কয়েক মাস ধরেই তো ঝামেলাটা চলছে, কিন্তু দুদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়ামন্ত্রীর একটা নোটিশের পর থেকে আবার শঙ্কা জেঁকে ধরেছে দেশটির ক্রিকেটকে ঘিরে। গত বৃহস্পতিবার দেশটির ক্রীড়ামন্ত্রী নাথি এমথেনথেওয়া বলেছেন, দেশটির ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকার (সিএসএ) অর্থের জোগান বন্ধ করতে ও সিএসএ-র স্বীকৃতি কেড়ে নিতে যা করা সম্ভব তিনি তা-ই করবেন। নিজের ঘোষণাকে সরকারি প্রজ্ঞাপনের রূপ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশ করানোর চেষ্টা করবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন এমথেনথেওয়া।
প্রতিটি দেশের ক্রিকেট বোর্ড যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করে তা নিশ্চিত করতে আইসিসির একটা নিয়ম আছে। যেখানে বলা আছে সরকারের হস্তক্ষেপের ফল হতে পারে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা। সে কারণেই এমথেনথেওয়ার নোটিশের পর থেকেই শঙ্কা ঘিরে ধরেছে—অস্বিত্বের সংকটে পড়বে না তো দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট? আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তাদের নিষিদ্ধ করবে না তো আইসিসি? এই সব প্রশ্নের উত্তর বিশ্লেষণ করে কি পাও যাই? চলুন জানি:
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট কি এখানেই শেষ হয়ে যাবে?
হতে পারে, অন্তত আপাতত সেই সম্ভাবনাটা আছে। যদি মন্ত্রীর প্রস্তাবিত হস্তক্ষেপ অনুমোদন করে সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে সিএসএ আর আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকবে না, জাতীয় দলের দায়িত্বও তাদের কাছে থাকবে না।
তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার আর কোনো জাতীয় ক্রিকেট দল থাকবে না?
সম্ভাবনা তা-ই বলছে। সিএসএ-র যদি আর স্বীকৃতি না থাকে, সে ক্ষেত্রে এখন আমরা যেভাবে সবকিছু চলতে দেখে অভ্যস্ত তা-ও আর থাকবে না। (দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের প্রতিনিধি হিসেবে) আরেকটা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠিত হতেই পারে, তবে তেমন হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সেটিকে (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও আইসিসি—দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই স্বীকৃতি পেতে হবে।
সিএসএ না থাকলে দেশটিতে ক্রিকেট চালাবে কে?
নিয়ন্ত্রক সংস্থারই স্বীকৃতি না থাকলে কীভাবে কী হবে, সেটা বোঝা কঠিন। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো খেলায় এমনটা ঘটেনি। বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটও সর্বোচ্চ পর্যায়ে এমন কিছু দেখেনি।
এমনটা কেন হচ্ছে?
মূলত এর কারণ হচ্ছে প্রশাসকদের কেউ কেউ সিএসএ-তে নতুন বোর্ড গঠনের বিপক্ষে। যে বোর্ডে অধিকাংশই স্বাধীন সদস্য। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, সদস্য কাউন্সিলে রাজ্য অ্যাসোসিয়েশনগুলোর পাঁচজন সভাপতি আছেন, যাঁরা সিংহভাগ স্বাধীন সদস্য নিয়ে বোর্ড গঠনে রাজি নন। কেন রাজি নন, সে ব্যাখ্যা এখনো পুরোপুরি দেননি তাঁরা।
সদস্য কাউন্সিল কী?
সিএসএ-তে ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র আছে। ১. পরিচালকদের বোর্ড, যাঁরা গত বছর পদত্যাগ করেছেন এবং তাঁদের বদলে সরকার পরে অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড নিয়োগ দিয়েছে। ২. মেম্বারস কাউন্সিল, যেটা ১৪টি রাজ্যের সভাপতিদের নিয়ে গঠিত। প্রতিষ্ঠানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতা এই কাউন্সিলের। এই কাউন্সিলে থাকা কয়েকজন সভাপতি পদত্যাগ করা আগের বোর্ডেও ছিলেন, সেখান থেকে কয়েকজন নতুন বোর্ডেও থাকার কথা। প্যাঁচ লাগছে না তো?
