গুজরাটের বিপক্ষে রাজস্থানের ইনিংসের শেষ ওভার চলছে। হার্দিক পান্ডিয়া ৮৭ রান করে ইনিংসে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হিসেবে ছাড়িয়ে যান জশ বাটলারকে। ততক্ষণ পর্যন্ত অরেঞ্জ ক্যাপের অধিকারী বাটলারকে এরপর ক্যামেরা খুঁজে নিলে দেখা যায়, বাটলারের মাথা থেকে সেই সর্বোচ্চ রানের পরিচায়ক অরেঞ্জ ক্যাপ গায়েব। বাটলার হয়তো নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, আবার সেটি অর্জন করেই তবে মাথায় দেবেন। ওই ওভারটায়ই শুধু অরেঞ্জ ক্যাপটা তাঁর মাথায় থাকেনি। ব্যাট হাতে এরপর নেমেই যে-ই ‘অর্জন’ করেছেন, এখন পর্যন্ত তা আর তার মাথা থেকে নামেনি।
একবছর আগের এই দিনেই বাটলারের সেঞ্চুরি সংখ্যা কত ছিল জানেন? শূন্য। গেল এক বছরের মধ্যেই ইংরেজ তারকা করেছেন পাঁচ সেঞ্চুরি। আইপিএলে শেষ আট ইনিংসের চারটিই সেঞ্চুরির রুপ পেয়েছে। আরেকটি সেঞ্চুরি এসেছিল বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। আর এবারের আইপিএলে তো বাটলার স্রেফ পাগলামিই শুরু করে দিয়েছেন! অন্য কেউ যেখানে তিন শ রানের কোটায়ও পৌঁছতে পারেননি, তিনি সাত ম্যাচে করে ফেলেছেন ৪৯১ রান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার্দিক পান্ডিয়ার ২৯৫ রান, আর বাটলারের শুধু বাউন্ডারি থেকেই এসেছে ৩৫৬ রান।
বাটলার বাদে আইপিএলে চারটি বা তার বেশি শতক আছে আরও চারজনের। ওয়ার্নারের চার সেঞ্চুরি ১৫৫ ইনিংসে। স্বদেশি ওয়াটসনেরও থেমে যাওয়া ক্যারিয়ারে সমান সংখ্যক সেঞ্চুরি ১৪১ ইনিংসে। বিরাট কোহলির ২০৬ ইনিংসের পাঁচটিই সেঞ্চুরি ছুঁয়েছে। আইপিএলে সবচেয়ে বেশি শতক রয়েছে ক্রিস গেইলের, ১৪১ ইনিংসে তার সেঞ্চুরি সংখ্যা ছয়। এবারের আইপিএলে সাত ম্যাচে তিন সেঞ্চুরির আগে গেলবারেও বাটলার করেছিলেন এক সেঞ্চুরি। মাত্র ৭১ ইনিংসেই তাই আইপিএলে চারটি শতক হয়ে গেছে তার।
এই আইপিএলে তো জশ বাটলার একটা মেশিনই হয়ে গিয়েছেন, রান মেশিন। ছিনিমিনি খেলা বলতে যা বুঝায়, তাই যেন বুঝানোর দায়িত্ব তিনি নিয়ে ফেলেছেন। যা ব্যাটিং করছেন, প্রতিপক্ষের বুকে সত্যিকার অর্থেই কাঁপন ধরিয়ে দিবে। তবে সেই ‘ভয়ঙ্কর’ বাটলারই আবার খুব হিসাবী ও স্মার্ট!
শুরুর কয়েক ওভারে যখন পেসাররা চলতি আইপিএলে সুইং পেয়ে ব্যাটারদের হুমকির কারণ হচ্ছেন, সেসময়টা খোলসবন্দী হয়ে পার করে দিতেও আপত্তি নেই বাটলারের। লক্ষনৌর বিপক্ষে ম্যাচে আউট হয়ে গিয়েছিলেন ১৩ বলে ১১ রানে। আর গুজরাটের বিপক্ষে ম্যাচেই শুধু রাজস্থান লক্ষ্যতাড়ায় নেমেছিল। সে ম্যাচে ১৯৩ রানের টার্গেটে বাটলার প্রথম ওভার থেকেই চড়াও হয়ে খেলেছিলেন ২৪ বলে ৫৪ রানের বিধ্বংসী ইনিংস।
এই দুই ম্যাচ বাদে প্রতিটি ম্যাচেই বাটলারের শুরুটা হয়েছে ধীরগতিতে। প্রথম তিন ওভারে তাঁর স্ট্রাইক রেট তাই ১০৭, গুজরাট ম্যাচটা বাদ দিলে যা নেমে হয়ে যায় ৮৫! সময় গেলে ‘বাটলার’ নামক এই ইঞ্জিন অবশ্য বেশ দ্রুতগতিতেই চলে। মাঝের ওভারে ১৬৪ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন এই ইংলিশম্যান, আর শেষ চার ওভারে তাঁর স্ট্রাইক রেট তো ২১১!
