Image default
খেলা

কেইন দেখালেন গার্দিওলার কী দরকার

একাধিক ভূমিকায় খেলতে পারেন, এমন খেলোয়াড় বড্ড পছন্দ পেপ গার্দিওলার।

যে কারণে যে বের্নার্দো সিলভাকে একদিন দেখা যায় রদ্রির পাশে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায়, সে বের্নার্দোই পরের দিন স্ট্রাইকারের ভূমিকায় নেমে পড়েন। একই কথা বলা যায় ফিল ফোডেন, রহিম স্টার্লিং, রিয়াদ মাহরেজ কিংবা কেভিন ডি ব্রুইনার বেলায়ও। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণভাগ—সব জায়গায় দেখা যায় তাঁদের বিচরণ। লেফটব্যাক হয়েও খেলার সময়ে মাঝমাঠে ‘প্লেমেকার’-এর ভূমিকায় চলে আসেন জোয়াও ক্যানসেলো। কারণ, কয়েক বছর ধরে গার্দিওলা তাঁদের সবাইকেই ভিন্ন ভিন্ন পজিশনে, ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে কীভাবে খেলতে হয়, শিখিয়েছেন।

এমন একজন কোচ হ্যারি কেইনের মতো খেলোয়াড়কে পছন্দ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। হ্যারি কেইন যে কেবল ডি-বক্সের মধ্যে বসে থাকা গৎবাঁধা কোনো ইংলিশ স্ট্রাইকার নন। বরং তিনি এমন একজন খেলোয়াড়, যিনি আক্রমণভাগের যেকোনো জায়গায় খেলার পাশাপাশি দলের কৌশল বাস্তবায়নে মাঝমাঠেও নেমে আসেন। নেমে এসে ওপরে উঠে যাওয়া হিউং মিন সনদের উদ্দেশে পাঠান মাপা বল।

আগুয়েরো-পরবর্তী সময়ে টটেনহামের এই ইংলিশ স্ট্রাইকারের পেছনে গার্দিওলার ঘোরার খবর কারোরই অজানা নয়। দুদিন আগে গার্দিওলা নিজেই স্বীকার করেছেন, গত গ্রীষ্মে কেইনের জন্য তিন-চারবার প্রস্তাব পাঠিয়েও টটেনহামের মন গলাতে পারেননি।

শেষমেশ কোনো স্ট্রাইকারই কেনেননি গার্দিওলা। স্ট্রাইকারহীন সিটিই কোনো দিন মাহরেজ-দি ব্রুইনা, কোনো দিন ফোডেন-ক্যানসেলো, কোনো দিন আবার স্টার্লিং-বের্নার্দোদের গোলে পার পেয়ে যাচ্ছিল! গার্দিওলা এমন একটা পদ্ধতি বের করেছিলেন, যাতে অন্তত এ মৌসুমে সিটির কোনো প্রথাগত স্ট্রাইকারের দরকার না হয়। সে কারণেই কিনা গত জানুয়ারিতে কেইনকে দলে আনার ব্যাপারে কোনো আগ্রহই দেখাননি গার্দিওলা। বরং আর্জেন্টিনার তরুণ স্ট্রাইকার হুলিয়ান আলভারেজের সঙ্গে চুক্তি করে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেইনকে আর দরকার নেই।

কিন্তু মাসের পর মাস যদি স্ট্রাইকার ছাড়াই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগে পার পাওয়া যেত, তাহলে স্ট্রাইকার নামের এ গোত্রই তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত ইংল্যান্ডের মাটি থেকে। কেইন, রোনালদো কিংবা লুকাকুদের খেলার জন্য খুঁজতে হতো মাঠের অন্য কোনো জায়গা। অনেকটা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিখ্যাত মিডফিল্ডার পল স্কোলস বা জার্মানির কিংবদন্তি ডিফেন্ডার ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের মতো হয়ে যেত ব্যাপারটা, যাঁরা ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ফরোয়ার্ড বা স্ট্রাইকার হিসেবে, কিন্তু দলের কৌশল ও অন্য সতীর্থদের কারণে পরে স্থান পেয়েছিলেন মাঝমাঠে বা রক্ষণে।

বাস্তবতা এটিই, ফুটবলে স্ট্রাইকারের ভূমিকা এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেটি ইংল্যান্ডে হোক বা অন্য কোনো দেশ। সেটিই যেন হ্যারি কেইন গত রাতে গার্দিওলার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কিংবা কে জানে, হয়তো তাঁর পেছনে জানুয়ারিতে ম্যানচেস্টার সিটি টাকা ঢালল না কেন, মাঠের খেলায় সে রাগই ঝাড়লেন গার্দিওলার ওপর! সিটিতে যাওয়ার ব্যাপারে কেইনের আগ্রহের কথা কে না জানেন!

