Image default
প্রযুক্তি

ইন্টারনেট: কি এটি আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? – ইতিহাস, কাজের পদ্ধতি, সুবিধা ও ঝুঁকি

ইন্টারনেট (Internet) হল একটি বিশাল বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক যা পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন কম্পিউটার, সার্ভার ও ডিভাইসকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে। এটি একাধিক কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সমষ্টি, যা ইন্টারনেট প্রটোকল (IP) ব্যবস্থার মাধ্যমে ডেটা আদান-প্রদান করে এবং এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। উল্লেখযোগ্য যে, অনেকেই ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) কে সমার্থক হিসেবে গণ্য করে, তবে আসলে এ দুটি আলাদা কনসেপ্ট। ইন্টারনেট হল একটি নেটওয়ার্ক, যেখানে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব একটি সেবা যা এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অ্যাক্সেস করা হয়।

ইন্টারনেট পরিভাষা

ইন্টারনেট (Internet) হল একটি আন্তঃসংযুক্ত নেটওয়ার্ক (Interconnected Network), যা কম্পিউটার নেটওয়ার্কগুলোকে বিশেষ গেটওয়ে বা রাউটারের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে গঠিত। ইন্টারনেট শব্দটি এই আন্তঃসংযুক্ত নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত রূপ, এবং এটি প্রায়ই “নেট” (Net) হিসেবে পরিচিত।

ইন্টারনেট শব্দটি সাধারণত যখন ব্যবহৃত হয়, তখন এটি আন্তর্জাতিক আইপি (IP) নেটওয়ার্ক সিস্টেমকে নির্দেশ করে, যা একটি বিশাল তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন কম্পিউটার এবং ডিভাইসের মধ্যে ডেটা আদান-প্রদান সম্ভব হয়।

এছাড়াও, ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) অনেক সময় একে অপরের প্রতিস্থাপন হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে তারা বাস্তবে আলাদা বিষয়। ইন্টারনেট হল একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক পরিকাঠামো, যেখানে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব একটি সেবা, যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে হাইপারলিংক এবং URL এর মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়।

ইন্টারনেটের ইতিহাস: ARPANET থেকে বিশ্বব্যাপী বিস্তার

১৯৬০-এর দশকে, মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণা সংস্থা অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (ARPA) পরীক্ষামূলকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারের মধ্যে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এই নেটওয়ার্কটি ছিল প্যাকেট সুইচিং প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি এবং ARPANET নামে পরিচিত ছিল। প্রাথমিকভাবে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিল কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগার।

১৯৮৯ সালে ইন্টারনেট প্রযুক্তি আইএসপি (ISP) দ্বারা সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়, এবং ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এটি পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ইন্টারনেটের এই বিস্তার ১৯৯০ এর পরবর্তী সময়ে আরও দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা পুরো পৃথিবীকে ডিজিটালভাবে সংযুক্ত করতে সাহায্য করে।

ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা: অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল দ্বারা পৃথিবীজুড়ে সংযোগ

বিশ্বের সমস্ত কম্পিউটারকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করতে ব্যবহৃত হয় অত্যন্ত শক্তিশালী অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল। এই ক্যাবল সমুদ্রের নিচে প্রায় ৮ লাখ কিলোমিটার বিস্তৃত, যা সারা পৃথিবীকে ইন্টারনেট এর মাধ্যমে সংযুক্ত করে একটি বিশাল ডিজিটাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এটি একটি জালের মতো পৃথিবীজুড়ে ডেটা আদান-প্রদান নিশ্চিত করে।

এই আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রথম আবিষ্কার ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন ব্যাহত না হয়, সেই উদ্দেশ্যে মিলনেট নামে একটি কোম্পানি প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের সূচনা হয় ১৯৯৩ সালে, যা দেশে ডিজিটাল বিপ্লবের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

