Image default
প্রযুক্তি

ধূমকেতুর পর এবার গ্রহাণুতে পা, মহাকাশে যাচ্ছে ‘ওসিরিস-রেক্স’

ধূমকেতুর পর এ বারই প্রথম কোনও গ্রহাণু বা অ্যাস্টারয়েডের বুকে ‘পদচিহ্ন’ এঁকে দিয়ে আসতে চলেছে মানবসভ্যতা! আর সেই ‘পদচিহ্ন’ আঁকার জন্য শুধুই ‘নখের আঁচড়’ নয়, তার ‘মাংস’ও তুলে নিয়ে আসা হবে পৃথিবীতে! এই প্রথম।

অচেনা, অজানা ঘাতককে চিনতে-বুঝতে গেলে চুল, রক্ত বা তার শরীরের কিছু অংশ নিয়ে তার ডিএনএ পরীক্ষা করতে হয়। তেমনই প্রায় অচেনা, অজানা ঘাতকের ‘ডিএনএ পরীক্ষা’ করতে আজ, বৃহস্পতিবার ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে ‘অ্যাটলাস-৫’ রকেটে চেপে মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে মহাকাশযান ‘ওসিরিস-রেক্স’। পাক্কা সাত-সাতটা বছর সে কাটাবে মহাকাশের হিমশীতল ঠান্ডায়। তার পর সে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেবে ওই ঘাতক গ্রহাণুর পিঠের কিছুটা ‘মাংস’। আর সেই ‘মাংসের টুকরোটা’ একটা ক্যাপসুলে করে ছুঁড়ে দেবে পৃথিবীতে। গবেষণার জন্য।

কাছ থেকে মহাকাশযান ‘ওসিরিস-রেক্স’

নাসার ‘ওসিরিস-রেক্স মিশন’-এর গবেষকদলের অন্যতম সদস্য মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আজ রওনা হয়ে পাক্কা দু’বছর পর ২০১৮ সালে মহাকাশযান ‘ওসিরিস-রেক্স’ ঢুকে পড়বে একটা বিশাল চেহারার গ্রহাণু ‘বেন্নু’র কক্ষপথে। সেই কক্ষপথে থেকেই আরও দু’বছর ধরে মহাকাশযানটি একটু একটু করে গ্রহাণুটির কাছে যেতে শুরু করবে। তার পর ২০২০ সালে ‘ওসিরিস-রেক্স’ শুরু করবে ‘বেন্নু’ থেকে নুড়ি-পাথর কুড়নোর কাজ। সে কাজ শেষ হলে আরও এক বছর মহাকাশযানটি থাকবে ‘বেন্নু’র কক্ষপথে, ২০২১ সাল পর্যন্ত। তার পর শুরু হবে তার ‘রিটার্ন জার্নি’। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে পৃথিবীর কাছাকাছি এসেই ‘বেন্নু’ থেকে কুড়িয়ে আনা নুড়ি-পাথরগুলো একটা ক্যাপসুলের মধ্যে রেখে সেটা প্যারাশ্যুটে করে পৃথিবীতে ছুঁড়ে দিয়ে চলে যাবে ‘ওসিরিস-রেক্স’। সেই ক্যাপসুলটি পড়ার কথা উটা মরুভূমিতে।

কী ভাবে ‘বেন্নু’র কক্ষপথে ঢুকবে-বেরবে ‘ওসিরিস-রেক্স’

অসম্ভব দ্রুত গতিতে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে সেই ‘ঘাতক’। আপাতত তার যা গতিপথ, তাতে ২১৭৫ বা ২১৯৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর ওপর তার আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, এই গ্রহাণুটির মাধ্যমেই হয়তো জানা যাবে, কী ভাবে তৈরি হয়েছিল এই সৌরমণ্ডল। কী ভাবে জন্ম হয়েছিল পৃথিবী সহ এই সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের। কী ভাবে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীতে। এই সৌরমণ্ডলের অন্য কোনও গ্রহেও কোনও কালে ‘প্রাণ’-এর উদ্ভব হয়েছিল কি না। তাই আদতে সে ‘ঘাতক’ হলেও, তার খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি তার চেহারা, চরিত্র, আচার, আচরণ জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাই সেই গ্রহাণু থেকে তড়িঘড়ি ‘নুড়ি-পাথর’ কুড়নো আর সে সব পৃথিবীতে এনে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাটা খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেই লক্ষ্যেই ‘ঘাতক’কে চিনতে-জানতে আজ, বৃহস্পতিবার ওই গ্রহাণুটির উদ্দেশে রওনা হচ্ছে নাসার মহাকাশযান ‘ওসিরিস-রেক্স’। ২০১৮-য় ‘বেনু’র কক্ষপথে ঢুকে পড়ার পর থেকেই ‘ওসিরিস-রেক্স’ শুরু করে দেবে গ্রহাণুর বিভিন্ন এলাকার ‘জমি-জরিপ’করার কাজও।

