ফুটবল ইতিহাসে অনেক রথী-মহারথী খেলোয়াড় দেখেছে বিশ্ব। তারা নিজের ফুটবল প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে গড়েছে একের পর এক রেকর্ড। অনেকে ক্যারিয়ারের সুসময়ে দল বদলের বাজারে গড়েছে ইতিহাস, নিজেকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল অন্যান্য উচ্চতায়। আবার দল বদল করে ক্যারিয়ারকে আরও সুসংগঠিত করতে গিয়ে অনেকে হারিয়ে গেছে। তাদের স্বপ্ন পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে।
বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার পোলিশ তারকা রবার্ট লেভানডফস্কি। গত আট মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ক্যারিয়ারের সেরা সময় উপভোগ করছিলেন। জিতেছেন সম্ভাব্য সব শিরোপা, দুইবার ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারও নির্বাচিত হন। তবে একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে। ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিগত পুরস্কার ব্যালন ডি’অর যে জেতা হয়নি এখনো। সেটি ঘুচাতেই কিনা লেভানডফস্কি এবার বায়ার্নের সুখের সংসার ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন বার্সেলোনায়।
তিনি এমন একটি ক্লাবে গিয়েছেন, যারা নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে। নতুনভাবে ঘুচিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বার্সার অধিকাংশ ফুটবলারই তরুণ। তাদের সঙ্গে লেভানডফস্কি নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন কিনা, সেটা এখন বড় প্রশ্ন। এরই মধ্যে বার্সার হয়ে দুই ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু কোনো গোল করতে পারেননি। তাই শঙ্কা জাগছে, এই স্ট্রাইকারের বার্সা স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে না তো! তাছাড়া অতীতে এমন আরও অনেক ইতিহাস রয়েছে। যারা স্বপ্নের ক্লাবে খেলতে এসে ক্যারিয়ারে দুঃস্বপ্ন ডেকে এনেছেন। তাদের মধ্যে হালের ফিলিপ কৌতিনহো, রোমেলু লুকাকু, আন্তোয়ান গ্রিজম্যান অন্যতম।
কৌতিনহো
ব্রাজিলের মধ্যমাঠের ফুটবল জাদুকর ফিলিপ কৌতিনহো নিজের সেরা সময় কাটিয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লিভারপুলে। অলরেডদের হয়ে নিজের পাখা মেলে যেন আকাশে বিচরণ করছিলেন। হয়েছেন আক্রমণভাগের অন্যতম সেরা অস্ত্রও। দলও পেতে থাকে একের পর এক সাফল্য। লিভারপুলের হয়ে ১৫১ ম্যাচে ৪১ গোল করেন এবং করিয়েছেন আরও অসংখ্য। কিন্তু তার মধ্যে একটা অতৃপ্তি থেকে যায়। কৌতিনহো চেয়েছেন ফুটবল গ্রহে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে। তবে জানতেন না সেই গ্রহে নতুন ঝড় অপেক্ষা করছে। যেটা সামাল দেওয়ার সাধ্য তার নেই।
২০১৭-১৮ মৌসুমে লিভারপুল ছেড়ে কৌতিনহো পাড়ি জমান বার্সেলোনায়। তাকে দলে ভেড়াতে রেকর্ড় ১৪০ মিলিয়ন ইউরো খরচ হয় কাতালান ক্লাবটির। বার্সার হয়ে খেলা কৌতিনহোর স্বপ্ন ছিল। তাই প্রস্তাব পেয়েই সেটা লুফে নেন। কিন্তু কিছুদিন পরই বুঝতে পারেন তার স্বপ্ন ডানা মেলছে না। একটা সময় নিয়মিত একাদশ থেকেও জায়গা হারিয়ে ফেলেন। দলটির হয়ে চার বছরে খেলেন মাত্র ১০৬টি ম্যাচ। ২৫টি গোল করার পাশাপাশি করিয়েছেন আরও কম, মাত্র ১৪টি। এর মাঝে আবার তাকে এক মৌসুমের জন্য বায়ার্ন মিউনিখে ধারে পাঠায় বার্সা। পরে ফিরে এলেও তার পারফরম্যান্সে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বাদ পড়েন ব্রাজিল জাতীয় দল থেকেও।
গত জানুয়ারিতে আবারও কৌতিনহোকে ধারে পাঠায় বার্সেলোনা। এবার তার ঠিকানা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল অ্যাস্টন ভিলা। সেখানে গিয়েই যেন নিজের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন এই প্লে-মেকার। পুরোনো ছন্দও ফিরে পান। ব্রাজিল দলেও ডাক পেয়েছেন। তাইতো তাকে পাকাপাকিভাবে ১ কোটি ৭০ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ডের বিনিময়ে কিনে নিয়েছে অ্যাস্টন ভিলা।
