হিন্দুধর্মের অন্যতম জনপ্রিয় দেবী কালী, যাঁকে শক্তি ও তন্ত্র সাধনার মূর্ত প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। এই প্রথা এক সুপ্রাচীন ও গাঢ় ঐতিহ্যে মোড়া, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত ও বিস্তৃত হয়েছে। কালী পুজোর প্রাচীন ঐতিহ্য, পৌরাণিক কাহিনি, এবং বিভিন্ন রূপ নিয়ে চলুন জানা যাক এই শক্তিময় দেবী সম্পর্কে।
কালী পূজার উৎপত্তি ও পৌরাণিক কাহিনি
পৌরাণিক শাস্ত্রে দেবী কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাকালে পৃথিবীতে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই ভয়ঙ্কর দৈত্যের ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছিল। দেবতারা তাদের কাছে পরাজিত হয়ে দেবলোকে স্থান হারিয়েছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক পুনরুদ্ধারের আশায় আদ্যাশক্তি মহামায়ার তপস্যা শুরু করেন। তখন দেবী তাঁদের অনুরোধ মেনে তাঁর শক্তি থেকে কৌশিকী নামে এক দেবীকে সৃষ্টি করেন, যিনি পরে কালী নামে পরিচিত হন। কালো বর্ণ ও রক্তবর্ণ জিভসহ এই দেবীর ভয়ঙ্কর রূপ অসুরদের পরাজিত করে বিশ্বে শান্তি ফেরায়। এই দেবীর মূর্তির সঙ্গে শক্তি ও সংহারশক্তির এক বিশেষ মিল পাওয়া যায়।
কালী পূজার প্রাচীন ও তান্ত্রিক ইতিহাস
কালী শব্দটির উৎপত্তি ‘কাল’ থেকে, যার অর্থ সময় বা অন্ধকার। দেবী কালী সেই সময়েরই এক শক্তিশালী প্রতীক, যাঁকে তন্ত্র মতে পূজা করা হয়। প্রাচীন তান্ত্রিক ধর্মের সাধকরা মা কালীর উপাসনা করতেন সাধনার মাধ্যমে শক্তি অর্জনের জন্য। নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক সাধক কৃষ্ণানন্দ প্রথম বাংলায় কালীমূর্তি পূজার প্রচলন করেন বলে জানা যায়। তাঁর আগে মূর্তির পরিবর্তে তাম্রপটে দেবীর ছবি এঁকে উপাসনা করা হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এরপর উনিশ শতকে জমিদার শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপুজোর ব্যাপক প্রসার ঘটে।
কালী দেবীর বিভিন্ন রূপ
শাস্ত্রে দেবী কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা রয়েছে, যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, চামুণ্ডা ও ছিন্নমস্তা। কালী পূজার বিভিন্ন রূপকে বিশেষ শক্তির প্রতীক হিসেবে মানা হয়। যেমন দক্ষিণাকালী দেবী শান্তিপূর্ণ, মাতৃত্বময় রূপ ধারণ করেন। আবার শ্মশানকালী, যাঁকে তান্ত্রিকরা পূজা করেন, তাঁর রূপ আরও ভয়ংকর ও সংহারকারী। মহাকাল সংহিতায় নব রূপের কালীর উল্লেখ রয়েছে – কাল কালী, কঙ্কাল কালী, চিকা কালী প্রভৃতি, যাঁরা নানাবিধ শক্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হন।
দেবী কালীর মূর্তির বৈশিষ্ট্য
দেবী কালীর মূর্তি সাধারণত চতুর্ভুজা, অর্থাৎ চার হাত বিশিষ্ট। এক হাতে খড়গ, অন্য হাতে অসুরের মুণ্ড এবং বাকী দুই হাতে বর ও অভয় মুদ্রা। দেবীর গলায় নরমুণ্ডের মালা, যা সংহারের প্রতীক। কালো বর্ণের মুখ থেকে রক্তবর্ণের জিভ বেরিয়ে থাকা মূর্তি দেবীর ভয়ংকর রূপকে নির্দেশ করে। তাঁকে শিবের বুকে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এই প্রতীকটি সংহারের পাশাপাশি শক্তির শ্রেষ্ঠত্বকেও নির্দেশ করে।
কালী পূজার সময় ও উপলক্ষ্য
কালীপুজোর সময়কালের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কার্তিক মাসের অমাবস্যার দিন দীপান্বিতা কালী পূজা। এছাড়া মাঘ মাসে রটন্তি কালী পূজা এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালী পূজাও অনুষ্ঠিত হয়। কিছু তান্ত্রিক অনুসারীরা প্রতি অমাবস্যায় বা বিশেষ সিদ্ধ তিথিতে দেবীর পূজা করেন। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মধ্যরাত্রিতে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজা করা হয়।
কালী পূজায় পশুবলি ও পুরাকালের নরবলি প্রথা
প্রাচীন কালে দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পশুবলির প্রচলন ছিল, যা আজও কিছু স্থানে পালন করা হয়। লুচি ও ফলের ভোগ তো আছেই, তবে কোথাও কোথাও আজও ছাগল বা মহিষ বলি দেওয়ার প্রচলন দেখা যায়। জানা যায়, অতীতে কিছু দস্যুবাহিনী দেবীকে সন্তুষ্ট করতে নরবলিও দিত। যদিও এই প্রথা এখন প্রায় বিলুপ্ত, তবে পশুবলি আজও কিছু জায়গায় প্রচলিত রয়েছে।
কালী পূজার জনপ্রিয়তা ও সামাজিক পরিবর্তন
কালী পূজা সময়ের সাথে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বাংলায়। অতীতে জমিদার ও ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বড় আকারে পূজার আয়োজন করা হত। কালী পূজার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধনেরও এক বিশেষ নিদর্শন দেখা যায়।
কালী পূজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
কালী পূজা শুধুমাত্র শক্তি পূজা নয়, এটি তন্ত্র, ভক্তি এবং শক্তির এক অপরূপ মিলন। দেবী কালী শুধু সংহারের দেবী নন, তিনি প্রকৃতির শক্তিরও মূর্ত প্রতীক। কালীপূজা এবং দেবী কালীর প্রতি ভক্তি মানুষকে প্রতিনিয়ত জীবনসংগ্রামে শক্তি জোগায় এবং নতুনভাবে সাহসী করে তোলে।