Image default
জানা অজানা

অক্টোপাস: আট পায়ের সেই বুদ্ধিমান প্রাণিটি

এই ধরণীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জীব-বৈচিত্র্যর বাহারি সমাহার। স্থলভাগের প্রাণী সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, জলভাগের প্রাণী সম্পর্কে জানাটা রয়ে গেছে ততটাই অন্তরালে। অথৈ জলরাশিতে এমন অনেক জীবের অস্তিত্ব বিদ্যমান, যার সম্পর্কে প্রতিদিন নতুন তথ্য উদঘাটন হচ্ছে আর বিজ্ঞান শুধু হতবাক হচ্ছে।

আর পরিচিত প্রাণীগুলোও যে কম বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছে, এমনটাও নয়। তেমনি একটি হলো আট পায়ে সমুদ্র দাপিয়ে বেড়ানো মলাস্কা পর্বের এক পরিচিত জীব অক্টোপাস। শত্রুর চোখে ধুলো দিতে ওস্তাদ এই প্রাণী সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কোনো অন্ত নেই। প্রাণিজগতের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণীসমূহের জানা-অজানা রহস্যময় দিক নিয়ে আলোচনার আজকের এই পর্ব সাজানো হয়েছে অক্টোপাসকে নিয়ে।

*অক্টোপাসের বসবাস

৪ ভাগ পৃথিবীর ৩ ভাগই জল দ্বারা বেষ্টিত। বাকি ১ ভাগে স্থলভাগের যতটা সৌন্দর্য দেখে আপনি আবেগে আপ্লুত, এর চেয়েও ঢের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে ঐ বিশাল জলভাণ্ডারে। সেই লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যের বিশাল অঞ্চলে রীতিমতো রাজত্ব করে ঘুরে বেড়ায় অক্টোপাসেরা। কখনও কোরাল শৈলশিরায় এদের দেখতে পাওয়া যায়, কখনওবা সমুদ্রের একদম তলদেশে গা ঢেকে থাকে। কখনওবা জাহাজ অথবা নৌকার সামনে ভেসে উঠে। কিছু অক্টোপাস আবার বেজায় সাহসী। জোয়ার ভাটার জায়গাগুলোতে এবং গভীর সমুদ্রে জায়গা করে নেয় নিজেদের বসবাসের জন্য।

আশ্চর্যজনক সামুদ্রিক প্রাণী – অক্টোপাস ; ছবি :Foxum
*জন্ম, বৃদ্ধি ও মৃত্যু

অক্টোপাসের একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া প্রায় সব প্রজাতির অক্টোপাসের মধ্যে একটা সাধারণ মিল আছে। বেশিরভাগ অক্টোপাসই তুলনামূলক দ্রুত বাড়ে। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার ক্ষেত্রেও এ ধরণের অক্টোপাসেরা আবার এগিয়ে থাকে। তবে এরা বাঁচে কম। অর্থাৎ বৃদ্ধি এবং পূর্ণবয়স্ক হওয়ার বিষয়টি দ্রুত হলেও আয়ুর ক্ষেত্রে স্বল্পতা আছে। কিছু কিছু প্রজাতি মোটে ৬ মাস বাঁচে। এক্ষেত্রে বিপরীতে আছে জায়ান্ট প্যাসিফিক অক্টোপাসগুলো, অক্টোপাসের জাতের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো অক্টোপাস এরাই। এদের আয়ুষ্কাল আবার ৫ বছর।

*রক্তের বর্ণ

মেরুদণ্ডী প্রাণীদের রক্তের রঙ লাল হলেও, অক্টোপাসের রক্ত কিন্তু নীল। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের রক্তের প্রধান বৈশিষ্ট্য লোহিত রক্ত কণিকায় আয়রন যুক্ত হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতি। এই হিমোগ্লোবিনের কারণেই মূলত রক্ত লাল হয়। অপরদিকে, অক্টোপাসের রক্তে হিমোগ্লোবিনের বদলে কপার যুক্ত হিমোসায়ানিন নামক রঞ্জক পদার্থ দ্রবীভূত থাকে। এই হিমোসায়ানিনের জন্যই অক্টোপাসের রক্তের রঙ নীল হয়।

