শাটল কক কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে ব্যাডমিন্টন কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত বিশাল শর্মা। কখন বড়দের খেলা শেষ হবে, কখন পরিত্যক্ত শাটল কক আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হবে, সেই আশায় চেয়ে থাকত সিলেটের খুদে ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় বিশাল।
একসময় বড় ভাইদের খেলা শেষ হলে সেই পরিত্যক্ত পালক নষ্ট হয়ে যাওয়া কক দিয়ে শুরু করত অনুশীলন। এভাবে ব্যাডমিন্টন খেলেই বাজিমাত করেছে বিশাল। প্রথমবার ঢাকায় এসে খেলেছে শেখ রাসেল জাতীয় স্কুল ব্যাডমিন্টনে। প্রথম আসরেই সবটুকু আলো কেড়ে হয়েছে চ্যাম্পিয়ন।
দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে বিশাল। বাবা বিক্রম শর্মা সিলেট শহরের একটা চা-পাতা পাইকারি বিক্রির দোকানের কর্মচারী। দুর্ঘটনায় পাঁচ বছর আগে পা হারিয়ে ফেলেন বিক্রম। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন অবস্থায় ভেঙে পড়েন বিশালের মা।
এর পর থেকে বিশালের চাচার দেওয়া আর্থিক সহযোগিতায় কোনোরকমে চলছে তাদের সংসার। কিন্তু উপায় না দেখে একসময় বিশাল নেমে পড়ে টাকা উপার্জনে। শহরের একটি মোটর গ্যারেজের মেকানিক হিসেবে কাজ শুরু করে বিশাল।
সারা দিন মোটর গ্যারেজে কাজ করলেও পড়াশোনা ছাড়তে চায়নি। এ জন্য সিলেটের ভোলানন্দ নৈশ উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সে। মোটর গ্যারেজে কাজ করতে করতেই বিশালের কাছে প্রস্তাব আসে হবিগঞ্জে আরেকটি বড় দোকানে চাকরির। কিন্তু ব্যাডমিন্টনের টানে সেই প্রস্তাব না করে দিয়েছে বিশাল, ‘হবিগঞ্জ গেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে পারব না। এ জন্য সেখানে যেতে রাজি হইনি।’ সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্যারেজে যাওয়ার আগপর্যন্ত চলে বিশালের ব্যাডমিন্টন অনুশীলন। আর সন্ধ্যায় স্কুলে চলে পড়াশোনা।
ব্যাডমিন্টনের উর্বরভূমি সিলেট। এই জেলা থেকেই উঠে এসেছেন জাতীয় দলের একাধিক খেলোয়াড়—এনামুল হক, সালমান খান, গৌরব সিংহ, মঙ্গল সিংহ। সিলেটের শিবগঞ্জ মণিপুরিপাড়ায় ব্যাডমিন্টন একাডেমিতে চন্দ্রশেখর সিংহের কাছে নিয়মিত অনুশীলন করে বিশাল।
খেলার প্রতি বিশালের প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে চন্দ্রশেখর তাকে অনুশীলনের সুযোগ দেন, ‘সিনিয়র খেলোয়াড়দের খেলা শেষ হলে ওকে দেখতাম কোর্টের পাশে ঘুরঘুর করতে। অনেক সময় নষ্ট কক আর ভাঙা র্যাকেট দিয়ে খেলার চেষ্টা করত সে। ওর আগ্রহ দেখে আমার ছেলের (মঙ্গল সিংহ) সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দিই।’
বিশালের মধ্যে দারুণ সম্ভাবনা দেখেন এই কোচ, ‘ওর ফুটওয়ার্ক ভালো। উচ্চতা অনুসারে দুর্দান্ত ফোরহ্যান্ড ও ব্যাকহ্যান্ড স্ম্যাশ করে। এবারের স্কুল টুর্নামেন্টে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে বিশাল।’ স্কুল টুর্নামেন্টে এত ভালো খেলবে সেটা আশা করেনি বিশালও, ‘আমি ভেবেছিলাম বড়জোর সেমিফাইনালে খেলব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।’
স্কুল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে অবাকই বিশাল। তবে বেশি অবাক হয়েছে ল্যাপটপ পুরস্কার পেয়ে। ঘোরলাগা বিস্ময় নিয়ে মুঠোফোনে বিশাল বলছিল, ‘প্রথম যখন এনাম স্যার (এনামুল হক) আমাকে জানালেন, বিশাল তুই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নিবি, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঢাকায় আসার আগের রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি। কখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে, সেই অপেক্ষায় ছিলাম। এরপর প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আমাদের সবার সঙ্গে কথা বলেন।’
এক জোড়া উন্নত মানের কেডস কেনার সামর্থ্য নেই বিশালের। খেলার জন্য বিশালকে কেডস উপহার দিয়েছেন মঙ্গল। নিজের ব্যবহৃত র্যাকেটও দিয়েছেন বিশালকে। সেই র্যাকেট নিয়েই ঢাকায় এসে বিশাল হয়েছে চ্যাম্পিয়ন।
কিন্তু এভাবে অন্যের সাহায্য নিয়ে কত দিন খেলতে পারবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিশাল, ‘শাটল, স্ট্রিং, র্যাকেট সবকিছুর অনেক দাম। একটা ভালো র্যাকেট কিনতে ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। সেই টাকা জোগাড় করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আর এসব ছাড়া নিয়মিত অনুশীলনও করা যাবে না।’
শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের উদ্যোগে গত দুই বছর আয়োজিত হচ্ছে স্কুল ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা। সাবেক জাতীয় খেলোয়াড় ও শিশু-কিশোর পরিষদের ক্রীড়া সম্পাদক অহিদুজ্জামান বিশালদের মাঝেই দেখছেন নতুন সম্ভাবনা, ‘আমাদের প্রচুর খেলোয়াড়সংকট। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেখানে থাকার কথা, সেখানে আমরা নেই। স্কুল পর্যায়ের এই সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের ভালোভাবে প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা দিলে এরাই বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে অনেক দূরে।’