দশরথের সবুজ গালিচায় নতুন ইতিহাস লেখার হাতছানি ছিলো ওদের সামনে। সাফের নতুন চ্যাম্পিয়ন হয়েই সেই ইতিহাসে তুলির শেষ আঁচড় দিয়েছে বাংলার বাঘিনীরা। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের মহারণে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সেরার মুকুট মাথায় তুলেছে সানজিদা-মারিয়ারা।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলে শত প্রতিকূলতা, শত বাঁধার দেয়াল পেরিয়েই আজকের সাফল্যের ছোঁয়া। সাবিনা-সানজিদাদের গল্পটা আপনাদের কম বেশি সবারই জানা। হাটি হাটি পা পা করে চলতে শুরু করা এই মেয়েরাই লাল সবুজের ফুটবলে এনেছে নতুন ভোর। কলসিন্দুরের সেই ছোট্ট গ্রাম থেকেই যে গল্পের শুরু, সেখান থেকে আজকের সাফের রানি। দীর্ঘ এই পথটা পাড়ি দিতে নিজেদের জীবনে সংগ্রামের একেকটি অধ্যায় নতুন করে লিখেছেন বাংলার মেয়েরা।
বাংলার নারী ফুটবলের সঙ্গে যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার বাংলাদশের সীমান্তঘেষা ছোট্ট গ্রাম কলসিন্দুরের নাম। গারো পাহাড়র পাদদেশে অবস্থিত অজোপাড়া গাঁ কলসিন্দুরের সেই মাঠ ঘাট পেরিয়েই সানজিদা-মারিয়া মান্ডারা মাটিতে এসেছে সাফের মঞ্চ। হিমালয়ের চূড়ায় তুলেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে। তাদের এই অর্জনে আজ কেমন আছে সেই ছোট্ট কলসিন্দুর? কেমনই বা বোধ করছেন এইসব সোনার মেয়েদের গড়ে ওঠার দিনগুলোতে পেছন থেকে এগিয়ে আসা কলসিন্দুরের মানুষগুলো?
যেই কলসিন্দুর থেকে উঠে আসা একঝাক কিশোরী আজ লাল-সবুজের জার্সি গায়ে সবুজ মাঠে ফুটবলের সুর তুলছেন, সেখানে আজও প্রায় উৎসবের উপলক্ষ্য আসে সেই সোনার মেয়েদের খেলা থাকলেই।
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের কোন খেলা থাকলে অধীর আগ্রহ নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়েন কলসিন্দুরের মানুষ। ব্যাতিক্রম ঘটেনি সাফের ফাইনালেও।
দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইকে সামনে রেখে কলসিন্দুর বাসীর মনে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বিকাল ৪ টা থেকে ভক্ত সমর্থকদের মাঝে খেলা নিয়ে আলোচনা
শুরু হয়। প্রথম দিকে বিদ্যুৎ না থাকায় কিছুটা হতাশ হলেও পরে বিদ্যুৎ আসায় আনন্দের সঙ্গেই খেলা দেখেন তারা।
অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে মেয়েরা জয় এনে দিয়েছে বাংলাদেশকে। এই জয়েই কলসিন্দুলের ফুটবল কন্যাদের ঘরে ঘরে যেন ঈদের আনন্দ।
সন্তানের জয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মিডফিল্ড তারকা সানজিদার বাবা বলেন, ‘বাংলাদেশ জয় লাভ করায় সানজিদার বাবা হিসেবে আমি গর্বিত।’
কলসিন্দুরের এই মেয়েদের কোচ জুয়েল মিয়া বলেন, ‘কলসিন্দুরের অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে ক্ষুদে ফুটবলারদের নিয়মিত অনুশীলন চলছে।’
কলসিন্দুর নারী ফুটবল টিমের ম্যানেজার মালা রানী সরকার বলেন, ‘জতীয় নারী ফুটবল দলে কলসিন্দুররের মেয়েরা খেলছে এটা অত্যন্ত গর্বের,আশাকরি আগামীদিনে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে আরোও ভালো খেলা উপহার দিবে। ছেলেদের ফুটবল যখন একের পর এক ব্যর্থতায় ধুঁকছে,ঠিক তখনই উত্তান হয়েছে নারী ফুটবলের। আর সেই দলের বেশিরভাগ খেলোয়ার ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুরের।’
মালা রানী আরও বলেন, ‘গারো পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কলসিন্দুরসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে উঠে এসেছে এসব কিশোরী ফুটবলার। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা দিয়ে শুরু করে বিশ্ব জয়ের দ্বারপ্রান্তে এই কিশোরী মেয়েরা দেশের হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট জিতে দেশের মুখ উজ্জল করেছে অদম্য এই কিশোরীরা। তাদের বদৌলতে সরকারীকরণ হয়েছে কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মেয়েদেরকে সংবর্ধনাসহ আর্থিক অনুদান দিয়েছেন।’
কলসিন্দুরের এইসব অদম্য মেয়েদের জীবনসংগ্রামের গল্প উঠে এসেছে একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের “দ্য আনবিটেন গার্লস(অপরাজিত মেয়েরা)” পাঠে। গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা কিশোরীদের সফলতার গল্প লেখা হয়েছে এই পাঠে। সানজিদা,মারিয়া,তহুরা,শামসুন্নাহার,শিউলি আজিম,নাজমা আক্তার,মার্জিয়া আক্তারদের জিবনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বইয়ের পাতায়। এদের মাঝে সানজিদা আক্তারের এশিয়া মহাদেশের সপ্তম স্থান অধিকার করা ,মারিয়া মান্ডার অধিনায়ক হয়ে ওঠা এবং তহুরা খাতুনের আর্ন্তজাতিক সর্বোচ্চ গোলাদাতা হওয়া নিয়ে সচিত্র পাঠ রয়েছে। রয়েছে মেয়েদের পাশে থেকে উৎসাহ এবং সহযোগিতা করে তাদের সামনে এগোনোর সাহস জোগানো মালা রাণী সরকার এবং বর্তমান মেয়েদের কোচ জুয়েল মিয়ার নাম।
তবে কলসিন্দুরের এই মেয়েদের শুরুর পথটা কিন্তু খুব সহজ ছিলো না। মেয়েরা ফুটবল খেলবে এটাই ছিল অসম্ভব। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিনতী রাণী শীল ও সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিন
বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে ২০১৩,২০১৪, এবং ২০১৫ সালে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে ক্ষুদে মেয়েরা। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি সানজিদাদের।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফৌজিয়া নাজনীন জানান, ‘কলসিন্দুরের মেয়েদের সফলতার ধারাবাহিকতা যেন অব্যহত থাকে। তাদের মঙ্গল কামনা করি এবং খেলাধুলার পাশাপাশি পড়ালেখায় ভালো করুক সেই প্রত্যাশাও রইলো।’