ইউরো কাপের প্রথম সেমিফাইনালে জমজমাট লড়াই উপহার দিলো স্পেন ও ইতালি। যেখানে টাইব্রেকারে গিয়ে শেষ হাসি হাসল ১৯৬৮ সালের চ্যাম্পিয়ন ইতালি। ইউরো কাপের সর্বোচ্চ তিনবারের চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে হারিয়ে চতুর্থবারের মতো ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করল আজ্জুরিরা।
লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে হওয়ার ম্যাচটিতে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ১-১ গোলে ছিল সমতা। পরে অতিরিক্ত যোগ করা সময়েও গোল করতে পারেনি কোনো দল। যার ফলে দ্বারস্থ হতে হয় টাইব্রেকারের। যেখানে ৪-২ ব্যবধানে জিতে ম্যাচের ফল নিজেদের পক্ষে টেনে নিয়েছে ইতালি।
যার ফলে প্রথমবারের মতো কোনো মেজর টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে গিয়ে ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হলো স্পেন। এর আগে ইউরোতে চারবার ও বিশ্বকাপে একবার সেমিতে উঠে ফাইনালের টিকিটও কেটে ফেলে তারা। অন্যদিকে দশমবারের মতো মেজর টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠল চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও একবারের ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালি।
টাইব্রেকারে প্রথম শট নিতে আসেন ইতালির ম্যানুয়েল লোকাতেলি। ডানদিকে ঝাপিয়ে সেই শট ঠেকান স্পেনের গোলরক্ষক উনাই সিমন। ফলে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আসে স্পেনের সামনে। কিন্তু সারা ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা দানি ওলমো টাইব্রেকারের শটটি মারেন বারের অনেক ওপর দিয়ে।
দুই দলই প্রথম শট মিস করায় টাইব্রেকারে তখন সমতা। দ্বিতীয় শট মিস করেননি ইতালির আন্দ্রে বেলোত্তি ও স্পেনের জেরার্ড। তৃতীয় শটেও জালের ঠিকানা খুঁজে নেন লেওনার্দো বনুচ্চি (ইতালি) ও থিয়াগো আলকান্তারা (স্পেন)। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে চতুর্থ শটে গিয়ে।
ইতালির পক্ষে চার নম্বর শট নিতে এসে কোনো ভুল করেননি ফেডরিখ বার্নার্দেস্কি। স্পেনের হয়ে চতুর্থ শট নেয়ার দায়িত্ব বর্তায় মূল ম্যাচের গোলস্কোরার আলভারো মোরাতার কাঁধে। তার নেয়া দুর্বল শট বামে ঝাঁপিয়ে সহজেই ঠেকিয়ে দেন স্প্যানিশ গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি ডনারুম্মা।
ফলে চতুর্থ শট শেষে টাইব্রেকারের অবস্থা দাঁড়ায় ইতালি ৩ – ২ স্পেন। পঞ্চম শটে গোল করলেই মিলবে জয়- এ কথা মাথায় রেখে শট নিতে আসেন জর্জিনহো। দারুণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নেয়া শটে উনাই সিমনকে ডানে পাঠিয়ে বাম দিক দিয়ে সহজেই গোল করেন জর্জিনহো। ইতালি পেয়ে যায় ফাইনালের টিকিট।
মজার বিষয় হলো, ২০১২ সালের আসরে ইতালিকে ফাইনালে ৪-০ গোলে উড়িয়ে নিজেদের তৃতীয় শিরোপা জিতেছিল স্পেন। এরপর ২০১৬ সালের আসরে ইতালির কাছে হেরেই দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। এবার সেমিফাইনালে আজ্জুরিদের মুখোমুখি হয়েই বিদায়ঘণ্টা বাজল লা রোজাদের।
টাইব্রেকার রোমাঞ্চের মূল ম্যাচের ৬০ মিনিটের সময় প্রথম গোলটি করে ইতালি। সিরো ইম্মোবিলের পাস থেকে দলকে আনন্দে ভাসান ফেডরিক কিয়েসা। এর ঠিক ২০ মিনিট পর দানি ওলমোর এসিস্টে গোল করেন আলভারো মোরাতা। পরে টাইব্রেকারে গিয়ে এ দুজনই মিস করেন নিজেদের শট। যার মাশুল দিয়ে হারতে হয়েছে ম্যাচ।
অথচ ম্যাচের প্রথমার্ধে ইতালিকে রীতিমতো পাড়ার দল বানিয়ে নাচিয়েছিল লুইস এনরিকের শিষ্যরা। প্রথম ৪৫ মিনিটে একটি শটও লক্ষ্যে রাখতে পারেনি রবার্তো মানচিনির দল। দুই-তৃতীয়াংশ সময় বলে দখল নিজেদের কাছেই রেখেছিল তিনবারের চ্যাম্পিয়নরা। গোলের খোঁজে শট নিয়েছিল ৫টি। যদিও সাফল্য মেলেনি।