ম্যাচে তিন গোল করেছে টটেনহাম। নিজেদের মাঠে দুটির বেশি গোল করতে পারেনি গার্দিওলার সিটি। তিন গোলের মধ্যে দুটি করেছেন কেইন নিজে, বাকি একটা গোল বানিয়ে দিয়ে আবারও বুঝিয়েছেন, গৎবাঁধা ইংলিশ স্ট্রাইকারের মতো শুধু গোল করা নয়, করাতেও পারেন তিনি। ম্যাচটা ছিল দুই কোচের দুই ভিন্নধর্মী কৌশলের লড়াইও।

কিন্তু আগে গোল খেয়ে বসলে? সমস্যাটা বাধে এখানেই। এ মৌসুমে সিটি যতগুলো ম্যাচে হেরেছে বা ড্র করেছে, প্রতিটা ম্যাচেই আগে গোল হজম করেছে। লিগে নিজেদের প্রথম ম্যাচে এই টটেনহামের কাছেই শুরুতে গোল খেয়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। লিগে লিভারপুল, ক্রিস্টাল প্যালেস, সাউদাম্পটন কিংবা চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসজি, লাইপজিগ—প্রতিটা ম্যাচেই একই ধারা চলেছে। শুরুতে গোল খেলে খেই হারিয়ে ফেলে সিটি। ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। সেটিই স্বাভাবিক নয় কি! সিটির যে প্রথাগত স্ট্রাইকারই নেই।

ম্যাচের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে মিডফিল্ডারদের স্ট্রাইকার হিসেবে খেলানো গেলেও স্ট্রাইকারদের সহজাত যে গুণ, সেটা স্বাভাবিকভাবেই সিটির মিডফিল্ডারদের নেই। যে কারণে এক গোল খেয়ে পিছিয়ে গেলেও বাকি সময়টায় প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভাঙতে পারে না তারা। যে সমস্যা দেখা দিয়েছে কালকেও।

কখনো বের্নার্দো সিলভা, কখনো বা ফিল ফোডেন মূল স্ট্রাইকার হিসেবে অবস্থান নিলেও ৩-৪-৩ ছকে টটেনহামের দুই সেন্টারব্যাক আর্জেন্টিনার ক্রিস্টিয়ান রোমেরো ও এরিক ডায়ারকে ঠিকভাবে প্রেস করতে পারছিলেন না। গার্দিওলা চেয়েছিলেন, ৪-২-৩-১ ছকে সামনে কখনো বের্নার্দো বা কখনো ফোডেনকে রেখে টটেনহামের রক্ষণভাগকে ভালোভাবে প্রেস করে বল কেড়ে নিতে। দুজনের কাউকে দিয়েই কাজটা ভালোভাবে করানো যায়নি।

তিন সেন্টারব্যাকের মধ্যে রোমেরো আর ডায়ারকে মাঝে রেখে ডেভিস অনেকটা লেফটব্যাক হয়ে যাচ্ছিলেন। ডেভিসের সামনে ছিলেন সেসেনিওন ও সন। ফোডেন-বের্নার্দোর ঠিকভাবে প্রেস না করার কারণে রোমেরো বা ডায়ার সহজেই বল পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন ডেভিসকে। টটেনহামের দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার পিয়েরে-এমিল হইবিয়া ও রদ্রিগো বেনতাঙ্কুরের মধ্যে ডি ব্রুইনা যেন খেই হারিয়ে না ফেলেন, সে কারণে ডান উইংয়ে খেলা স্টার্লিং মাঝে চলে এসেছিলেন, ফলে টটেনহাম বাঁ প্রান্ত দিয়ে বাঁদিকের সেন্টারব্যাক বেন ডেভিস আর বাঁ দিকের উইংব্যাক রায়ান সেসেনিওনের সাহায্যে সহজেই বলের জোগান দিচ্ছিলেন কেইনকে, যে কেইন স্ট্রাইকার হওয়া সত্ত্বেও বারবার নিচে নেমে গোল বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কেইনকে নিচে নামতে দেখে ওপরে উঠে যাচ্ছিলেন সন। তাঁকে দেখে দেখে রাখা পর্তুগিজ সেন্টারব্যাক রুবেন দিয়াসকে গতির খেলায় বেশ ভালোই পরাস্ত করেছেন সন।