হায়দরাবাদের সাথে ম্যাচে প্রথম ১১ বলে এক বাউন্ডারিতে মাত্র চার রানই করেছিলেন বাটলার। আউট হওয়ার আগে পরের ১৬ বলে এনেছিলেন ৩১ রান। মুম্বাইয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচে একটা সময় ১৫ বলে বাটলারের রান ছিল ১২, ৫২ বলে এরপর এনেছেন ৮৮ রান। বেঙ্গালুরুর সাথে ৪৭ বলে ৭০ রানের ইনিংসেও শুরুটা করেছিলেন ধীরগতিতে, প্রথম ১৪ বলে ছিল ১০ রান।
কলকাতা ও দিল্লির বিপক্ষে দুই সেঞ্চুরিতে দেখিয়েছেন ক্রিজে থিতু হয়ে গেলে তিনি কতটা বিধ্বংসী হতে পারেন। কলকাতা ম্যাচে এক সময় ৯ বলে ৩ রানে থাকা বাটলারই পরের ৫১ বলে ১০০ রান এনে থেমেছিলেন ৬১ বলে ১০৩ রানে। আর দিল্লির সঙ্গে আউট হওয়ার আগে শেষ ৫০ বলে এনেছিলেন ১০৫ রান। তবে তার আগের ১৪ বলে করেছিলেন মাত্র ১১ রান।
ধীর শুরুর পর যেকোন ওভার টার্গেট করে একেবারে ঠিক যেন ঝাপিয়েই পড়েন বাটলার। যেমন, মুম্বাইয়ের বাসিল থাম্পির ওভার থেকে তিন ছয় ও দুই চারে ২৬ রান এনে খোলস থেকে বেরিয়েছিলেন। উমরান মালিককে ১২ বলে ৫ রানে থাকা অবস্থায় চতুর্থ ওভারে দুই ছয় ও এক চারে এনেছিলেন ১৬ রান। দিল্লি ম্যাচে ষষ্ট ওভারে খলিলের ওভার থেকে ১৫ রান এনে পাল্টান গিয়ার।
আবার নির্দিষ্ট বোলারদের সামনে সুযোগ নিতেও সাবধানী থাকেন এই বাটলার। এই যেমন, কলকাতার বিপক্ষে সেঞ্চুরির ম্যাচে সুনিল নারাইনের ৯ বলে ৫ সিঙ্গেলই এনেছিলেন শুধু। মুম্বাইয়ের বিপক্ষে শতক হাঁকানো ইনিংসে জাসপ্রিত বুমরাহর ১৫ বলে এনেছিলেন ১১ রান। বেঙ্গালুরুর সাথে ম্যাচে হার্শাল প্যাটেলের ৯ বলে করেছিলেন ৬ রান। এমন বোলারদের ওভার কোন ঝুঁকি না নিয়ে কাটিয়ে দিতেও অসম্মতি থাকে না বাটলারের।
আর এভাবেই পরিকল্পনামাফিক খেলে বাটলার এগিয়ে যাচ্ছেন অবিশ্বাস্য সব রেকর্ডের পথে। আইপিএলের এক আসরে চারটি সেঞ্চুরির রেকর্ড বিরাট কোহলির। ২০১৬ সালের ওই আসরেই ৯৭৩ রান করে কোহলি গড়েছিলেন এক আসরে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড। আইপিএল ইতিহাসে সর্বোচ্চ ক্রিস গেইলের ছয় সেঞ্চুরি। পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকা বাটলারের রানের গাড়ির জন্য দুটি রেকর্ডই এখন হুমকির মুখে। সাত ম্যাচের পাঁচটিতেই পঞ্চাশোর্ধ রান করা বাটলারকে থামাবে কে?
তবে কি এবারই আইপিএল পেতে যাচ্ছে এক আসরেই হাজার রান করা প্রথম কাউকে? যেমন ব্যাটিং শুরু করেছেন, ওরেঞ্জ ক্যাপ তাঁর মাথা থেকে নামবে কি না, তা ভাবার সাহসটা পর্যন্ত করা যায় নাকি!