২০১৫ সালের ৩১ মে লাহোরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রাখেন বাবর আজম। এর পরের বছর ৭ সেপ্টেম্বর ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতেও তার অভিষেক হয়ে যায়। পরের মাসের ১৩ অক্টোবর দুবাইতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টেও অভিষেক ঘটে এই ব্যাটারের।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা খুব বেশিদিন হয়নি বাবর আজমের। এরই মধ্যে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে আইসিসি র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ব্যাটার তিনি। টেস্টে আছেন আট নম্বরে। সর্বশেষ করাচি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে পারফরম্যান্স করেছেন, তাতে র্যাংকিংয়ে তার আরও উন্নতি হচ্ছে যে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দুই বছর আগেই পাকিস্তানের সব ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব পেয়ে যান। তার নেতৃত্বে বিশ্ব ক্রিকেটে বেশ দাপট দেখাচ্ছে দলটি।
২০১৫-১৬ সালে অভিষেক হলেও তখন বিশ্ব ক্রিকেটের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেননি তিনি। বাবর আজম নামক বটবৃক্ষ ডালপালা মেলতে শুরু করে এর দুই বছর পর, ২০১৮-১৯ সালে এসে। একের পর এক বড় ইনিংস খেলে নিজেকে নিয়ে যান সেরাদের কাতারে। কেউ তার ব্যাটিংয়ে আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটার বিরাট কোহলির ছায়া খুঁজে পান। আবার কেউ বলেন, পাকিস্তান ক্রিকেটের ভবিষ্যত তার হাতেই। দ্বিতীয়টি এরই মধ্যে প্রমাণ করতে শুরু করেছেন বাবর। বিরাট কোহলির ছায়া থেকেও অনেক আগেই বের হয়ে এসেছেন। ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ও কিংবদন্তী মাইকেল ভন তো বলেই দিয়েছেন, বর্তমান সময়ে সব ফরম্যাট মিলিয়ে সেরা ব্যাটার বাবর আজমই।
সদ্য শেষ হওয়া করাচি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলেছেন বাবর আজম। নিশ্চিত হারের মুখে থাকা ম্যাচ বের করে নিয়ে এসেছেন। দলকে জেতাতে না পারলেও ম্যাচ বাঁচিয়েছেন, ড্র হয়েছে। সেটিও প্রায় অসম্ভব এক গল্প। আর সেই গল্পের নায়ক বাবর আজম।
পাকিস্তানকে ৯০৬ রানের পাহাড়সম টার্গেট দেয় অস্ট্রেলিয়া। তখনই সবাই ভেবেছিল, বড় ব্যবধানে হারতে যাচ্ছে পাক বাহিনী। একেতো খেলতে হবে ১৭২ ওভার, তারওপর চতুর্থ ইনিংস। পূর্বে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ৪১৮ রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড আছে। আবার চতুর্থ ইনিংসে ১৭২ ওভার ব্যাটিং করারও কোনো দলের রেকর্ড নেই। প্রথম ইনিংসে পাকিস্তান অলআউট হয়েছিল মাত্র ১৪৮ রানে।