সাধারণত প্রতিপক্ষ রক্ষণে চারজন রাখলে আক্রমণ করার সময় গার্দিওলা তিন ফরোয়ার্ডের পাশাপাশি লেফটব্যাক ক্যানসেলো আর মাঝমাঠ থেকে একজনকে ওপরে এনে ৩-২-৫ ছকে পাঁচজন দিয়ে আক্রমণ রচনা করেন। এ ম্যাচে চারজন নন, টটেনহামের রক্ষণে নেমে যাচ্ছিলেন পাঁচজন, যাঁরা সিটির আক্রমণে উঠে যাওয়া পাঁচজনকে দেখে দেখে রাখছিলেন।

যে কারণে বের্নার্দো, ফোডেন, ক্যানসেলো, ডি ব্রুইনা ও স্টার্লিংয়ের পাশাপাশি এ ম্যাচে মাঝমাঠ থেকে গুনদোয়ানও ওপরে চলে যাচ্ছিলেন। গুনদোয়ানকে ওপরে তোলার কৌশলে আরেকটু হলেই কাজ হয়ে যাচ্ছিল, ২০ মিনিটের দিকে এই জার্মান মিডফিল্ডারের একটি শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। টটেনহাম সেভাবে প্রেস করছিল না, তাই আপাতদৃষ্টে মনে হয়নি, সিটির কোনো সমস্যা হতে পারে।

এখানেই যথারীতি জাদু দেখিয়েছেন কন্তে। সিটির চাপ সহ্য করে রক্ষণ থেকে হুট করে প্রতি-আক্রমণে উঠে যাওয়ার ব্যাপারে হ্যারি কেইন ও দেয়ান কুলুসেভস্কির গোল বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ও হিউং মিন সনের গতিকে কাজে লাগিয়েছেন পুরোদমে। প্রথম গোলটা এভাবেই এসেছে। গুনদোয়ান ওপরে উঠে যাওয়ার কারণে আক্রমণে সিটির ৩-২-৫ ছকটা অনেকটা ৩-১-৬ হয়ে যাচ্ছিল। মাঝমাঠে রদ্রি একা হয়ে পড়ছিলেন, আবার কেইনও নেমে আসছিলেন।

কুলুসেভস্কির কথা না বললেই নয়। কাগজে-কলমে এ ম্যাচে তাঁকে উইংয়ে খেলানো হলেও সেভাবে সাইডলাইন বরাবর অবস্থান নিচ্ছিলেন না তিনি। সিটির লেফটব্যাক জোয়াও ক্যানসেলোর এমনিতেই মাঝমাঠে চলে আসার স্বভাব আছে, তাঁকে দেখে রাখতে গিয়ে, কুলুসেভস্কিরও সুবিধা হয়েছে। মাঝখানে চলে এসে সামনে কেইন আর সনকে উঠে যাওয়ার লাইসেন্স দিচ্ছিলেন মাঝেমধ্যেই।

মোটামুটি পুরো ম্যাচে এ ফর্মুলা দেখা গেছে। দরকার হলে কেইন ওপরে উঠে গোল করছিলেন, আবার দরকার হলে সিটির ভঙ্গুর রক্ষণের সুবিধা নিয়ে নেমে বল বানিয়েও দিচ্ছিলেন। দ্বিতীয় কাজটা সিটির মিডফিল্ডাররা ভালো করতে পারলেও প্রথম কাজটা করতে গিয়ে গত রাতে বেশ সমস্যায় পড়েছেন। পাকা গোলশিকারির মতো ওত পেতে থাকার ক্ষমতা তো সবার থাকে না!

আর গার্দিওলাও বুঝেছেন, ম্যাচ জেতার জন্য মাঝেমধ্যে কেইনের মতো স্ট্রাইকারেরও দরকার হয়।

Related posts

বাফেলো ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ফুটবল খেলোয়াড়রা চামড়ার জোতা দিয়ে একটি তরুণ পুডলকে পেটানোর অভিযোগে জেলের মুখোমুখি হচ্ছেন

News Desk

দেম্বেলেকে আর ভালো প্রস্তাব দেবে না বার্সেলোনা

News Desk

হ্যারিসন বাটকারের ‘বুলশিট’ স্নাতক বক্তৃতা ‘দ্যা হ্যান্ডমেইডস টেল’-এর মতো: তার প্রাক্তন চিফ সতীর্থের স্ত্রী

News Desk

Leave a Comment