আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা চাঁদে আবার মানুষ নিয়ে যাবার জন্য তাদের পরিকল্পনার বিশদ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। দু হাজার ৮০০ কোটি ডলারের (২৮ বিলিয়ন ডলার) এই প্রকল্পে ২০২৪ সালের মধ্যে আবার চাঁদে ফেরত যাবার পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে। এই মিশনের অংশ হিসাবে এই প্রথমবারের মত একজন নারী চাঁদের বুকে পা রাখবেন।
চাঁদে অবতরণ:
চাঁদে অবতরণ বলতে চাঁদের বুকে কোন মহাকাশযানের আগমন বা অবতরণ করা বোঝায়। মহাকাশযানটি মনুষ্যবাহী অথবা মনুষ্যবিহীন উভয়-ই হতে পারে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা ২ মিশন হচ্ছে চাঁদে অবতরণকারী মনুষ্যনির্মিত প্রথম বস্তু যা ১৯৫৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চাঁদে অবতরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো ১১ মিশন চাঁদে মানুষের প্রথম সফল অবতরণ। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই ১০:৫৬ পিএম EDT (স্থানাংকিত আন্তর্জাতিক সময় বা ইউটিসি (UTC) সময় অনুযায়ী ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই ০২:৫৬) মার্কিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রাখেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ এর মধ্যে চাঁদের বুকে ছয়বার মানুষের অবতরণ ঘটে এবং অসংখ্যবার মনুষ্যবিহীন অবতরণ ঘটে।
নিল আর্মস্ট্রং :
নিল এলডেন আর্মস্ট্রং (আগস্ট ৫, ১৯৩০ – আগস্ট ২৫, ২০১২) ছিলেন একজন মার্কিন মহাকাশচারী, বৈমানিক প্রকৌশলী এবং চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণকারী প্রথম ব্যক্তি। তিনি একজন নৌ-বিমানচালক, পরীক্ষামূলক বৈমানিক, এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন।
পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক আর্মস্ট্রং বৈমানিক প্রকৌশল-এ শিক্ষাগ্রহণ করেন। মার্কিন নৌবাহিনী তার পড়ার খরচ প্রদান করতেন ‘হলোওয়ে প্ল্যান’ এর তত্ত্বাবধানে। তিনি ১৯৪৯ সালে মিডশিপম্যান (মার্কিন নৌ ক্যাডেট) ও পরবর্তী বছরই একজন নৌ-বিমানচালক হন। তিনি “গ্রামম্যান এফ৯এফ” বিমান থেকে কোরিয়ার যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন। ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বরে, “লো বম্বিং রান” করার সময় তার বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন বিমানটি একটি “আকাশযান প্রতিরোধী কেবলের” সাথে সংঘর্ষের শিকার হয়। বিমানটির একটি ডানা ধ্বংস হয় এবং তাকে বিমান থেকে প্যারাস্যুটের মাধ্যমে লাফ দিতে হয়। যুদ্ধের পর তিনি পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন এবং এডোয়ার্ডস এয়ার ফোর্স বেইজ, ক্যালিফোর্নিয়ায় -তে পরীক্ষামূলক বৈমানিক হন। তিনি “সেঞ্চুরি সিরিজ ফাইটার্সের” একজন প্রজেক্ট পাইলট ছিলেন এবং উত্তর আমেরিকার এক্স-১৫ বিমানটি সহ সাতবার উড্ডয়ন করেন। নিল আর্মস্ট্রং মার্কিন বিমানবাহিনীতে ‘বোয়িং এক্স-২০ ডায়না-সোয়ার হিউম্যান স্পেসফ্লাইট’ প্রোগ্রামগুলোতে এবং “ম্যান ইন স্পেস সুনেস্ট” হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করেন।
আর্মস্ট্রং নাসা’র দ্বিতীয় মহাকাশচারী দলের মহাকাশচারী কর্পসে ১৯৬২ সালে নির্বাচিত হয়ে যোগদান করেন। তিনি তার প্রথম মহাকাশযাত্রা করেন জেমিনি-৮ মহাকাশযানের “কমান্ড পাইলট” হিসেবে। তিনি ছিলেন নাসা’র প্রথম বেসামরিক মহাকাশচারী। তিনি তার এই মিশনে বৈমানিক ডেভিড স্কটের সঙ্গে প্রথমবারের মতো “স্পেসক্রাফট ডকিং” অর্থাৎ মহাশূন্যে দুটি মহাকাশযানকে মিলিত করেন। মিশনটি অবশ্য বাতিল করা হয় যখন আর্মস্ট্রং বিপদজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। আর্মস্ট্রং-এর শেষ এবং দ্বিতীয় মহাকাশযাত্রার প্রশিক্ষণের সময়, যেখানে তিনি ছিলেন এপোলো-১১ এর অধিনায়ক, তাকে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে “লুনার ল্যান্ডিং রিসার্চ ভিহিকল” এর সাহায্যে অবতরণ করতে হয়েছিলো।