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অক্টোপাসের রক্তে হিমোসায়ানিনের পরিবর্তে হিমোগ্লোবিন থাকলে এমন কী সমস্যা হতো? সমস্যা একটা অবশ্যই আছে! অক্টোপাসকে সমুদ্রে উপরিভাগে তেমন ভেসে বেড়াতে দেখা যায় না, তাদের অষ্টপদী বিচরণ সর্বদা সমুদ্রের গহীন তলদেশে। গভীর সমুদ্রের ঠাণ্ডা পরিবেশে অক্সিজেনের ঘনত্ব থাকে অনেক কম। সে পরিবেশে হিমোগ্লোবিনের চেয়ে হিমোসায়ানিনই দক্ষতার সাথে অক্সিজেন পরিবহনের কাজ সম্পন্ন করতে পারে। হিমোসায়ানিনের কার্যকারিতা আবার পানির অম্লতার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। পানির অম্লতার পরিমাণ বেশি হলে শরীরে অক্সিজেন সংবহন করাটা অক্টোপাসের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানিতে অম্লত্বের পরিমাণ বেড়ে গেলে সামুদ্রিক প্রাণীদের কী হবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিশেষ উদ্বেগে আছেন।

*শত্রু থেকে বাঁচার কৌশল

শিকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য অক্টোপাস শিকারের দিকে একপ্রকার কালি ছুড়ে দেয়। ছুড়ে দেয়া এই কালি শুধু তাকে শিকারের হাত থেকে লুকোতেই সাহায্য করে না, এটা শত্রুকে শারীরিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন করে। এই কালিতে টাইরোসিনেজ নামক একপ্রকার পদার্থ থাকে। মানুষের মধ্যে টাইরোসিনেজ প্রাকৃতিক রঞ্জক মেলালিন তৈরিতে সাহায্য করে। অক্টোপাস এই টাইরোসিনেজ তার শত্রুর দিকে ছুড়ে মারলে, শত্রু কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। এ কালির আরেকটি গুণ হচ্ছে এটি শত্রুর ঘ্রাণশক্তি এবং স্বাদ অনুভবের ক্ষমতা কিছুক্ষণের জন্য নষ্ট করে দেয়। মুহূর্তে শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে নিজেকে শত্রুর সামনেই ছদ্মবেশে লুকিয়ে ফেলার অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে অক্টোপাসের।

অক্টোপাসের কালি ছুড়া ; ছবি : কিংবদন্তি
*খাদ্য হিসেবে অক্টোপাস

অক্টোপাস সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায়। এছাড়াও পূর্ব এশিয়া, স্পেন, গ্রিস এবং আমেরিকাতেও খাদ্য হিসেবে অক্টোপাস জনপ্রিয়। জীবন্ত অক্টোপাস বা স্যান-ন্যাক-জি, দক্ষিণ কোরিয়াতে একটি সুস্বাদু এবং জনপ্রিয় খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা বিশ্বাস করে গ্রীষ্মকালে এটি শক্তি বর্ধক হিসেবে দারুণ কাজ করে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, জীবন্ত অক্টোপাস খেলে রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর প্রায় দুই লক্ষ সত্তর হাজার টন অক্টোপাস আমদানি করা হয়ে থাকে।

অক্টোপাস গ্রিল ; ছবি : Cake Lovers
*ছদ্মবেশী অক্টোপাস

প্রাণিজগতে ছদ্মবেশ ধারণে অক্টোপাসের জুড়ি নেই। সেকেন্ডের দশ ভাগের তিন ভাগ সময়ে নিজের শরীরের রঙ পরিবর্তন করতে সক্ষম। বিপদের সম্মুখীন হলে বা শিকার ধরার প্রয়োজনে সমুদ্রের তলদেশের বিভিন্ন শৈবাল কিংবা পাথরের মতো করে নিজেকে উপস্থাপন করতে ওস্তাদ।