আইপি ঠিকানা: ইন্টারনেটে প্রতিটি কম্পিউটারের অনন্য শনাক্তকারী

ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত প্রতিটি কম্পিউটারের একটি নিজস্ব আইপি ঠিকানা থাকতে হয়, যা ইন্টারনেট প্রোটোকল (IP) নামে পরিচিত। আইপি ঠিকানা একটি অনন্য শনাক্তকারী হিসেবে কাজ করে, যা প্রতিটি কম্পিউটার বা ডিভাইসের জন্য আলাদা হয় এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডেটা আদান-প্রদানকে সহজতর করে। প্রতিটি ইন্টারনেট সংযোগের জন্য একটি পৃথক আইপি ঠিকানা নির্ধারিত থাকে, যা কম্পিউটারগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে সহায়ক হয়।

ইন্টারনেটের কাজের পদ্ধতি: আইপি ঠিকানা এবং ডেটার আদান-প্রদান

ধরুন, একজন প্রেরক তার বার্তা প্রাপকের কাছে পাঠাতে চান। প্রেরক প্রথমে একটি চিঠি লেখেন, তারপর সেটি একটি খামে ভরে প্রাপকের ঠিকানা সুন্দরভাবে লিখে একটি পোস্ট অফিসে জমা দেন। পোস্ট অফিস তারপর সেই চিঠিটি পোস্টম্যানের মাধ্যমে প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। ইন্টারনেটও একদম এইভাবেই কাজ করে।

এখানে চিঠি যা লেখা হয়েছে, তা হলো ডেটা। প্রেরক যেটি পোস্ট অফিসে জমা দেন, সেটা হলো তার আইপি ঠিকানা বা আইপি অ্যাড্রেস। পোস্ট অফিস যা করে, তা হলো ইন্টারনেট। পোস্টমাস্টার বা ইন্টারনেট ডেটা বা চিঠি প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়, যা হলো প্রাপকের আইপি ঠিকানা।

এভাবে আইপি ঠিকানা এবং ডেটা ট্রান্সমিশন ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে, যেখানে প্রতিটি ডেটা প্যাকেট নির্দিষ্ট আইপি ঠিকানায় পৌঁছানোর জন্য ট্রান্সমিট হয়।

ইন্টারনেট কিভাবে কাজ করে: প্যাকেট রাউটিং ও আইপি-টিসিপি সিস্টেমের মাধ্যমে সংযোগ

ইন্টারনেট হলো বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত একটি আন্তঃসংযুক্ত নেটওয়ার্ক, যেখানে বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে ডেটা ও মিডিয়া আদান-প্রদান করা হয়। ইন্টারনেট কাজ করে প্যাকেট রাউটিং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, যা ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) এবং ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রোল প্রটোকল (টিসিপি) এর মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। এই দুটি প্রটোকল একসাথে কাজ করে, ensuring করে যে বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে, যেকোনো ডিভাইসে ইন্টারনেট নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডেটা প্যাকেট এবং মেসেজ আকারে প্রেরিত হয়। ডেটা প্যাকেট মূলত একটি বড় মেসেজের ছোট ছোট অংশ, যা প্রেরণের আগে প্যাকেট আকারে ভাগ করা হয়। এরপর এই মেসেজ ও প্যাকেটগুলো এক সোর্স থেকে অন্য সোর্সে আইপি ও টিসিপি প্রটোকল ব্যবহার করে ট্রান্সমিট হয়। আইপি সিস্টেমটি মূলত ডেটা প্রেরণের সময় তার ট্র্যাক রাখে, যাতে এটি সঠিকভাবে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারে।

ইন্টারনেটের সঠিকভাবে কাজ করার জন্য, এটি একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে সংযুক্ত থাকতে হয়, যা তার বা বেতার (ওয়্যারলেস) প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করতে পারে। একবার সংযুক্ত হলে, ইন্টারনেট রাউটার এবং সার্ভার ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন কম্পিউটার, ডিভাইস ও নেটওয়ার্কের সঙ্গে কানেক্ট হয়ে বিভিন্ন ডেটা এবং তথ্য সংগ্রহ করে।

