বারবার বলা হচ্ছে, এটা পুরো শক্তির অস্ট্রেলিয়া দল নয়। কারণ দলে নেই স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, অ্যারন ফিঞ্চ, প্যাট কামিনসদের মত বিশ্বখ্যাত তারকারা। ম্যাথু ওয়েডের নেতৃত্বে মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়ার হয়ে যারা খেলতে নামবেন, তাদের হাতেগোনা কয়েকজন (মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজলউড, মিচেল মার্শ, এডাম জাম্পা) ছাড়া বাকি সবার তারকা খ্যাতি, নাম ডাক, অভিজ্ঞতা আর ব্যক্তিগত দক্ষতা বেশ কম।
কাজেই যে দলটি এবার টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ঘরের মাঠে টাইগারদের প্রতিপক্ষ, তা অস্ট্রেলিয়ার সত্যিকার দলটির তুলনায় একটু হলেও দুর্বল, অভিজ্ঞতায়ও পিছিয়ে। কিন্তু তাদের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের নেতৃত্বে যে দলটি খেলবে, সেটা কি বাংলাদেশের সেরা দল? টাইগাররাও কি নিজেদের সেরা লাইনআপ নিয়ে পূর্ণশক্তিতে খেলতে নামবে?
নিশ্চয়ই না। দলে নেই তিনজন ফ্রন্টলাইন ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম আর লিটন দাস। কৃতিত্ব, অর্জন, আর পারফরম্যান্স বিবেচনায় যারা শুধু টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটই নয়, তিন ফরম্যাটেই টিম বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সম্পদ এবং ব্যাটিং নির্ভরতা।
অথচ ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজে এই তিনজনের সার্ভিস পাবে না বাংলাদেশ। কেউ কেউ তামিমের স্ট্রাইকরেট নিয়ে নেতিবাচক কথা বলেন। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের অন্যতম সেরা ওপেনার ও উইলোবাজ তামিম আসলে টিম বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সম্পদ। তার স্ট্রাইকরেট নিয়ে কটুক্তি করার চেয়ে দলে তার অবদান ও কার্যকরিতা কতটা? সেটাই সবার আগে দেখা দরকার।
পরিসংখ্যান জানাচ্ছে তামিমের টি-টোয়েন্টি স্ট্রাইকরেট হলো ১১৭.৪৭। কিন্তু তামিম যে টেস্ট, ওয়ানডের মতো এই ফরম্যাটেও বাংলাদেশের সফল পারফরমার, সবচেয়ে বেশি (৭৪ ম্যাচে ১৭০১) রান যে তামিমের, একমাত্র সেঞ্চুরিটিও তামিমের ব্যাট থেকেই এসেছে- সেটা জানেন কজনা?
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৮০ বাউন্ডারিও হাঁকিয়েছেন তামিম। বর্তমান অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের (৪৯) পর দ্বিতীয় সর্বাধিক ৪৪ ছক্কাও এসেছে তামিমের ব্যাট থেকে। এছাড়া সাকিবের (৯টি) পর বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তামিমই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ হাফসেঞ্চুরির মালিক।
কাজেই তামিম হচ্ছেন পরীক্ষিত পারফরমার। ইতিহাস বারবার সাক্ষী দিয়েছে, তামিম শুরুতে ভাল খেললে দলের শুরুটা ভালো হয়। ইনিংস একটা মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়ায়। পরের ব্যাটসম্যানরা নির্ভার থেকে ভয়-ডর ছাড়া নিজের স্বাভাবিক ব্যাটিং করতে পারেন। স্কোরলাইনও হয় মোটা তাজা।
সেখানে মিচেল স্টার্ক আর হ্যাজলউডের মত বিশ্বমানের ফাস্ট বোলারের বিপক্ষে এবার খেলতে হবে তামিমকে ছাড়া। ঐ দুই ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলারের বিপক্ষে নতুন বলে তামিমের চেয়ে সাহসী, অভিজ্ঞ, পরিণত, দক্ষ আর মাথা খাটিয়ে এক দিক ধরে রাখার পারফরমার আছেন কে?
এরপরেই চলে আসে মুশফিকুর রহিমের নাম। টেস্ট, ওয়ানডের মত টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও বাংলাদেশের তিন-চারজন সফল ব্যাটসম্যানের একজন মুশফিক। এই ফরম্যাটে মুশফিক করেছেন ৮৬ ম্যাচে ১২৮২ রান, স্ট্রাইকরেট আহামরি নয়; ১২০.০৩।
কিন্তু ইতিহাস জানিয়ে দিচ্ছে, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মরণীয় জয়টি এসেছে মুশফিকের হাত ধরে। সে ম্যাচে মুশফিক ২০০+ (২০৫.৭১) স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করে দল জিতিয়েছেন। যে ম্যাচে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল বিশাল, ২১৫ রানের।
দিনটি ছিল ২০১৮ সালের ১০ মার্চ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিদাহাশ ট্রফির ম্যাচে বাংলাদেশ ঐ রান টপকে পেয়েছিল অবিস্মরণীয় জয়। মুশফিক খেলেছেন তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস, ৩৫ বলে ৪ ছক্কা ও ৫ চারে অপরাজিত ৭২ রান।
ঐ একটি ইনিংসই শুধু নয়। দলের বিপদে, সংকটে আর প্রয়োজনে মুশফিকই সবচেয়ে বড় নির্ভরতা। তার পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এক কথায় দুর্দান্ত। প্রতিপক্ষ বোলারদের চেপে বসা অবস্থায় নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ঠান্ডা মাথায় দৃঢ়তার সঙ্গে দলের সব দায়দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে খেলায় মুশফিক অনন্য।
এজন্যই সংকটে, বিপদে মুশফিককেই ধরা হয় দলের ত্রাতা। মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজলউড আর অ্যাডাম জাম্পাদের নিয়ে সাজানো অসি ধারালো বোলিংয়ের বিপক্ষে মিস্টার ডিপেন্ডেবলকে মিস করছেন খোদ কোচ ডোমিঙ্গো আর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও।
সবশেষে আসা যাক, লিটন প্রসঙ্গ। তামিম ও মুশফিকের তুলনায় লিটনের ম্যাচ অনেক কম। এখনও পর্যন্ত খেলা ৩৩ ম্যাচের ৩২ ইনিংসে লিটনের সংগ্রহ ৬৪৬ রান, হাফসেঞ্চুরি চারটি, সর্বোচ্চ ৬১, স্ট্রাইকরেট ভাল; ১৩৪.০২। যা তামিম, সাকিব, মুশফিকদের চেয়েও বেশি।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখন লিটন পরিণত হয়ে গেছেন। তাকে ২২ গজে ব্যাট হাতে অনেক বেশি আস্থাশীল মনে হয়। হাতে সব ধরনের শটস খেলার ক্ষমতা আছে। কোয়ালিটি বোলিংয়ের বিপক্ষে মাথা তুলে দাঁড়াতে যে সাজানো, গোছানো ব্যাটিং শৈলি আর রকমারি শট খেলার সামর্থ্য দরকার, লিটনের তার পুরোটাই আছে। সে কারণেই লিটন এখন তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের অন্যতম নির্ভরতা। অসিদের বিপক্ষে তাই তারও অভাববোধ হবে।