এখানে বোঝার বিষয়, পদত্যাগ করা আগের বোর্ডে মেম্বারস কাউন্সিল থেকে প্রতিনিধি ছিলেন ৭ জন। সেই বোর্ডে স্বাধীন পরিচালক ছিলেন ৫ জন। নতুন করে বোর্ড গঠনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেখানে মেম্বার কাউন্সিল থেকে ৪ জন আর স্বাধীন পরিচালক ৭ জন রাখার কথা আছে।
সংক্ষেপে বললে, নতুন বোর্ডে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব কমে যাচ্ছে দেখে মেম্বারস কাউন্সিলের সদস্যরা খুশি হতে পারছেন না, ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চাইছেন—এমনটাই মনে হচ্ছে। নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কারণ তাঁরা নিজেদের অবস্থান তেমন একটা ব্যাখ্যা করেননি। তবে এখানে সম্ভবত এই তথ্য জানানো গুরুত্বপূর্ণ যে বোর্ডে থাকা সদস্যরা শুধু সভায় যোগ দেওয়ার জন্য বছরে ৪ লাখ ৫০ হাজার র্যান্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ২৬ লাখ টাকারও বেশি) করে আয় করেন, এর পাশাপাশি ম্যাচ দেখতে যাওয়ার মতো আরও সুবিধা তো আছেই।
এটা তো অনেক দিন ধরেই চলছিল না?
দৃশ্যত, চিরকালই চলে আসছে। লম্বা কাহিনিটা হচ্ছে, সব ঝামেলার শুরু হয়েছে ২০১৭ সালে টি-টোয়েন্টি গ্লোবাল লিগ ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে। যেটার কারণে সে সময়ের প্রধান নির্বাহী হারুন লরগাত সরে গেছেন। এরপর দৃশ্যপটে আগমন থাবাং মরোর, যাঁর অধীনে সিএসএ অনেক ঝামেলায় জড়িয়েছে। বড় ঝামেলাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, সম্প্রচারকদের সঙ্গে ঝামেলা, আরও অনেক প্রশাসনিক ঝামেলাও ছিল।
তদন্ত প্রতিবেদনে পরে বেরিয়েছিল যে বোর্ডের অর্থের অনেক বড় একটা অংশ মরো খরচ করেছিলেন অ্যালকোহল আর অন্য সেবাদানকারীদের পেছনে, যাঁরা শেষ পর্যন্ত সেবা দেননি। মরোকে এরপর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাঁকে নিয়োগ দেওয়া বোর্ডও পদত্যাগ করেছে (যদিও সেই বোর্ডের কয়েকজন এখনো মেম্বারস কাউন্সিলের অংশ, কারণ ওপরে বলা আছে সেটি)। কিন্তু মরোর মেয়াদে তৈরি হওয়া ঝামেলা এখনো আছে। সিএসএ খুব বাজে রকমের আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছে, যে অঙ্কটা কয়েক মিলিয়ন র্যান্ড হতে পারে।
জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য—দক্ষিণ আফ্রিকান স্পোর্টস কনফেডারেশন ও অলিম্পিক কমিটির হস্তক্ষেপে—দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়ামন্ত্রী নাথি এমথেনথেওয়া পুরো ব্যাপারটাতে হস্তক্ষেপ করেছেন। গত নভেম্বরে তিনি সিএসএ-তে একটা অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড বসিয়ে দিয়েছেন। অন্য অনেক কিছুর মধ্যে যে বোর্ডের দায়িত্ব ছিল সিংহভাগ স্বাধীন পরিচালক রেখে বোর্ড গঠনের কাঠামো তৈরি করা। সেটা করতে গিয়েই আজকের এই পরিস্থিতির জন্ম।