এই প্রক্রিয়া ইন্টারনেটের কাজের মূল ভিত্তি, যেখানে প্যাকেট রাউটিং এবং আইপি-টিসিপি প্রটোকল একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ডেটা ট্রান্সমিশন সহজ করে তোলে।

ইন্টারনেটে অ্যাক্সেস: ইন্টারনেট সংযোগের উপায় ও প্রয়োজনীয় ডিভাইস

ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হলে প্রথমে ইন্টারনেটে অ্যাক্সেস প্রাপ্ত করতে হয়। তাহলে প্রশ্ন হলো, কিভাবে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করা সম্ভব? মূলত দুটি প্রধান উপায়ে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করা যায়:

  1. অপটিক্যাল ক্যাবল বা সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে: এর মধ্যে রয়েছে ওয়াইফাই, মডেম, ডায়াল-আপ ইত্যাদি, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এই পদ্ধতিতে প্রায় ৯৯% ডিভাইস ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকে। অপটিক্যাল ক্যাবল বিশ্বের বৃহত্তম ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে, যেখানে দ্রুত ডেটা ট্রান্সফার সম্ভব।
  2. স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস: এই পদ্ধতি বর্তমানে কিছুটা সীমিত হলেও, ১% ডিভাইস এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকে। স্যাটেলাইট সংযোগ দূরবর্তী বা অদূরবর্তী অঞ্চলে ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের জন্য কার্যকর একটি মাধ্যম।

ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রয়োজন:

  1. একটি ডিভাইস: যেমন কম্পিউটার, স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট, যার মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা হবে।
  2. ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ISP): এটি হলো একটি প্রতিষ্ঠান যা থেকে ইন্টারনেট সেবা প্রাপ্ত করা হয়। আইএসপি আপনার ইন্টারনেট কানেকশন স্থাপন করে এবং আপনার ডিভাইসের সাথে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করে।
  3. ওয়েব ব্রাউজার বা অ্যাপ্লিকেশন: যেমন গুগল ক্রোম, মজিলা ফায়ারফক্স, মাইক্রোসফট এজ, ইত্যাদি, যা আপনার ডিভাইসে ইন্টারনেট ব্রাউজিং ও সার্ফিং সক্ষম করে। এই ব্রাউজারগুলি ইন্টারনেট কানেকশনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী কম্পিউটার নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হয়ে থাকে।

ইন্টারনেট: আশীর্বাদ না অভিশাপ?

বর্তমানে ইন্টারনেট মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, এমনকি অনেকেই ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে তা দম বন্ধ হওয়া বা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো অনুভব করেন। কিছু মানুষ আবার ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবেও গণ্য করেন। নিঃসন্দেহে, ইন্টারনেট মানবজাতির জন্য একটি আশীর্বাদ।

মেসেজিং, ভিডিও কলিং, এবং অডিও কলিং সুবিধা সম্পন্ন প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে যোগাযোগ স্থাপন করা সহজ হয়ে গেছে। আরও যেসব সুবিধা রয়েছে তা হলো, শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন যা দ্রুত এবং সহজে যেকোনো তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ দেয়। ইন্টারনেটের এই সুবিধাগুলি বিশ্বকে একে অপরের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করেছে।

তবে, অনেকেই ইন্টারনেটের ক্ষতিকর দিকসমূহও তুলে ধরেন, যেমন ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা, অনলাইন অপরাধ, এবং ডিজিটাল আসক্তি। এজন্য, ইন্টারনেট ব্যবহারের ইতিবাচক দিকগুলোর পাশাপাশি, সচেতন থাকতে হবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়েও।

Related posts

গুগল ফটোজে ব্যক্তিগত ছবি লুকিয়ে রাখবেন যেভাবে

News Desk

অ্যালগরিদম বদলালো ইন্সটাগ্রাম

News Desk

৪ মহাকাশচারীকে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে পাঠাল নাসা ও স্পেস এক্স

News Desk

Leave a Comment