জুলাই ২০, ১৯৬৯ তারিখে আর্মস্ট্রং এবং চন্দ্রগামীযানের বৈমানিক বাজ আলড্রিন প্রথমবারের মতো চাঁদে পা রাখেন। তাঁরা পরের দিন দুই ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট তাদের “ঈগল” নামক চন্দ্রযানটির বাইরে অবস্থান করেন। সহযাত্রী মাইকেল কলিন্স চন্দ্রযানটিতে অবস্থান করেন। চাঁদে পা ফেলেই আর্মস্ট্রং তার বিখ্যাত উক্তিটি করেন,
“ “That’s one small step for [a] man, one giant leap for mankind.” অর্থাৎ, এটি [একজন] মানুষের জন্য অতি ক্ষুদ্র পদক্ষেপ; কিন্তু মানবজাতির জন্য এক বিরাট অগ্রযাত্রা। ”
কলিন্স ও আলড্রিনের সাথে আর্মস্ট্রং মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের কাছ থেকে “Presidential Medal of Freedom” পদক লাভ করেন। রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার তাকে ভূষিত করেন “Congressional Space Medal of Honor” পদক দিয়ে। ২০০৯ সালে আর্মস্ট্রং ও তার সহযাত্রীদের “Congressional Gold Medal” প্রদান করা হয়।
১৯৭১ সালে নাসা থেকে পদত্যাগ করে আর্মস্ট্রং চিনচিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অধ্যাপনা করেন। তিনি মহাকাশযান “চ্যালেঞ্জার” এর দুর্ঘটনার তদন্তের জন্য গঠিত ‘রজার্স কমিশনের’ সদস্য ছিলেন। বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্বপালন করেন এবং আর্মস্ট্রং ১৯৭৯ সালের জানুয়ারির শুরু থেকে ক্রিস্লার (Chrysler) নামক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনেও আবির্ভূত হয়েছিলেন।
চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ :
১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাইয়ের সকাল। যুক্তরাষ্ট্রের কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারের আশপাশের কয়েক কিলোমিটার লোকে লোকারন্য। গত রাত থেকেই কার, জিপ, বাস, নৌকা এমনকি ছোট ছোট বিমানও গাদাগাদি অবস্থা গোটা এলাকা। অনেকেই ছোট ছোট তাবু খাটিয়ে অস্থায়ী আবাস বানিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচেই আছেন বহাল তবিয়তে। হাতে ক্যামেরা, দুরবীন, রেডিও নিয়ে কৌতুহলে অধীর অপেক্ষা আর উত্তেজনার প্রহর গুনছেন তারা।
এদের বেশিরভাগই এসেছে আনন্দ-উল্লাস করতে। কেউ কেউ হাতে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে এসেছে মহাকাশ খাতে মার্কিন সরকারের বিপুল অর্থ অপচয়ের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ জানাতে। কিন্তু পক্ষ হোক আর বিপক্ষ হোক, সেদিন সেখানে উপস্থিত সবাই জানত, তারা আজ মানবজাতির অনেক বড় এক ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছেন। এ এমন এক ইতিহাস যা যুগ যুগ ধরে বলে গেলেও পুরোনো হবে না।
কিছুক্ষণ পরেই দুঃসাহসী তিন নভোচারীকে নিয়ে প্রায় তিন লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরের চাঁদের পানে ছুটে যাবে অ্যাপোলো ১১ নামের নভোযান। শুধু তাই নয়, মানব ইতিহাসে এবারই প্রথম পৃথিবীর বাইরে পা রাখবে মানুষ, চরকা কাটা চাঁদের বুড়ির দেশে পা রাখবে। হ্যাঁ, যন্ত্র নয়, আস্ত জলজ্যান্ত মানুষ। এর মাধ্যমেই সেদিন মহাকাশ প্রতিযোগিতায় চির প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নকে দাঁত ভাঙা জবাব দেবে যুক্তরাষ্ট্র। তাই গোটা মার্কিনজাতি (নাকি মানবজাতি) যেনো কল্পনার ডানায় সেদিন তিন নভোচারী- নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্সের সাথে চাঁদের পথে রওয়ানা হয়েছিল।
