পৃথিবী থেকে প্রয়াত ফুটবলার মোনেম মুন্না এত দূরে চলে গেছেন, যেখান থেকে আর ফিরে আসা যাবে না। তারপরও স্ত্রী সুরভী মোনেম এখনো নিজের অজান্তে বলে ওঠেন তুলে চলে এসো। স্ত্রী সুরভী মোনেম একেবারের তরতাজা একজন তরুণী থাকা অবস্থায় এক পুত্র আজমান সালিদ এবং এক কন্যা ইউসরা মোনেমকে কোলে তুলে দিয়ে ২০০৫ সালের এই দিনে পৃথিবী ছাড়েন মোনেম মুন্না। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ মুন্নার শুধু মৃত্যুবার্ষিকীই নয়, মুন্না-সুরভীর বিবাহ বার্ষিকীও।
ধানমন্ডির শেরেবাংলা রোডের ৪৯/এ নম্বরের বাড়ির সাততলায় ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটের দরজায় পা রাখলে চোখে পড়ে কালো প্লেটে সাদা অক্ষরে লেখা মোনেম মুন্না। মনে যাবে ফুটবলের কতশত স্মৃতির কথা। দেশ কাঁপানো ফুটবলার, কলকাতা কাঁপিয়েছেন। ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন। যে বছর খেলেননি সেবার ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবও চ্যাম্পিয়ন হয়নি। ১৯৯৪ সালে আবাহনী ছেড়ে সব তারকা ফুটবলার মুক্তিযোদ্ধায় চলে গেলেন মোটা অঙ্কের টাকার লোভে। থাকলেন আসলাম এবং মুন্না। একঝাঁক তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে দল গড়লেন আশরাফ উদ্দিন চুন্নু। লিগের প্রথম ম্যাচে আসলামকে মুন্না বললেন, ‘দাদা ওপরে আপনি মাথা ছোঁয়াবেন। আমি ডিফেন্স সামাল দেবো। ডিফেন্ড নিয়ে চিন্তা করবেন না। সব দায়িত্ব আমার। গোলকিপার এলেন ফকিরাপুল থেকে। নাম তার ধনু। আবাহনীর জার্সি গায়ে এক রাতে তারকা হয়ে গেলেন। ছিলেন পার্থ, সোহেল রেজা, হাসান আল মামুন প্রমুখ। আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। সেদিন আবাহনীকে বিপদে ফেলে যাওয়া ফুটবলারটি এখন আবাহনীর সবচেয়ে দরদি মানুষ হয়ে উঠেছেন। সর্বেসর্বা তিনি যা বলেন, তাই করতে বাধ্য সবাই।
মোনেম মুন্না কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন দিয়ে গেছেন। খেলোয়াড়ি জীবনে অসুস্থ হলেও তাকে মাঠে নামতে হতো অতিমাত্রায় পেইন কিলার ইনজেকশন শরীরে পুশ করে। এমনও হয়েছে জ্বরের শরীর, কঠিন ম্যাচ, পয়েন্ট নষ্ট হলে সর্বনাশ। সমর্থকদের আক্রমণ সামাল দেওয়া যাবে না। একাদশে নামার আগে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। জ্বর খুব একটা কমেনি। বিরতির সময় ড্রেসিং রুমে এসে আবার পেইন কিলার ইনজেকশন পুশ করিয়েছেন মুন্না। ভেতরে ভেতরে কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সেটা টের পাননি দেশের ফুটবলের কিংবদন্তি মোনেম মুন্না। ১৯৯৫ সালে যার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি জয় করেছিল। সেটি মিয়ানমার থেকে চার জাতি টুর্নামেন্টে। কোচ ছিলেন জার্মানির বিশ্বখ্যাত অটো ফিস্টার।
মুন্নার দুই সন্তান মানুষের মতো মানুষ হয়েছেন। বড় কন্যা ইউসরা মোনেম নরওয়েতে মাস্টার্স করছেন অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিকসে। আর ছেলে আজমান সালিদ পাবলিক রিলেশন বিষয়ে ইউ ল্যাবে পড়ছেন। দুজনের উচ্চতাই বাবার মতো। বাবা যখন মারা যান দুই সন্তান ছোট। কিছুই বুঝেন না। কোথাও গেলে বাবার পরিচয় দেন না। দিলে অনেক সম্মান পান বলছিলেন তার মা সুরভী মোনেম।
সামনে বসে সুরভী যখন কথা বলছিলেন দেখা গেল চোখের নিচে কালো দাগ। তার কণ্ঠে প্রতিটি কথায় মুন্নার ‘সুরভী’ ছড়ায়। এখনো তার জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে অনেক সাধনার মানুষ, মুন্না। ফুটবল খেলতো রকিব, এখন কানাডা প্রবাসী। সুরভীর আম্মার চাচাতো ভাই। রকিবের সঙ্গে আবাহনী ক্লাবে গিয়েছিলেন সুরভী। সংগ্রহ করেছিলেন মুন্নার আজিমপুরের ভাড়া বাসায় থাকা টিঅ্যান্ডটি ফোন নম্বর। মুন্নার সঙ্গে ফুটবলার জামরুল থাকতেন। সুরভী থাকতেন তার নানার বাসায়। ঘরে টিঅ্যান্ডটি ফোন ছিল। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে মুন্নাকে ফোন করতেন সুরভী। ছয় মাসের পরিচয়। তারপরও দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ে। মাত্র ১০ বছর সংসার করেছেন। তার পরই মুন্নার দুই কিডনি অকেজো। বোন কিডনি দিলেন। ভারতে গিয়ে সুস্থও হয়ে এলেন। তার পর আবাহনীর ম্যানেজারও হয়েছিলেন। কিন্তু মুন্না যেন কারো রোষানলে পড়ে মানসিক কৌশলে নির্যাতন শিকার হলেন, যেন ম্যানেজার পদ ছাড়তে মুন্না বাধ্য হন। মানসিক কষ্টে মুন্নার চিকিৎসা ফলোআপ এলোমেলো হয়ে গেলো। আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে বিছানায় চলে গেলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা তারকা।
দুই সন্তানকে বুকে আগলে এখনো জীবন বাঁচিয়ে রেখেছেন সুরভী। বাবা আব্দুল জলিল এবং মনিজা জলিল বারবার বলার পরও বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করেননি। বহুবার বিয়ের আমন্ত্রণ এলেও মুন্নার ছবি চোখে ভেসে ওঠায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। নিজের জীবনের স্বাদ আহলাদ, ইচ্ছা অনিচ্ছা, অনুরাগ ভালোবাসা সব কিছু কবর দিয়েছেন সুরভী। সন্তানদের সুখ নষ্ট হতে পারে, শান্তি নষ্ট হতে পারে সেই আশঙ্কায় মুন্নাহীন একাকী জীবনটা মুন্নাময় করে রেখেছেন সুরভী মুন্না।