লুকাকু
বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের গর্বিত সদস্য রোমেলু লুকাকু। গতি আর গোল করার অবিশ্বাস্য দক্ষতা দিয়ে ফুটবল বিশ্বের নজর কাড়েন। তাকে সবাই চিনতে শুরু করে ২০১৪-১৭ মৌসুমে এভারটনের হয়ে খেলার সময়। এর আগে এক মৌসুম ক্লাবটিকে ধারে খেলেন। সবমিলিয়ে ১১০ ম্যাচে করেন ৫৩ গোল। পরের দুই মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাউটেডের হয়েও দারুণ খেলেন(৬৬ ম্যাচে ২৮ গোল)। তবে ক্যারিয়ারের সেরা সময় উপভোগ করেছেন ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ মৌসুমে ইন্টার মিলানে। এই দুই বছরে ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে ৭২ ম্যাচে ৪৭ গোল করেন লুকাকু।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলায়’। বেলজিয়াম তারকার বেলায়ও সেটা হলো। ইন্টারের সুখের সংসার ছেড়ে ২০২১-২২ মৌসুমে রেকর্ড় ট্রান্সফার ফি প্রায় ৯৭.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে চেলসিতে পাড়ি জমান লুকাকু। সে সময় তিনি জানিয়েছিলেন ক্লাবটির হয়ে খেলা তার স্বপ্ন। যদিও ক্যারিয়ারের শুরুতেই (২০১১-২০১৪) চেলসিতেই ছিলেন তিনি। কিন্তু তিন বছরে মাত্র ১০ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান, গোল করতে পারেননি একটিও। অধিকাংশ সময় সাইড বেঞ্চে বসে থাকতে হতো। তবে এবারের ফেরাটা ভিন্ন। তাই বড় কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে স্টার্মফোর্ড ব্রিজে আসেন তিনি। কিন্তু এখানে এসে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। পুরো মৌসুমে করেছেন মাত্র ৫ গোল। ভক্তরাও তার এমন পারফরম্যান্সে হতাশ। তাই তাকে আবার ইন্টার মিলানে ধারে পাঠিয়ে দিয়েছে ব্লুজরা। ইন্টারে ফিরতে পেরে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন এই ফরোয়ার্ড। এটা স্বীকারও করেন তিনি।
গ্রিজম্যান
২০১৮ সালে ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য আন্তোয়ান গ্রিজম্যান। প্রতিভাবান এই খেলোয়াড় খুব দ্রুত নিজের ফুটবলশৈলী দিয়ে বিশ্বের নজর কাড়েন। ২০০৯ সালে সিনিয়র ফুটবলে রিয়াল সোসিয়েদাদের হয়ে অভিষেক ঘটে তার। ক্লাবটির হয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২০২ ম্যাচ খেলে করেন ৫২ গোল। তবে ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছেন অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদের জার্সিতে। ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৯৩ ম্যাচে করেন ১৪১ গোল। এরপর থেকেই তার ক্যারিয়াবে ভাটা পরতে শুরু করে।
বার্সেলোনায় খেলার স্বপ্ন নিয়ে ছেড়ে আসেন মাদ্রিদ। তাকে ১২০ মিলিয়ন ইউরোতে কিনে নেয় কাতালানরা। কিন্তু যে আশায় গ্রিজম্যান ন্যু ক্যাম্পে আসেন, তা পূরণ করতে পারেননি। সার্বক্ষণিক লিওনেল মেসির ছায়া হয়ে থেকেছেন। একসময় ক্লাবেও গুরুত্বহীন হয়ে যান। ১০২ ম্যাচ খেলে করেন মাত্র ৩৫ গোল। তাই তাকে অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদে আবারও ধারে পাঠিয়ে দেয় বার্সা। সেখানেও এখন সুবিধা করতে পারছেন না এই প্লে-মেকার।
এদিকে, রবার্ট লেভানডফস্কি বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে আট বছরে আটটি বুন্দেসলিগা শিরোপা জিতেন। একটি চ্যাম্পিয়নস লিগও জয় করেন। ক্লাবটির হয়ে ২৭৩ ম্যাচে করেন ২৪৪টি গোল। এমন পারফরম্যান্সের পরও ক্লাবটি ছেড়ে বার্সেলোনায় এসেছেন। তাই শঙ্কা জেগেছে, নিজের সেরা সময়টা কাতালানদের হয়ে ধরে রাখতে পারবেন তো পোলিশ স্ট্রাইকার? নিজেকে নিয়ে যেতে পারবেন আরও উচ্চতায়। নাকি কৌতিনহো-গ্রিজম্যানদের মতো নিজেকে হারিয়ে খুঁজবেন? তাছাড়া তার বয়স এখন ৩৪। এই বয়সে সবাই নিজের সেরা ফর্ম ধরে রাখতে পারে না। তবে ভক্তদের চাওয়া বার্সেলোনায়ও একের পর এক রেকর্ড গড়ে যাক তাদের প্রিয় তারকা। এমনটা হলে বার্সা ও লেভানডফস্কি দুই পক্ষের জন্যই সোনায় সোহাগা।