বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলেননি এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সেরা হচ্ছেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। আশির দশকের শেষ থেকে নব্বই দ্শকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন তিনি। মোহামেডান ও আবাহনীর হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন দীর্ঘদিন। ছয় মোহামেডানে খেলার পর যখন আবাহনীতে যোগ দেন তখন আবাহনীর সমর্থকরা মিছিল করে ক্রিকেট বোর্ড থেকে নিয়ে গিয়েছিলো তাকে। এই ক্রিকেটারের জীবনে সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় আসে ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফির আগে। দৈনিক ভোরের কাগজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের জন্য অধিনায়ক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। আজকে আমরা নান্নুর সেই বিতর্কিত সাক্ষাতকারে গল্পই শুনবো।
১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফি ছিলো বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টুর্ণামেন্টগুলোর একটি। সেবার নিয়ম করা হয়েছিলো এই টুর্ণামেন্টের শেষে প্রথম তিন স্থান পাওয়া দলগুলো ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের চুড়ান্ত পর্বে খেলবে। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত সে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সুযোগ পেলে দুটো ম্যাচ ঢাকাতেও অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। সেসময় বাংলাদেশের জন্য সেটাই ছিলো বিশাল ব্যাপার। তাই বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিতে বিসিবি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়।
তারা কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় ভারতের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য মহিন্দর অমরনাথকে। কিন্তু অমরনাথের আচরণ সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো। তিনি একজন বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড় সেটা মুহুর্তের জন্যও কাউকে ভুলতে দিতেন না। ক্রিকেটে তখন চুনোপুঁটি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তার সবকথাই বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নিতো। অমরনাথের ক্রিকেট বোর্ডের টেবিলে পা তুলে বসে সবাইকে তাচ্ছিল্য করার কানাঘুষা বিসিবির আশেপাশে শোনা যেতো। তখন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। দলের প্রস্তুতি ভালোভাবে সম্পুর্ণ করার জন্য বাংালদেশকে ভারতে মঈন উদ দৌলা ট্রফি খেলতে পাঠানো হয়। সেখানেই অধিনায়ক নান্নু এবং কোচ অমরনাথের সাথে দ্বন্দ চরমে ওঠে। ভারতে বাংলাদেশ মাঠে ভালো করতে পারেনি। সেখান থেকে ফিরে নান্নু ঢাকার জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ভোরের কাগজকে এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার দেন।
সেই সাক্ষাৎকারে নান্নু বলেন, কোচ মহিন্দর অমরনাথ প্রত্যেক ম্যাচের আগে বারবার বলেছেন একই কথা: ‘তোমরা আগে যা খেলেছ, ভুলে যাও। আজ যা খেলবে তাই ধরা হবে।’ তাঁর এই কথা ব্যাটসম্যানদের বাড়তি চাপে ফেলে দেয়, যে কারণে স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারেনি তারা’। তিনি আরও বলেন, “দল গঠন, ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করা– সবই করেছেন মহিন্দর অমরনাথ। এমনকি কারও সঙ্গে কোনো আলোচনাও করেননি তিনি। ম্যানেজারের সঙ্গেও নয়। আমি দলের অধিনায়ক, আমার সঙ্গেও কোনো আলোচনা নয়। ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে অমরনাথই বলে দিতেন, ওকে ওপেনিংয়ে পাঠাও, অমুক অত নম্বরে নামবে।
এমনকি দলও জানা থাকত না আগে, টস করতে যাওয়ার আগে দল বলে দিতেন তিনি”। নান্নু সবচেয়ে অপমানিত বোধ করেছিলেন যে জায়গায়, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের বোলিং, ফিল্ডিং, ক্যাপ্টেনসি শিখাতে এক ম্যাচে নিজেই খেলোয়াড় হিসেবে নেমে যান অমরনাথ। নান্নু বলেন, ” বোম্বেতে এমন এক কাণ্ড করেছেন, যা মেনে নেওয়া কঠিন। টাটার বিপক্ষে ম্যাচটিতে দল যখন ফিল্ডিং করছে, দুই/তিন ওভার পরই মাঠে নেমে যান অমরনাথ এবং মনিকে অফ করে তিনি ক্যাপ্টেনসি করেছেন। ফিল্ড প্লেসিং শেখানোর জন্য নাকি তিনি এমন করেছেন। এভাবে একটা বিদেশী দলের বিপক্ষে সিরিয়াস ম্যাচে উনার মাঠে নামাটা ঠিক হয়নি। এতে প্রতিপক্ষ দল এবং দর্শকদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি মোটেই উজ্জ্বল হয়নি। বরং ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে ছোটই মনে হয়েছে আমার”। দল নির্বাচনের জন্য অমরনাথের একক ক্ষমতারও প্রতিবাদ করেন নান্নু।
এই সাক্ষাৎকার ছাপা হলে ভারতের কলকাতার এক পত্রিকা চার কলামের নিউজ করে। সে খবর লন্ডনে বসে পেয়ে যান মহিন্দার অমরনাথ। তিনি বিসিবিকে অধিনায়ক পরিবর্তনের জন্য চাপ দেন। এমনকি অধিনায়ক বদল না করলে বাংলাদেশে ফিরবেন না বলেও জানিয়ে দেন। চাপের মুখে বিসিবি নান্নুকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নান্নুকে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয় যে, তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে এসব বলেছেন। শেষ পর্যন্ত অনভিজ্ঞ ফারুক হোসেনের অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি খেলতে যায় এবং বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়।
১৯৯৬ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হওয়ার পিছনে নান্নুর এই সাক্ষাৎকার, হঠাৎ অধিনায়ক বদল এবং কোচ মহিন্দর অমরনাথের একছত্র অধিপিত্যের ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। তাই নান্নুর সেই সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনার একটি হয়ে থাকবে। প্রতিদিন এমন অজানা গল্প জানতে সাবস্ক্রাইব করুন বাংলা ডায়েরি।