স্থানীয় ঘড়িতে ৯টা বেজে ২৩ মিনিট। কেপ কেনেডির দিগন্তরেখায় আকাশমুখি করে রাখা রকেটের তলদেশে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠতে শুরু করল। তীব্র আগুনের হলকার সাথে সাদা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল চারদিক। ধুমকেতুর মত লেজে আগুনেপুচ্ছ রেখে ধীরে ধীরে আকাশের দিকে ছুটতে শুরু করল স্যাটার্ন ভি রকেট। ক্রমেই বাড়তে লাগল তার বেগ। রকেটটির ওপরের দিকে বিশেষ কায়দায় বসানো হয়েছে কমান্ড মডিউল ও লুনার মডিউল। তার মধ্যেই তখন বসে দাঁতে দাঁত চেপে মহাকর্ষের শক্ত বাধন ছিন্ন করছেন তিন নভোচারী।
চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষের পা পড়ে ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই ৷ এরপর ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিন বছর বিভিন্ন সময় মোট ১২ জন মহাকাশচারী চাঁদের মাটিতে পায়চারি করতে সফল ৷ সবক’টা অভিযানই ছিল নাসার অ্যাপোলো প্রোগ্রামের অন্তর্গত ৷ নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন হলেন চাঁদে পা রাখা প্রথম ও দ্বিতীয় মানুষ ৷ এরপর আরও ১০জন চাঁদে গিয়েছেন ৷ সবচেয়ে বেশি বয়সে চাঁদে পা রাখেন অ্যালান শেপার্ড ৷ তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৭ বছর ৮০ দিন ৷ এবং সবচেয়ে কম বয়সে চাঁদে পা রাখার নজির গড়েন চার্লস ডিউক ৷ মাত্র ৩৬ বছর ২০১ দিন বয়সেই এই কীর্তি গড়তে সফল ডিউক ৷
‘চাঁদে যাওয়ার ধাপ্পা ‘:
পৃথিবীতে এখনো এমন বহু মানুষ আছেন, যারা বিশ্বাস করেন, মানুষ আসলে কোনদিন চাঁদে যায়নি।মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে জরিপ চালিয়েছে। তাদের জরিপে সব সময় দেখা গেছে, চাঁদে মানুষ যাওয়ার ব্যাপারটিকে সাজানো ঘটনা বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পাঁচ শতাংশ মানুষ।এদের সংখ্যা হয়তো কম, কিন্তু চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারে অবিশ্বাস ছড়ানোর জন্য যড়যন্ত্র তত্ত্ব জিইয়ে রাখতে সেটিই যথেষ্ট।
চাঁদে মানুষ যাওয়ার ব্যপারটিকে পুরোপুরি ধাপ্পাবাজি মনে করেন যারা, তারা এর সপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরেন। এরা মনে করেন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র সেরকম প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ তখনো ছিল না, যেটি সফল অভিযানের জন্য দরকার ছিল।
এই যুক্তি দিয়ে এরা বলে থাকেন, নাসা তাদের অভিযান যে সফল হবে না, সেটা বুঝে ফেলেছিল। কাজেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে মহাকাশ অভিযানে টেক্কা দেয়ার জন্য হয়তো চাঁদে সফল অভিযান চালানোর নাটক সাজিয়েছে। কারণ মহাকাশ অভিযানে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে ছিল, এমনকি তারা চাঁদের বুকে একটি যান ক্র্যাশ ল্যান্ড করিয়েছিল।
নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা দিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ডালপালা ছড়াতে থাকে।তবে এসব গুজব বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পাত্তা পেতে শুরু করে ১৯৭৬ সালে একটি বই প্রকাশ হওয়ার পর। বইটির লেখক একজন সাংবাদিক বিল কেসিং। নাসার একটি ঠিকাদার কোম্পানির জনসংযোগ বিভাগে তিনি কিছুদিন কাজ করেছিলেন। তার বইটির নাম ছিল, “উই নেভার ওয়েন্ট টু মুন: আমেরিকাস থার্টি বিলিয়ন ডলার সুইন্ডল।”লেখকের মূল বক্তব্য হচ্ছে, মানুষ কখনো চাঁদে যায়নি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আসলে তিন হাজার কোটি ডলারের প্রবঞ্চনা করা হয়েছে।এই বইতে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছিল যা পরবর্তী বছরগুলোতে ”চন্দ্র অভিযানের” সাফল্যে অবিশ্বাসীরা এই বিতর্কে সবসময় উল্লেখ করেছেন।
চাঁদের বাতাসহীন পরিমন্ডলে পতাকা উড়লো কীভাবে?