*বুদ্ধিমত্তা

একটি অক্টোপাসের নিউরন সংখ্যা প্রায় ৫০০ মিলিয়ন, যা একটি কুকুরের নিউরন সংখ্যার সমান। সিটেল একাডেমির প্রাণিবিদরা বিলি নামের এক অক্টোপাসের শক্তি ও বুদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য তাকে একটি বোতলের মধ্যে খাবার আটকে দেন। বিলি ৫ মিনিট সময় নেয় বোতলটি খোলার জন্য। তবে অক্টোপাসের মতো প্রাণীর জন্য এটা খুব বেশি অবাক করার বিষয় নয়। কারণ তারা ছুরির সাহায্য ছাড়াই শামুক, ঝিনুকের খোলস খুলে ফেলতে পারে।

জলের ভেতর তৈরি হওয়া বিভিন্ন গোলকধাঁধাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা সহজেই সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে। রসিকতায়ও কম যায় না এরা। অনেক সময় তারা দুষ্টুমির ছলে জেলেদের নৌকা আটকে দেয়। নারিকেল খোসা, ঝিনুক-শামুকের খোলসে বাসা বাধা সহ তারা কাঁকড়ার খোলস ছাড়ানোর পর তাদের মাংস খেয়ে উদরপূর্তি করতে পারে। জার খোলার ব্যবস্থাও এদের জানা আছে। বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকলে আমরা যেমন দাঁত দিয়ে নখ কাটি, অক্টোপাসও এমন অবস্থায় নিজেদের উপাঙ্গ কামড়ে খেয়ে বিষণ্ণতা কাটানোর চেষ্টা করে। অক্টোপাসের স্নায়ুতন্ত্র মানুষের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। মস্তিষ্কের আকারও বেশ বড়। অথচ তাদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে চিনতে পারা সহ অনেক বিস্ময়কর দক্ষতা রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণও পেয়েছেন।

*সবচেয়ে বড় অক্টোপাস

সবচেয়ে বড় প্রজাতির অক্টোপাস হলো জায়ান্ট প্যাসিফিক অক্টোপাস। একেকটা জায়ান্ট অক্টোপাসের গড় ওজন প্রায় ১৫ কেজির কাছাকাছি এবং তারা তাদের বাহু সর্বোচ্চ ১৪ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারে। তবে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বৃহৎ যে জায়ান্ট প্যাসিফিক অক্টোপাস পাওয়া গিয়েছে, তার ওজন ছিল ৭১ কেজির কাছাকাছি। নর্থ প্যাসিফিকে এই আধিক্য বজায় আছে বলে একে অনেকসময় ‘নর্দার্ন প্যাসিফিক জায়ান্ট’ বলেও অভিহিত করা হয়। এছাড়াও ক্যালিফোর্নিয়া, অরিগন, ওয়াশিংটন, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, রাশিয়া, জাপানেও এর দেখা পাওয়া যায়।

প্রাণিজগৎ বুদ্ধিমান অক্টোপা ; ছবি : Vinnosomoy
*পৌরাণিক কাহিনিতে অক্টোপাস

আপনি যদি পৌরাণিক কাহিনি সম্বলিত বই পড়তে অথবা মুভি দেখতে পছন্দ করেন তাহলে কোথাও না কোথাও অক্টোপাসের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে আপনার। সামুদ্রিক দানব হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই প্রাণীটিকে চিনতে কি একটু সমস্যা হয়েছিল?

ডেভি জোস (পাইরেটস অফ ক্যারিবীয়) ; ছবি : Pinterest

নরওয়ের ক্রাকেন, আইনুদের আকোরোকামুই, প্রাচীন গ্রিসের গর্গন রূপে অক্টোপাস যেভাবে আবির্ভূত হয়েছিল, তা কি মনে আছে পাঠক?

ভিক্টর গুগোর টয়লার্স অব দ্য সি বইতে অক্টোপাসের সাথে যুদ্ধের একটা বর্ণনা আছে। এছাড়াও জাপানের উত্তেজক অনেক চিত্রতেও কিন্তু অক্টোপাসের স্থান রয়েছে যার নাম সুঙ্গা।

সূত্র : রোয়ার মিডিয়া, কিংবদন্তি

Related posts

পেঁয়াজ কাটলে কেন চোখে পানি আসে?

News Desk

বীজগণিত কি : বাস্তব জীবনে কি আমাদের কোন কাজে লাগে?

News Desk

সিকাডা ৩৩০১ : ইন্টারনেট জগতের অমীমাংসিত রহস্য

News Desk

Leave a Comment