ম্যাচে বলার মতো প্রথম সুযোগটা তৈরি করেছিল ইতালি। মাত্র চার মিনিটের মাথায় এমারসনের পাস থেকে স্পেনের গোলরক্ষক উনাই সিমনকে ফাঁকায় পেয়ে যান নিকোলো বারেল্লা। সিমনকে পরাস্ত করলেও তার শট গিয়ে লাগে দূরের পোস্টে। অবশ্য এর আগে অফসাইডে ধরা পড়ায় সেটি আক্রমণ হিসেবে ধরা হয়নি।
প্রথম সত্যিকারের সুযোগ পেয়েছিলেন স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড মিকেল ওয়ারজাবাল। ম্যাচের ১৩ মিনিটের সময় তরুণ মিডফিল্ডার পেদ্রির পাস থেকে ডি-বক্সে ফাঁকায় বল পেয়েছিলেন ওয়ারজাবাল। কিন্তু বল রিসিভ করতে গিয়ে গড়বড় পাকিয়ে সেই সুযোগটি হারান রিয়াল সোসিয়েদাদের এ ফরোয়ার্ড।
মিনিট দশেক পর ফের দৃশ্যপটে ওয়ারজাবাল। এবার তিনি বল বাড়িয়ে দেন দানি ওলমোর উদ্দেশ্যে। এ সেন্টার ফরোয়ার্ডের প্রথম শট ব্লক করেন ইতালির কিংবদন্তি ডিফেন্ডার লেওনার্দো বনুচ্চি। ফিরতি শট দুর্দান্ত ক্ষিপ্রতায় ফিরিয়ে দেন ইতালির গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি ডনারুমা। প্রথমার্ধে এটিই ছিল দুই দলের সবচেয়ে জোরালো আক্রমণ।
প্রথমার্ধের একদম শেষ মিনিটে গিয়ে গোলের উদ্দেশ্যে প্রথম শটটি করতে পারে ইতালি। তবে এমারসনের সেই শট ফিরে আসে ক্রসবারে লেগে। ইউরো কাপে প্রায় ২১ বছর পর প্রথম শটের জন্য এত লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হলো তাদের। ২০০০ সালে ইউরোতে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৪৮ মিনিটে গিয়ে প্রথম শট নিয়েছিল ইতালি।
শুরুর ৪৫ মিনিটে রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়া ইতালি ঘুরে দাঁড়ায় দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই। যার সুফল পেতে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি তাদের। ম্যাচের ৬০ মিনিটের সময় দারুণ এক কাউন্টার অ্যাটাক থেকে ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন ফ্রেডরিখ কিয়েসা।
সেই আক্রমণটি শুরু হয় গোলরক্ষক ডনারুম্মার দ্রুত বল ছাড়ার মাধ্যমে। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে স্পেনের রক্ষণে ঢুকে পড়েন সিরো ইম্মোবিল, কিয়েসারা। ডি-বক্সের মাথায় এমেরিক লাপোর্তে থামানোর চেষ্টা করেছিলেন বটে। তবে পড়ে গিয়েও কিয়েসার উদ্দেশ্যে বল এগিয়ে দেন ইম্মোবিল।
ডি-বক্সের ভেতর থেকে বাঁকানো শটে উনাই সিমনকে পরাস্ত করেন কিয়েসা। এই শটটি তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি স্পেনের গোলরক্ষক। লিড নেয়ার পরপরই এই গোলের এসিস্টদাতা ইম্মোবিলকে তুলে নেন ইতালির কোচ রবার্তো মানচিনি।
দুর্দান্ত খেলতে থাকা স্পেন গোল হজম করার পর নতুন উদ্যমে শুরু করে আক্রমণ। তবু সমতাসূচক গোল পেতে অপেক্ষা করতে হয় আরও ২০ মিনিট। পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা উপহার দেয়া দানি ওলমোর ডিফেন্সচেরা পাস থেকে ডনারুম্মাকে বোকা বানিয়ে স্পেনকে সমতায় ফেরান মোরাতা।
পরে নির্ধারিত সময়ে আর গোলের দেখা পায়নি দুই দল। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটে। মূল ম্যাচের মত এখানেও আধিপত্য বিস্তার করে খেলে স্পেন, সম্ভাবনা জাগায় একাধিক গোলের। কিন্তু কোনোটিই শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। আর এরপর টাইব্রেকারে গিয়ে বিদায়ঘণ্টাই বেজে গেল তাদের।
আগামী রোববার বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ১টায় ইউরো কাপের দ্বিতীয় শিরোপার লক্ষ্যে ফাইনাল খেলতে নামবে ইতালি। তাদের প্রতিপক্ষ হবে ইংল্যান্ড ও ডেনমার্কের মধ্যকার দ্বিতীয় সেমিফাইনাল জয়ী দল।