এমন পরিস্থিতিতে চতুর্থ দিনের লাঞ্চ বিরতির আগেই পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় অজিরা। মাত্র ২১ রানে ২ উইকেটও হারিয়ে বসে তারা। তখন ক্রিজে আসেন বাবর আজম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, রাজ্যের চাপ তার মাথায়। তবে বিচলিত ছিলেন না। ওপেনার আব্দুল্লাহ শফিককে সঙ্গে নিয়ে ধীরে ধীরে ইনিংস বড় করতে থাকেন। ওইদিন আর কোনো উইকেট হারাতে দেননি। দিনশেষে দলটির সংগ্রহ ২ উইকেট হারিয়ে ১৯২ রান। বাবর আজম ১০২ ও আব্দুল্লাহ শফিক ৭১ রানে অপরাজিত ছিলেন। তখনও কেউ ভাবেননি পরদিন ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছেন বাবর। তবে একটা আশাও ছিল। কারণ, দীর্ঘ দুই বছর পর শতকের দেখা পেয়েছেন বাবর। চাপে থাকা সত্ত্বেও তার পুরো ইনিংসে কোনো ভুল শট ছিল না। শান্ত ও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের স্বাভাবিক খেলাটাই খেলে গেছেন।
পরদিন দেখা গেলো এক কিংবদন্তির জন্ম। করাচির মাঠে রচিত হলো ইতিহাস। বিশ্ব ক্রিকেট দেখলো কালজয়ী এক ইনিংস। পরদিন দলের ২৪৯ রানের সময় ব্যক্তিগত ৯৬ রান করে ফিরে যান আব্দুল্লাহ শফিক। ভেঙে যায় তাদের ২২৮ রানের জুটি। এরপর ফাওয়াদ আলম নেমে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। মাত্র ৯ রান করেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন। তবে একপ্রান্ত আগলে রাখেন বাবর আজম। ফাওয়াদ আলমের বিদায়ের পর তার সঙ্গী হন মোহাম্মদ রিজওয়ান। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন এই দুজন। তাইতো তাদেরকে মাঠে দেখে ভক্তদের মনেও আশার প্রদীপ জ্বলে। তারাও হতাশ করেননি। এমনকি ম্যাচশেষে রিজওয়ান বলেছিলেন, একটা পর্যায়ে তারা ম্যাচ জেতানোর চিন্তাও করেছিলেন। কিন্তু বাবর আউট হওয়ার পর সেই চিন্তা থেকে সরে আসেন।
দলীয় ৩৯২ রানের সময় নাথান লায়নের বলে আউট হন বাবর আজম। তখন দিনের খেলা আরও ১২ ওভার বাকি ছিল এবং ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি পেতে বাবরের দরকার ছিল ৪ রান। সেটি আর হলো না। লায়নের বলটি বাবরের ব্যাট ও প্যাডে লেগে হালকা ওপরে ওঠে যায়। সেটি মুহূর্তেই ধরে ফেলেন শটে দাঁড়িয়ে থাকা মার্নাশ লাবুশেনে। অবশ্য তার আগেই ইতিহাস রচনা করে যান বাবর আজম। ৪২৫ বলে সাজানো তার ইনিংসটিতে ছিল এক হার না মানা লড়াকু সৈনিকের প্রতিচ্ছবি। যেন পণ করেই নেমেছেন, প্রতিপক্ষকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেবেন না। আউট হওয়ার পরও তিনি কোনো উদযাপন করেননি। হতাশ হয়ে মাঠ ছাড়েন। আর বারবার পেছনে ক্রিজের দিকে তাকাচ্ছিলেন। এটা যুদ্ধ শেষ করে না আসতে পারার হতাশা।
তবে শেষ পর্যন্ত পাক অধিনায়কের মুখে হাসি ফিরিয়ে দিয়েছেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। তিনি শেষ বল পর্যন্ত ক্রিজে টিকে ছিলেন এবং তুলে নেন টেস্ট ক্যারিয়ারে নিজের দ্বিতীয় শতক। ডাবল সেঞ্চুরি না হলেও ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় বাবরের এই ইনিংসটিকে টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সেরাও বলা যায়। আর সেটা খেলতে যে হার না মানা মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে বলাই যায়, বিশ্ব ক্রিকেটে বাবর নামক নতুন কিংবদন্তির জন্ম হলো। এর মধ্য দিয়ে দুটি রেকর্ডও নিজের করে নিয়েছেন পাক অধিনায়ক। এক, চতুর্থ ইনিংসে পাকিস্তানি ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ইনিংস। দুই, অধিনায়ক হিসেবে চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ ইনিংস। কিংবদন্তিদের জন্ম তো এভাবেই হয়।