ধ্রুবজ্যোতির কথায়, ‘‘যেটা সকলেরই নজর কেড়েছে, তা হল, এই গ্রহাণুর পিঠের বেশির ভাগটাই গড়ে উঠেছে কার্বন পরমাণু দিয়ে। রয়েছে প্রচুর হাইড্রোজেনও। প্রাণের অন্যতম প্রধান উপাদান তো এই দু’টি পরমাণুই। এরাই মিলেজুলে হয়তো সেখানে গড়ে তুলেছে নানা রকমের জৈব অণু। কোনও কালে যাদের দৌলতেই হয়তো প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল এই সৌরমণ্ডলে। আর সেই সব জৈব অণু হয়তো এখনও রয়েছে গ্রহাণুটির শক্তপোক্ত পিঠে। শুধু এটাই নয়, হয়তো ওই ‘ঘাতক’-এর শরীর আর তার গঠন-বৈচিত্র্যই আমাদের জানিয়ে দেবে, মঙ্গলে বা বৃহস্পতির ‘চাঁদ’- ইউরোপায় প্রাণ ছিল কি না কোনও কালে বা এখনও কোথাও তার কোনও অস্তিত্ব রয়েছে কি না। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ২০টি অ্যামাইনো অ্যাসিডের অণু ‘বেন্নু’তে মিলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে প্রথম হদিশ পাওয়া গিয়েছিল এই গ্রহাণুটির। তার চেহারাটা অনেকটা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের মতো। ৫০০ মিটারের একটু বেশি।

‘বেন্নু’র পিঠে গেঁথে যাবে ‘ওসিরিস-রেক্সে’র সেই পোগো স্টিক

ধ্রুবজ্যোতি বলছেন, ‘‘খুব কাছ থেকে নজর করার পর স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকলের মতো দেখতে ‘ওসিরিস-রেক্স’ মহাকাশযান থেকে বেরিয়ে আসবে পোগো স্টিকের মতো একটা ছড়ি। খুব ধীর গতিতে। ঘন্টায় সিকি মাইল বেগে। ওই পোগো স্টিকের মাথায় বসানো থাকবে গাড়ির এয়ার ফিল্টারের মতো একটা অংশ। সেখান থেকেই বেরিয়ে আসবে নাইট্রোজেন গ্যাস। নুড়ি-পাথর কুড়নোর আগে গ্রহাণুর বুকে থাকা ধুলোর চাদরটা উড়িয়ে দেবে ওই নাইট্রোজেন গ্যাসই, অনেকটা ফুঁ দিয়ে ধুলো ওড়ানোর মতো। ওই পোগো স্টিকটা বড়জোর তিন থেকে পাঁচ সেকেন্ড। তারই মধ্যে নাইট্রোজেন গ্যাস দিয়ে গ্রহাণুর পিঠের ওপর থেকে ধুলো উড়িয়ে ‘বেন্নু’র বুকে জমা সাড়ে ৪ পাউন্ড নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে নেবে।’’

কেন আশঙ্কা করা হচ্ছে এই গ্রহাণুটিই ‘সাড়ে সর্বনাশ’ হয়ে উঠতে পারে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের?

মুম্বইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্র ওঝার কথায়, ‘‘প্রতি ৬ বছর অন্তর পৃথিবীর কক্ষপথের কাছ ঘেঁষে বেরিয়ে যায় ‘বেন্নু’। প্রতি বারই একটু একটু করে ঘেঁষে আসে পৃথিবীর দিকে। ২১৩৫ সালে ঘুরতে ঘুরতে এই গ্রহাণুটি ঢুকে পড়বে পৃথিবী আর চাঁদের মাঝামাঝি জায়গার একটি ‘কি-হোল’-এ। যা ঝট্ করে পৃথিবীর অনেকটাই কাছে এনে ফেলবে গ্রহাণুটিকে। আর এই ভাবে পৃথিবীর কাছে আসতে আসতেই দে়ড়শো কি পৌনে দু’শো বছরের মধ্যে পৃথিবীর ওপর আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে ‘বেন্নু’র। ২১৭৫ বা ২১৯৬ সালের মধ্যে। মনে করা হচ্ছে, এই ‘বেন্নু’র দৌলতেই এক সময় পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছিল ডাইনোসররা। আবার আছড়ে পড়লে অন্তত দেড় হাজার মিটার গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে পৃথিবীর বুকে।

মহাকাশযান ওসিরিস-রেক্স

এত আশঙ্কার মধ্যে আশার কথা শুধু এই টুকুই। ‘ওসিরিস-রেক্স মিশন’-এর প্রধান জ্যোতির্বিজ্ঞানী দাঁতে লোরেত্তা তাঁর গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘পৃথিবীর ঘাড়ে ‘বেন্নু’র এসে পড়ার সম্ভাবনা কতটা রয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য এখনও কিছু সন্দেহ রয়েছে। গাণিতিক হিসেব বলছে, তেমন ২৭০০টি ঘটনার মধ্যে পৃথিবীর বুকে ‘বেন্নু’র আছড়ে পড়ার মতো ঘটনার সম্ভাবনা থাকে মাত্র একটি।

তথ্য সূত্র: ভিকাসপেডিয়া

Related posts

ফোন কলের মাধ্যমে জালিয়াতি কমাতে Truecaller আনলো নতুন ফিচার

News Desk

নতুন দুই মডেলের ওয়ালটন ল্যাপটপ এখন বাজারে

News Desk

বিটিসিএল আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে : টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী

News Desk

Leave a Comment