কিছু ছবি দিয়ে তারা এই উদাহারণটি দেয়ার চেষ্টা করেন। তাদের প্রশ্ন, চাঁদে তো বাতাস নেই, তাহলে সেখানে মার্কিন পতাকা উড়লো কেমন করে। তাদের আরও প্রশ্ন, কেন এই ছবিতে চাঁদের আকাশে কোন তারামন্ডল দেখা যাচ্ছে না।
এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে নাকচ করে দেয়ার মতো অনেক বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে, বলছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মাইকেল রিক। তিনি বলেন, নিল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন যখন পতাকাটি খুঁটি দিয়ে চাঁদের মাটিতে লাগাচ্ছিলেন, তখন সেটি কুঁচকে গিয়েছিল। আর যেহেতু পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ছয় গুণ কম, তাই কুঁচকানো পতাকাটি সেরকমই থেকে গিয়েছিল।
চাঁদের মাটিতেও ‘নারী দ্য বস’:
যে নারীর রূপের সাথে চাঁদের তুলনায় মশগুল কবি সাহিত্যিকেরা, সেই নারীর পা এ বার পড়তে চলেছে চাঁদের বুকে। অপেক্ষা আর মাত্র চারটি বছর!
১৯৭২ সালের অ্যাপোলো ১৭ অভিযানের অভিজ্ঞতাকে হাতিয়ার করে নতুন শতাব্দীতে মহাকাশ বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে চলেছে নাসা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম পদচিহ্ন আঁকার কান্ডারি আর্টেমিস প্রকল্প। যার প্রথম অভিযান শুরু হবে ২০২১ এর নভেম্বরে, আরোহী বিহীন মহাকাশযান পাঠিয়ে। তারপর ২০২৩ এর অগস্টে আরোহী সমেত বিমান পাঠিয়ে আরো একবার পরখ করার পরই ২০২৪ সালে ডানা মেলবে আর্টেমিস ৩-এর সেই স্বপ্নের উড়ান। প্রশাসক জিম ব্রিডেনস্টাইনের গলায় তাই দৃঢ়প্রত্যয়ের ইঙ্গিত। ৩০ বিলিয়নের এই প্রকল্পে হোয়াইট হাউস থেকে অনুমোদন এসেছে মাত্র ১.৬ বিলিয়ন ডলারের! কিন্তু তাতেও দমে থাকেননি জিম। অ্যাপোলো অভিযানের সাফল্যকে মাথায় রেখে নতুন প্রজন্মের কাছেমহাকাশ এবং সৌরজগৎ নিয়ে এক নতুন যুগের সূচনার তাগিদে তিনি বিকল্প রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সেই নিরলস চেষ্টাতেই প্রথমে আর্টেমিস ৩ এর উৎক্ষেপণের সময় ২০২৮ ধরা হলেও ২০২৪ সালেই তা সম্ভবপর করে তুলেছে নাসা।
অ্যাপোলো অভিযানের মহাকাশচারীদের মহাকাশের অভিজ্ঞতা যেমন মঙ্গল অভিযানে কাজে লেগেছে, তেমন ভাবেই আর্টেমিস প্রকল্পের মহাকাশচারীদেরও সাহায্য করবেন ৫০ বছর আগের চন্দ্রবিজয়ীরা। চাঁদের ভূত্বকের ধরন এবং নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে অনেক সমস্যার জট খুলে যাবে তাতে। কারণ এবারে অন্যান্য নমুনা সংগ্রহের সাথে সাথেই মূল আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে চাঁদের অজানা গহ্বরে জমে থাকা জলীয় বরফের অস্তিত্ব নিয়ে। কিন্তু এ বারের সমস্যা হল চাঁদের দক্ষিণ মেরু অভিযানের ক্ষেত্রে এক সম্পূর্ণ নতুন জায়গা, আর তাই সেখানে অজানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে আর্টেমিস এর মহাকাশচারীদেরই। নমুনা সংগ্রহে তাঁদের সহায় হবে স্বয়ংক্রিয় রোভার। আমাদের দেখা চাঁদের কলঙ্ক অর্থাৎ চাঁদের বিভিন্ন মাপের বিশাল গহ্বর গুলিতেও পৌঁছে নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারে আশাবাদী মহাকাশচারীরা।
