকালে (ছালাতে) দন্ডায়মান থাকুন কিয়দাংশ রাত্রি ব্যতীত। অর্থাৎ অর্ধেক রাত্রি অথবা অর্ধেক থেকেও কিছু কম করুন। অথবা অর্ধাংশ থেকে কিছু বৃদ্ধি করুন এবং (ছালাতে) খুব স্পষ্টভাবে কুরআন তেলাওয়াত করুন। আমি অচিরেই আপনার প্রতি এক গুরুভার বাণী প্রেরণ করব। নিশ্চয় রাত্রে গাত্রোত্থান করা কঠোর আত্মসংযম ও উচ্চারণে অনুকূলে। কেননা দিনে তো আপনার নানাবিধ ব্যস্ততা থাকে। আর আপনি স্বীয় প্রতিপালকের নাম স্মরণ করুন এবং একাগ্রচিত্তে তাঁর প্রতি মগ্ন হন। তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের প্রতিপালক, তিনি ব্যতীত কোন সত্য মাবূদ নেই, অতএব তাঁকে-ই কর্মবিধায়করাপে গ্রহণ করুন। তারা যা বলে তাতে ধৈর্যধারণ করুন এবং তাদেরকে উত্তম বর্জনে পরিবর্জন করুন। আপনি, আমাকে ও সম্পদশালী অসত্যবাদীকে ছেড়ে দিন এবং তাদেরকে কিছুকাল অবকাশ দিন (মুযযাম্মিল ১-১১)।
আর এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। গুরু দায়িত্বভার বহন, পৃথিবীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন ও ইতিহাসের গতিপথকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য তিনি তাকে প্রস্ত্তত করেছিলন।
রাসূল (ছাঃ) গভীর রাত পর্যন্ত বিনম্রচিত্তে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছালাত আদায় করতেন। এমনকি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় তার পদযুগল ফুলে যেত, তবুও তিনি ছালাতে মগ্ন থাকতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর পা ফুলে যেত। অতঃপর একদিন তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন? তারপরেও আপনি এভাবে ইবাদতে নিমগ্ন থাকেন কেন? তিনি বললেন, ‘আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?’ (বুখারী ও মুসলিম)।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোন কোন মাসে ছিয়াম ছেড়ে দিতেন তখন আমরা ভাবতাম তিনি মনে হয় আর ছিয়াম রাখবেন না। আবার কোন কোন মাসে একটানা ছিয়াম পালন করতেন তখন আমরা ভাবতাম তিনি মনে হয় কখনো ছিয়াম রাখা বন্ধ করবেন না। তুমি যদি তাকে রাতে ছালাতরত দেখ তাহলে দেখবে যে তিনি ছালাত আদায় করেই বলেছেন। আর যদি ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে চাও তাহলে তাকে সেই অবস্থাতে দেখতে পাবে (বুখারী)।
সুতরাং আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদতনিষ্ঠা কেমন ছিল এবং কিরূপ ক্লান্তিহীনভাবে তিনি ছালাত, কুরআন তেলাওয়াত, যিকির-আযকার, তাছবীহ-তাহলীল, ছিয়াম ইত্যাদি সম্পাদন করতেন।
ছাহাবী ও যুবকদেরকে ইবাদতের প্রতি রাসূল (ছাঃ)-এর উৎসাহ দান :
হে যুবকদল (জেনে রাখ)! রাসূল (ছাঃ) ছালাত-ছিয়ামসহ যাবতীয় ইবাদতের প্রতি ছাহাবীগণকে উৎসাহিত করতেন, পাশাপাশি ইবাদত করার নির্দেশ দিতেন। এছাড়াও তাদেরকে ইবাদতের প্রতি আগ্রহী হতে বলতেন, তা (ইবাদত) বৃদ্ধির নির্দেশনা দিতেন, ইবাদতের উপকারী দিকগুলো শিক্ষা দিতেন এবং অলসতা সম্পর্কে সতর্ক করতেন। সুতরাং রাসূল (ছাঃ) কিভাবে সাহাবায়ে কেরামকে ইবাদত শিক্ষা ও নির্দেশনা দিতেন তা জানতে নিম্নোক্ত হাদীছগুলো পড়-
আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (ছাঃ) এক রাতে তার (আলীর) ও ফাতেমার কাছে গমন করলেন। অতঃপর উভয়কে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা কি ছালাত আদায় করছ না?’ (বুখারী ও মুসলিম)