তবে কাজ এখনো অনেক বাকি। চাঁদের উঁচুনিচু ভূত্বকের মধ্যে সম্পূর্ণ অজানাপরিস্থিতিতে এবং চাঁদের দক্ষিণমেরুর লোর বাধার মধ্যে নিজেদের এবং পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য আরও অনেক উন্নত প্রযুক্তির যোগাযোগের প্রয়োজন আছে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন রয়েছে মহাকাশচারীদের পরিবর্তিত প্রতিকূল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার প্রস্তুতির। যাতে চাঁদের বুকে সব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা এবং নমুনা সংগ্রহ করার কাজ সফল হতে পারে। নাসার সহযোগী প্রশাসক থমাস জুব্রাকেনের কথায়, ‘এ বারের অভিযানের উদ্দেশ্য, নতুন অভিজ্ঞতার আলোয় পরবর্তী চন্দ্রঅভিযানের রূপরেখা তৈরি করা। সাথে চাঁদের মাটিতে বিজ্ঞানের যে সমস্ত পরীক্ষা করার বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার।’
এ ছাড়াও চাঁদের দক্ষিণ মেরু চাঁদ এবং পৃথিবীর কক্ষপথের এবং জন্মকালের ব্যাপারেও অনেক অজানা তথ্যের হদিস দেবে বলে আশাবাদী গবেষকরা। সুযোগ দেবে সৌরজগৎকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখার। যা কিনা সৌরজগৎ নিয়ে গবেষণায় নতুন পথের দিশা দেখাবে। চাঁদ এবং সূর্যের পারস্পরিক আচরণের গতিপ্রকৃতি নিয়েও চলবে গবেষণা। একই সাথে চাঁদের দক্ষিণমেরুতে প্রথম বেসক্যাম্প বানানোর পরিকল্পনাও করে রেখেছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। অন্তত চারজন মহাকাশচারী চাঁদের বুকে নমুনা সংগ্রহ এবং বেস স্টেশন তৈরির কাজে নামবেন। শুরু হবে মানব সভ্যতার এক নতুন অধ্যায়। এ বার হয়ত প্রযুক্তির হাত ধরেই কল্পনা আর স্বপ্ন পা দেবে বাস্তবের মাটিতে।
চাঁদে এ বার টানা ৭ দিন :
ব্রিডেনস্টাইন জানিয়েছেন, ৫৫বছর আগে নিল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স আর এডুইন (বাজ) অল়ড্রিনের মতো খুব অল্প সময়ের জন্য এ বার চাঁদের বুকে পা পড়বে না মানুষের। এ বার টানা সাত দিন ধরে চাঁদের মাটিতে হাঁটাহাঁটি, নুড়ি-পাথর কুড়োনো ও নানা ধরনের গবেষণা চালাবেন দুই মহাকাশচারী। আর এক দশকের মধ্যে লাল গ্রহ মঙ্গলের বুকে মানুষের পদার্পণের জন্য জরুরি প্রাথমিক গবেষণা ও প্রস্তুতি শুরু হবে চাঁদের মাটিতে এ বারের পদার্পণ থেকেই। তার পর মহাকাশযানে চেপে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন দুই মহাকাশচারী।
চাঁদে পদার্পণের জন্য কোন দুই মহাকাশচারীকে বেছে নেওয়া হয়েছে সেইসব নামধাম অবশ্য এখনও জানায়নি নাসা। শুধুই খোলসা করেছে তাদের আসন্ন চন্দ্রাভিযান ‘আর্টেমিস মিশন’-এর প্রথম পর্যায়ের পরিকল্পনা।পৃথিবী থেকে চাঁদে যেতে আর্মস্ট্রংদের লেগেছিল তিন দিন| প্রযুক্তি এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই| তাই এ বার আড়াই দিনেই পা ছোঁয়ানো যাবে চাঁদের মাটিতে|
কাজে লাগবে আমাদের অর্থনীতিতেও :