সালেম বিন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর খাত্তাব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আব্দুল্লাহ কতইনা ভালো মানুষ হত যদি সে রাত ছালাতে কাটাতো’। সালেম বলেন, ‘এরপর থেকে আব্দুল্লাহ রাতে প্রায় ঘুমাতো না বললেই চলে’ (বুখারী ও মুসলিম)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ওহে আব্দুল্লাহ! তুমি এমন ব্যক্তির মত হয়োনা, যে রাতে জাগে অথচ ছালাত আদায় করে না’ (বুখারী ও মুসলিম)।
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে এক ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হল যে সূর্যোদয় পর্যন্ত ঘুমাত। তখন তিনি বললেন, ‘ঐ ব্যক্তির দুই কানে শয়তান প্রস্রাব করে’। অথবা তিনি বললেন, ‘এক কানে’ (বুখারী ও মুসলিম)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কারো কারো কাঁধের পেছনভাগে শয়তান তিনটি গিট মারে যখন সে ব্যক্তি ঘুমিয়ে থাকে। প্রত্যেকবার গিট মারার সময় শয়তান বলেন, রাত পোহাবার অনেক দেরী আছে, ঘুমাও’। অতঃপর যখন সে ব্যক্তি ঘুম থেকে জেগে আল্লাহর নাম স্মরণ করে, তখন একটি গিট খুলে যায়, যখন অযূ করে তখন আরেকটি গিট খুলে যায় এবং যখন সে ছালাত আদায় করে তখন শেষ গিটটি খুলে যায়। ফলে সে সকালে বেশ প্রফুল্ল ও মানসিক স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। আর যে ব্যক্তি ঐ কাজ তিনটি করে না সে সকালে আলস্য ও স্বাচ্ছন্দহীনতা অনুভব করে’ (বুখারী ও মুসলিম)।
আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, হে মানব সকল, তোমরা সালামের বিস্তার ঘটাও, (দরিদ্রকে) খাদ্য খাওয়াও এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন রাতে ছালাত আদায় কর। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে (তিরমিযী)।
উপরোক্ত হাদীছ ও আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর আদেশ পালন, গভীর রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী, ছাহাবীগণকে ইবাদতের শিক্ষা দান, তাদেরকে উৎসাহিতকরণ ও ইবাদতের দিকনির্দেশনা দেওয়ার মাধ্যমেই সর্বোচ্চ আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন।
সুতরাং উল্লিখিত আলোচনায় সকল শিক্ষক ও আল্লাহর পথে দাওয়াত দানকারীর জন্য একটি শিক্ষা রয়েছে। তাহল নিজে পালন করে অপরকে তা পালন করতে বলা এবং এমন কিছুর প্রতি মানুষকে আহবান না করা যা আত্মকল্যাণের বিপরীত হয় অথবা নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। কেননা এরূপ কর্মকান্ড আল্লাহ অত্যন্ত অপছন্দ করেন। তিনি বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ, নিজেরা যা করো তা মানুষকে বল কেন। আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় যে, তোমরা যা বল, তা করনা’ (ছফ ২৩)।
অত্র আলোচনায় আমাদের জন্যেও একটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে, রাত্রে ছালাত (তাহাজ্জুদ) আদায় করা, কুরআন পাঠ করা ও যথাযথভাবে উপলব্ধি করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত এবং ইবাদত হচ্ছে ঈমান, শিক্ষা ও প্রতিপালন, হেদায়াত এবং দায়িত্বভার বহনে দৃঢ়চিত্ততার পাথেয়।
রাতের ছালাত (তাহাজ্জুদ) ও ইবাদতে এগুলো ছাড়াও আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে। আবু উমামা হতে বর্ণিত তিনি বরেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘রাতের ছালাত (তাহাজ্জুদ) আদায় করা তোমাদের জন্য আবশ্যক। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলগণ তা পালনে অভ্যস্ত ছিল। আর তা তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম, পাপ মোচনের কাফফারা এবং পাপ থেকে নিষেধকারী’ (তিরমিযী)।