নাসার প্রশাসনিক প্রধান ব্রিডেনস্টাইন বলেছেন, ‘‘আমাদের আসন্ন আর্টেমিস মিশন নিয়ে কংগ্রেসের দুই কক্ষেরই সার্বিক অনুমোদন আমরা পেয়ে গিয়েছি। চাঁদ আবার আমেরিকার নাগালে পৌঁছতে চলছে এই একুশ শতকে। এবার আমরা চাঁদে যাচ্ছি বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, পৃথিবীতে তাদের অর্থনৈতিক সুফল পাওয়ার লক্ষ্যে। এই ভাবে পরবর্তী প্রজন্মকেও আমরা অনুপ্রাণিত করতে চাইছি। চাইছি লাল গ্রহে মানুষের প্রথম পদার্পণের জন্য প্রয়োজনীয় চাঁদে যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণার গতি বাড়াতে।’’
তৈরি ওরিয়ন, এসএলএস :
নাসার তরফে জানানো হয়েছে, ৫৫ বছর পর চাঁদে দ্বিতীয় বার মানুষের পদার্পণের জন্য নাসার অত্যন্ত শক্তিশালী ‘স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এসএলএস)’ ও মহাকাশযান ‘ওরিয়ন (আদত উচ্চারণ ওর্যায়ন)’ তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ওরিয়নের চারটি ইঞ্জিনকে পরখ করে দেখার কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী মাসেই ওই ইঞ্জিনগুলির ‘হট ফায়ার টেস্ট’ (প্রচণ্ড তাপমাত্রাতেও সেগুলি যাতে গলে না যায়) হবে।হট ফায়ার টেস্টের পরেই ওরিয়ন মহাকাশযানের ‘কোর স্টেজ’টি (ভিতরের অংশ) পাঠানো হবে ফ্লোরিডায় নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারে। তাকে মহাকাশযানের মূল অংশের সঙ্গে জোড়া হবে।
আর্টেমিস-১ থেকে আর্টেমিস-৪: ধাপে ধাপে :
তার পর এসএলএস এবং ওরিয়নকে পরীক্ষামূলক ভাবে একই সঙ্গে পাঠানো হবে চাঁদের কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করতে। মহাকাশচারীদের জন্য লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম ঠিকঠাক ভাবে কাজ করছে কি না, সেটাও অন্যতম লক্ষ্য হবে সেই সব পরীক্ষানিরীক্ষার। এটাই আর্টেমিস মিশনের একেবারে প্রাথমিক ধাপ। ‘আর্টেমিস-১’। যা চাঁদের কক্ষপথে পাঠানো হবে আগামী বছর। সেই অভিযানে কোনও মহাকাশচারী থাকবেন না। তার দু’বছর পর ২০২৩-এ হবে ‘আর্টেমিস-২’ মিশন। তাতে মহাকাশযানে থাকবেন এক মহাকাশচারী। তবে তিনি মহাকাশযান থেকে বেরবেন না।
২০২১ থেকেই শুরু যাওয়া-আসা :
ব্রিডেনস্টাইন জানিয়েছেন, আর্টেমিস-২ অভিযানে চাঁদের কক্ষপথে এসএলএস রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ওরিয়ন মহাকাশযানটি চালাবেন এক পাইলট মহাকাশচারী।
পরবর্তী আর্টেমিস-৩ অভিযানে হবে ওরিয়ন মহাকাশযান থেকে চাঁদের মাটিতে নামার পরীক্ষানিরীক্ষা। এই সব পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি হিসাবে ২০২১ থেকেই বছরে দু’বার করে চাঁদের কক্ষপথে থাকা মহাকাশযানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পাঠাতে শুরু করবে নাসা।
আর আর্টেমিস-৪ অভিযান থেকে চাঁদের কক্ষপথে আমাদের একটা স্থায়ী আস্তানা গড়ে তুলবে নাসা। এখনকার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মতো। ফারাকটা এখানেই যে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন রয়েছে পৃথিবী থেকে মাত্র ৩৭০ কিলোমিটার উপরে। আর আর্টেমিসের সেই আস্তানা থাকবে আড়াই লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে থাকা চাঁদের কক্ষপথে। সেটাই হবে চাঁদে আমাদের ‘বেস ক্যাম্প’।